Friday, April 26, 2024

গানের পিছনের গল্প – তিন পাগলের হৈল মেলা নদে এসে…

প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্‌নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক

– তথ্য সংগ্রহে – মীর শাহ্‌নেওয়াজ…

“তিন পাগলের হৈল মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।” – লালন গীতি

এই গানটির ভেতর দিয়ে লালন একটা মিথ, ইতিহাস ও বাঙালির সমাজ পরিবর্তনের নিয়ামক হিসেবে যুগধর্ম প্রণেতা শ্রী চৈতন্য এবং তার সঙ্গী-সাথীদের ইতিহাস ও জীবনযাপন প্রণালী তুলে ধরেছেন। লালন তার এই গানের ভেতর দিয়ে নদীয়ার এই যুগধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন সাবলীলভাবে। লালন এই তিন পাগল এবং তাদের কীর্তিকলাপ দেখে সমাজের যারা কুলীন, কুলের গৌরবে অন্ধ তাদের সতর্ক করে পাগলের কাছে যেতে নিষেধ করেছেন। গানের ভাষ্যে যাওয়ার আগে গানের সম্পূর্ণ পাঠ তুলে ধরতে চাই।

লালন (১৭৭৪-১৮৯০) বাংলার বাউল ঘরানার সর্বশ্রেষ্ট সাধক। জীবনভর এ সাধক কর্ষণ করেছেন নান্দনিক ও আধ্যাত্মিক সংগীতশস্য – যা একাধারে মরমী ও মানবিক। তবে লালন -এর ভাবদর্শন এক দিনে তৈরি হয়নি, সে জন্য বাংলার ভাব জগতে এক দীর্ঘকালীন প্রস্তুতি চলছিল, যে প্রস্তুতিপর্বে ক’জন বাঙালি তত্ত্বদর্শী গভীর অবদান রেখে গেছেন। লালন তাঁর ‘তিন পাগলের হৈল মেলা নদে এসে’ গানে সবিনয়ে তাদের মহাত্ম বর্ণনা করেছেন।

লালন এর একজন গুরুর কথা আমরা জানি। তিনি হলেন সিরাজ সাঁই। কাহার-সম্প্রদায়ভুক্ত সিরাজ সাঁইয়ের নিকট দীক্ষা গ্রহণের পর তাঁর প্রকৃত সাধকজীবনের সূচনা। সিরাজ সাঁই ছাড়াও লালন এর আরও তিনজন গুরু ছিলেন। গুরু বলতে এখানে লালনের চোখে শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিকে বোঝানো হচ্ছে – যাদের কথা লালন তাঁর একটি গানে উল্লেখ করেছেন,

তিন পাগলে হৈল মেলা নদে (নৈদে) এসে
অরে মন তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
একটা পাগলামী করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢোইলে ( ঢুলে ) ধূলার মাঝে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
একটা নারকোলের মালা
তাতে জল তোলাফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি (সঙ্গ নিবি) পাগল হবি বুঝবি শেষে।
পাগলের নামটি এমন
বলিতে ফকির (অধীন) লালন হয় তরাসে
অদৈ নিতে চৈতে পাগল নাম ধরেছে (ধরে সে)।
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।

এই গানটি বেশ জনপ্রিয়। এদেশের হাটে-মাঠে-ঘাটে শোনা যায়। গানটি জনপ্রিয় বলেই মনে প্রশ্ন জানে গানটির মানে নিয়ে সাধারণ শ্রোতা আগ্রহ বোধ করে কি না। নাকি তারা কেবলি সুর ও তালের ঘোরে মাথা ঝাঁকায় ? লালন এর গান নিয়ে আলোচনা হয় সাধুসঙ্গে-এটা আমরা জানি, কিন্তু সে তো মুষ্টিমেয় তত্ত্বজিজ্ঞাসুর কর্ম, ওই আসরে সাধারণ্যের প্রবেশ দুঃসাধ্য। তা সত্ত্বেও কি বাউল গানের মানে নিয়ে সাধারণ শ্রোতার মনে কি প্রশ্নের উদয় হয় না? যা হোক। এই গানটির মানে বোঝার চেষ্টা করা যাক।

তিন পাগলে হৈল মেলা নদে এসে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
নদে মানে ধরে নিচ্ছি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, নদীয়া জেলা। জ্ঞানপীঠ বলে যে জায়গাটির এককালে বিপুল খ্যাতি ছিল। সেই নদীয়া জেলায় তিনজন পাগলের মেলা বসেছে। আমরা অনেক সময় বিদ্যাধর পন্ডিতব্যাক্তিকে পাগল বলি। ‘হৈল মেলা’ বলতে দেখা হয়েছে বোঝানো হয়েছে। তিনজন সাধারণ মানুষের ‘দেখা’ হয়। আর তিনজন জ্ঞানী মানুষের দেখা হলে ‘মেলা’ বসে যায়। আশেপাশে লোকের ভিড় বাড়ে, চলতে থাকে প্রশ্ন-উত্তর। লালন প্রথমেই কিন্তু তিন জন পাগলের নাম বলেননি, নাম বলেছেন গানের শেষ স্তবকে।

এরপর লালন বলছেন,
একটা পাগলামী করে
জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে
আবার হরি বলে পড়ছে ঢোইলে ( ঢুলে ) ধূলার মাঝে
তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।
এ ক’টি চরণে পাগলের মানসিক প্রবণতা সম্বন্ধে অনেকটাই বোঝা গেল। একজন পাগলামী করে ‘জাত দেয় সে অজাতেরে দৌড়ে গিয়ে’। এই চরণে যেন লালন পাগলের ‘জাত’ অনেকটাই চিনিয়ে দিলেন। এই পাগলেরা বৈপ্লবিক চিন্তাচেতনায় আচ্ছন্ন। কেননা, বাংলায়-যেখানে জাতপাতের অলঙ্ঘনীয় প্রাচীর উঠেছে-সেখানে জাতহীনকে জাত দেওয়া সহজ কথা নয়: এক অর্থে এটি পাগলামীই বটে। কেননা, অজাতকে জাত দিলে নিজের জাত খোয়ানোর আশঙ্কা থাকে। সে আশঙ্কা মাথায় নিয়েই উনিশ শতকে লালন গেয়ে উঠেছিলেন,
জগত জুড়ে জাতের কথা
লোকে গল্প করে যথাতথা
লালন বলে জাতের ফাতা ডুবিয়েছি সাধবাজারে।

বোঝা গেল, লালনের পাগলেরা সময়ের চেয়েও অগ্রসর চিন্তার অধিকারী এবং মানবতাবাদী। তবে তারা জাতপাত না-মানলেও ঈশ্বরে বিশ্বাসী। কেননা, ‘আবার হরি বলে পড়ছে ঢলে ধূলার মাঝে।’ হরি এবং আল্লাহ্ সমার্থক। তার মানে ওই মানবিক পাগলেরা সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত অবস্থায় আল্লাহর জিকির (স্মরণ) করতে করতে (সুফিদের মতো?) ধুলায় লুটিয়ে পড়ছে। শোষিত শ্রেণীর পাশে দাঁড়ানো এবং ঈশ্বরের প্রতি গভীর বিশ্বাস-এটাই বাংলার মানবতাবাদীদের পবিত্র আদর্শ …কিন্তু, লালন এও বলছেন, ‘তোরা কেউ যাসনে ও পাগলের কাছে।’
কেন ? এবার সে প্রসঙ্গে আসব।

একটা নারকোলের মালা
তাতে জল তোলাফেলা করঙ্গ সে
পাগলের সঙ্গে যাবি (সঙ্গ নিবি) পাগল হবি বুঝবি শেষে।
কি শব্দচয়ন, কি ছন্দ, কি ভাব- এ ক’টি চরণের ভাঁজে ভাঁজে লালনের প্রজ্ঞা প্রতিভার কী অপূর্ব বিকিরণ! এ ক’টি চরণ মনের ভিতরে যতই গুঞ্জরিত হতে থাকে-ততই মহাত্মা লালনের উপলব্দির গভীরতায় বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে এই তিনটি চরণ গানটিতে এসেছে অপ্রাসঙ্গিকভাবে-গানের মূল বক্তব্যের সঙ্গে মিল নেই। আসলে তা নয় এবং এখানেই আমাদের বিস্ময়। এ তিনটি চরণ লালন এর প্রজ্ঞার বিরল উদাহরণ। বুঝিয়ে বলি-একদা গ্রামাঞ্চলে নারিকেলের মালাকে ‘কাপ’ কিংবা ‘মগ’ হিসেবে ব্যবহার করা হত। নারিকেলের মালার আরেক নাম ‘করঙ্গ’। গৌড়ীয় বৈষ্ণববাদীরা ভক্তির মধ্যে জীবনের মুক্তি খুঁজলেও ব্যবহারিক জীবনে তারা প্রচলিত সামাজিক নানা বেশ-ভূষণের পাশাপাশি নানা ব্যবহার্য দ্রব্যাদি তারা নিজেদের মতো করে ব্যবহার করতেন। তারই একটা হল এই ‘করঙ্গ’। এটি নারিকেলের খোল দিয়ে তৈরি হয়। এই পাত্রেই তারা পানাহার্য করে থাকেন। লালন তাদের সেই পানাহার্য পাত্রের কথাই বলেছেন এই স্তবকে। তবে লক্ষ্য করবার বিষয় যে, লালন গানের সঠিক তরজমা ও পাঠের অভাবে অনেক বিখ্যাত গায়ক এই স্তবক গাইতে গিয়ে ভুলবশত ‘করঙ্গ সে’-এর স্থলে ‘করণদোষে’ গেয়ে থাকেন। কিন্তু আসলে বিষয়টি ‘করঙ্গ’ যা গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের পানপাত্র।

এই করঙ্গ-র বৈশিষ্ট্য স্থির বা Fixed. কেননা, এতে কেবল ‘জল তোলা, ফেলা-ই’ হয় আর কিছু হয় না। এই ধরনের স্থির চরিত্র দিয়ে সমাজ (কর্পোরেট সোসাইটি) তৈরি হয়, এরা বোধবুদ্ধিহীন অনঢ় বলেই পরিবর্তনের প্রয়োজন বোধ করে না । সোসাল সিসটেম পরিচালনার জন্য এরকম বোধবুদ্ধিহীন অনঢ় চরিত্রের প্রয়োজন। কাজেই দীর্ঘকাল সমাজের শুভ পরিবর্তন হয়নি। এরা সমাজ টিকিয়ে রাখার স্বার্থে জাতপাত, বর্ণবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য টিকিয়ে রাখে। যে জাতপাত নদীয়ার তিন ‘বিপ্লবী পাগল’ ভেঙে ফেলতে চান। লালন যে কারণে ভর্ৎসনা করে বললেন, ‘পাগলের সঙ্গে যাবি ( সঙ্গ নিবি ) পাগল হবি বুঝবি শেষে।’ কেননা, পাগলের সঙ্গে গেলে ‘প্লেটো কথিত’ গুড বয়দের পরিবর্তনহীন অনঢ় সমাজটি ধ্বসে পড়বে যে! তা কি ঠিক হবে? তাহলে তো জগতে শান্তি বিরাজ করবে। তা কি ঠিক হবে? বরং তোরা চিরকাল ফিক্সড চরিত্রের ‘করঙ্গ’ হয়েই থাক।
লালন এবার তিনজন গুরুর নাম বলেছেন।

পাগলের নামটি এমন
বলিতে ফকির (অধীন) লালন হয় তরাসে
অদৈ নিতে চৈতে পাগল নাম ধরেছে (ধরে সে)।
মহৎ মানুষের নাম সহজে উচ্চারণ করা যায় না। যেমনটি, এককালে বাংলায় বধুরা স্বামীর নামটি মুখে আনতে ভয় পেত। তেমনি, পাগলের নাম উচ্চারণ করতে লালন ভয় পান। এত বড় মাপের মানুষ, ভয় তো হবেই। এখন তবে বলি, অদে হলেন অদ্বৈত আচার্য, নিতে হলেন শ্রী নিত্যানন্দ এবং চৈতে হলেন শ্রীচৈতন্যদেব। এই তিনজনের হাত ধরেই নদীয়াতে কৃষ্ণ নামের জোয়ার বয়ে যায়। অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ এবং শ্রীচৈতন্য- এই তিনজন ‘পাগল’ই লালন এর গুরু। যোগ্য গুরুই বটে!

অলংকরন – গোলাম সাকলাইন…

১] তিন পাগলের হৈল মেলা / মূল গান
https://www.youtube.com/watch?v=JhwuzgVV5vc

২] তিন পাগলের হৈল মেলা / টুনটুন ফকির
https://www.youtube.com/watch?v=03oKr14ywI4

৩] তিন পাগলের হৈল মেলা / ‘তিন পাগলের গান’
https://www.youtube.com/watch?v=LR1KxQzZ_tg

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles