asd

হামদ ও নাতের বুলবুল ‘কবি নজরুল’…

– হাবিব মোস্তফা।

দয়াময় আল্লাহ প্রেমের নিবেদিত হৃদয়ের এক বিরল দৃষ্টান্ত কাজী নজরুল ইসলাম। ‘আল্লাহকে পেতে হলে রাসূল (সা:)কে ভালোবাসতে হবে’ এই চিরসত্য বিধানটি নজরুলের লেখায় স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। প্রভু প্রেমের শরাব পানের পাশাপাশি তিনি রাসূল প্রেমের অগ্নিশিখায় দাহ হয়েছেন। এমন সাধক-কবি বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া সত্যি দুস্কর।

গবেষকদের মতে, কাজী নজরুল ইসলামের ইসলামী গানের সংখ্যা তিনশতের কাছাকাছি। তার রচিত ইসলামী গানের প্রতিটি শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস, সুরের হৃদয়ছোঁয়া টান সব মিলিয়ে সেরাদের সেরা স্থান দাবিদার। বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য ইসলামী সংগীত লিখে নজরুল যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, তা চিরদিন চিরকাল অম্লান হয়ে থাকবে পৃথিবীতে নজরুলকে জানে এমন প্রতিটি মুসলমান হৃদয়ে হৃদয়ে।

নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় সর্বাধিক হামদ-নাতের রচয়িতা। তিনি আল্লাহপাকের প্রশংসায় লিখেছেন হামদ। রাসুল (সা.) কে নিয়ে নাত। মহানবী (সা.) এর জীবন ও তাঁর রূপ-সৌন্দর্য বোঝাতে গিয়ে তিনি যে উপমা ও বর্ণনার ভঙ্গি তুলে ধরেছেন, তার সুরের ঔদার্য ও শব্দের অলঙ্কারে যে ব্যাকুলতা ছড়িয়ে দিয়েছেন, সে উপমা আজও বিরল। কবি আল মাহমুদ বলেছেন, ‘কাজী সাহেব উপরে ছিলেন সাধারণ মানুষ আর ভেতরে ছিলেন দারুণ ক্লাসিক্যাল।’ কাজী নজরুল ছিলেন গজল গানের প্রবর্তক। শুধু প্রবর্তকই নন; ছিলেন শ্রেষ্ঠ।

যেসব গানে আল্লাহ প্রশস্তি রয়েছে সেগুলোকেই হামদ বলা হয়। হামদ বাংলা সাহিত্যে নতুন সংযোজন। এর ঐহিত্য বা উৎসমূল সন্ধান করলে আরবী ও ফার্সী সাহিত্যের উল্লেখ করতে হয়। আরবী ধারা অনুসৃতিতে ইরানের মুসলিম সুফি কবিরাই ব্যাপকভাবে এই ধরনের আল্লাহ প্রশস্তিমূলক গানকে কাব্যভাষায় রূপ দেন। পরবর্তীতে গজর ও কাওয়ালীরূপে এই হামদ এ উপমহাদেশীয় সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছে। সাধারণত উর্দু ভাষায় এ ধরনের গান লিখিত হত এবং একক বা সমবেতভাবে তা গাওয়া হত। কাজী নজরুল ইসলামই বাংলা ভাষায় এই গানের ঐহিত্য সৃষ্টি করেন। পরবর্তীতে কবি গোলাম মোস্তফা প্রমুখ মুসলিম কবি এই জাতীয় হামদ লিখলেও নজরুলের অপ্রতিদ্বন্দিতা তাতে ক্ষয়িত হয়নি। নজরুলের বিখ্যাত হামদগুলোর অন্যতম: ‘ফুলে পুছিনু বল বল ওরে ফুল/কোথা পেলি এ সুরভি রূপ এ অতুল’।

প্রভুর প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখেছেন, ‘আল্লাহ আমার প্রভু, আমার নাহি নাহি ভয়, আমার নবী মুহাম্মদথ যাঁহার তারিফ জগৎময়’। ‘আল্লাহ নামের বীজ বুনেছি এবার মনের মাঠে, ফলবে ফসল বেচব তারে কিয়ামতের হাটে’। যদিও কাব্যগীতিতে মরমী বোধের আভাস আছে, তবু আল্লাহর মহিমা বর্ণনাই গানটির প্রতিপাদ্য বিষয়। বস্তুত নজরুলের হামদগুলো অলংকারবহুল ও ভাবসমৃদ্ধ। আল্লাহ সকল সৌন্দর্য, শক্তি, জ্ঞান ও করুনার আধার। ইসলামের দৃষ্টিতে তিনি সকল সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের কর্তা। তিনি এক, একক ও অনন্য। মানুষের সকল চাওয়া তারই উদ্দেশ্যে নিবেদিত। বিষয়গত দিক থেকে এই কাব্যগীতির বিশেষকোন বৈচিত্র নেই কিন্তু আল্লাহর প্রশংসা-গানে ও তার মহিমা ব্যাখ্যায় নজরুল সমহৎ শিল্প সৃষ্টিতে যে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন: আঙ্গিকে, অলংকার সৃষ্টিতে ও সুরারোপে, তার তুলনা নেই। গানগুলো মুসলমানদের তওহীদের প্রতি ঈমানকে যে দৃঢ়তর করতে অশেষ সাহায্য করেছে, আজও করছে তা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়। প্রকারান্তরে এই গানগুলো মুসলমানদের শক্তি ও আধ্যাত্ম চেতনা তথা মারেফাতী অনুভূতিকে উদ্দীপ্ত করেছে, তাদের আত্মোপলব্ধির চেতনাকে করেছে আলোকিত। আল্লাহর প্রতি নিয়ামতের শোকরিয়া জানিয়েছেন নজরুল তার হামদে: এই সুন্দরফুল, সুন্দরফল মিঠা নদীর পানি,খোদা তোমার মেহেরবানী।

আল্লাহর পরিচয় কি, তিনি কাছে না দূরে থাকেন, তাঁকে চেনার উপায় কি এসব বিষয় সম্পর্কে ধারণা দিতে গিয়ে নজরুল বলেছেন, আল্লাহ যদিও ধরা ছোঁয়ার বাইরে, তবু এই মহান সত্তাকে চেনা যাবে তার সৃষ্টিতে, তাঁকে অনুভব করা যাবে প্রকৃতির প্রতিটি বস্তুতে। তিনি এক স্থানে বা এক বস্তুতে সীমাবদ্ধ নন, বরং আকাশ-জমিনের সর্বত্র তিনি বিরাজমান। সে জন্যই কবি আল্লাহর নির্দিষ্ট কোন নাম খুঁজে পাননি। আল্লাহর ৯৯টি গুনবাচক নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি তাঁকে ‘অ-নামিকা’ নামে সম্বোধন করেছেন। কবি লিখেছেন- ‘কোন নামে হায় ডাকব তোমায়, নাম না জানা অ-নামিকা জলে স্থলে গগন তলে, তোমার মধুর নাম যে লিখা।
নজরুল আল্লাহর শ্রেষ্ঠ্যত্বের পাশাপাশি তার সৌন্দর্যও বর্ণনা করেছেন। আল্লাহর সৌন্দর্য সম্পর্কে তিনি বলেছেন,
হে চির-সুন্দর, বিশ্ব চরাচর
তোমার মনোহর রূপের ছায়া,
রবি শশী তারকায় তোমারই জ্যোতি ভায়া,
রূপে রূপে তব অরূপ কায়া।

নজরুল আল্লাহকে খুঁজেছেন সৃষ্টির সব সৌন্দর্যের মাঝে। সৃষ্টির যেখানেই রূপ দেখেছেন, সেখানেই আল্লাহকে স্মরণ করে তাঁরই বন্দনা করেছেন। এক গানে কবি ফুলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে, হে ফুল ! বলো তো তুমি এ সুগন্ধ কোথায় পেলে ? এই অতুলনীয় রূপ তোমায় কে দিল, যার কারণে তুমি দুনিয়ায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছো। ফুল উত্তরে বলেছিল, আল্লাহ তায়ালাই আমাকে এই রূপ আর সুগন্ধি দান করেছেন।

হামদ যেমন আল্লাহ প্রশস্তি, নাত তেমনি প্রিয় নবীর মহিমা গীতি। ইসলাম যেমন এক আল্লাহ এ বিশ্বাস প্রয়োজন, তেমনি রাসূলের প্রতি বিশ্বাসও সমানভাবে প্রয়োজন। কেননা আল্লাহ এক, অদ্বিতীয় লা-শরীক এই মহাবাণী আমরা রসুলের মাধ্যমেই পেয়েছি। সুতরাং আল্লাহ যেমন তার সৃষ্ট জীব জগতের অনন্ত প্রশংসার দাবীদার, তেমনি তার পরিচয়দানকারী হযরত মুহাম্মদ (সা:)এর প্রতি দুরুদ সালাম পাঠও বিশ্বাসীদের জন্য অবশ্য কর্তব্য।
নজরুল রাসূল প্রেমে নাত লিখেছেন। নজরুলের পূর্বে দু’একজন কবি নাত লিখলেও রূপগত ও গুনগত দিক দিয়ে তারা এতটা সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। রসে, রূপে, সুরে, ছন্দে হিল্লোলিত, লীলায়িত করে সমগ্র বাঙালি মুসলিম চিত্তকে এমনভাবে স্পন্দিত করেনি আর কারো নাত। এখানেই নজরুলের সৃষ্টিকুশলতা অতুললীয় হয়ে আছে। নজরুলের নাত শুধু স্থান ও সমকালের দাবিই মেটায়নি বরং কাল থেকে কালান্তরে মুসলমানদের ধর্ম পিপাসাকে করেছে তীক্ষ্ণ, মানসিক বোধকে করেছে শানিত। রাসুলের প্রেমে তিনি লিখেছেন ১০০-এর বেশি গজল। তার নাতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল সব গীতিকার থেকে ভিন্ন। অন্য সবাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব দিয়ে রাসুলের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু নজরুল বলেছেন, সৃষ্টিই শ্রেষ্ঠ হয়েছে রাসুলকে পেয়ে। যেমন ‘মুহাম্মদের নাম জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, তাই কি রে তোর কণ্ঠের গান এমন মধুর লাগে’। রাসুলের আগমনে লিখেছেন, ‘ত্রিভুবনের প্রিয় মুহাম্মদ এলো রে দুনিয়ায়, আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।’ কিংবা ‘তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে/মধু পূর্ণিমারই সেথা চাঁদ দোলে/যেন ঊষার কোলে রাঙ্গা রবি দোলে’।

কবি নজরুল আল্লাহর প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রেম নিবেদনের পাশাপাশি রাসূলের প্রতি ভালবাসা দেখিয়েছেন। কখনো তিনি তাঁর গানের মাধ্যমে নবীজীর রওযা জিয়ারতের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন, আবার কখনও নবীজী জন্ম, তাঁর জীবন দর্শন, তাঁর শিক্ষা ইত্যাদি বর্ণনা করেছেন। বিষ্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, নবীজীকে নিয়ে তিনি নাত লিখেছেন একশ’র উপরে ! মহানবী প্রশংসা ও গৌরবসূচক এসব গানের জন্য মুসলিম সমাজ কবি নজরুলের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবে। নজরুল কয়েকটি নাতে রাসূলের কলি হচ্ছে,

“ত্রিভুবনের প্রিয় মোহাম্মদ এল রে দুনিয়ায়,
আয়রে সাগর আকাশ বাতাস দেখবি যদি আয়।”

  • “মোহাম্মদ মোস্তফা সাল্লে আলা, তুমি বাদশার বাদশাহ, কামলিওয়ালা।”
  • ” মোহাম্মদ না জপেছিলি বুলবুলি তুই আগে, তাই কি রে তোর কণ্ঠের গান এমন মধুর লাগে।”
  • “মোহাম্মদ মোর নয়ন-মনি মোহাম্মদ মোর জপমালা, ঐ নামে মিটাই পিয়াসা ও নাম কওসরের পিয়ালা।”

কবি নজরুল যে মানুষটিকে নয়নমনি ভেবেছেন তাঁকে নিয়ে যে সুন্দর সুন্দর গান লিখবেন এটাই স্বাভাবিক। সে যাই হোক, নজরুলের লেখা আরো কয়েকটি বিখ্যাত নাতে রাসুল এরকম-

  • ‘নাম মোহাম্মদ বোল রে মন নাম আহমদ বোল,
  • তৌহিদেররই মুর্শিদ আমার মোহাম্মদের নাম,
  • তোমার নামে একি নেশা হে প্রিয় হযরত, এ কোন মধুর শারাব দিলে আল-আরাবী সাকি,
  • মোহাম্মদ নাম যতই জপি ততই মধুর লাগে,
  • ইয়া মোহাম্মদ বেহেশত হতে খোদায় পাওয়ার পথ দেখাও – ইত্যাদি।

আবার আল্লাহ ও রাসূলকে একই প্রেমের সূতায় বেঁধেছেন নজরুল।
তিনি লিখেছেন: আল্লাহ নামের নায়ে চড়ে যাব মদীনায়,
মোহাম্মদের নাম হবে মোর নদী পথে পুবাল বায়।

নজরুল তার গানে সব সময় তার শেষ মৃত্যু যেন ভাল হয় সেই দোয়াই করেছে ‘আমার যখন পথ ফুরাবে আসবে আঁধার রাতি/তখন তুমি হাত ধরো মোর হয়ে পথের সাথী’, ‘মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই’, ‘রোজ হাশরে আল্লা আমার করো না বিচার/বিচার চাহিনা তোমার/দয়া চাহে এ গুনাহগার’, ‘সেদিন তোমার দীদার আমি পাব কি আল্লাজি?’

আল্লাহ নজরুলের এই মোনাজাত কবুল করেছেন। তিনি পরম শান্তিতে মসজিদের পাশেই শুয়ে আছেন।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest Articles