Friday, April 19, 2024

আজ তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী…

– মোশারফ হোসেন মুন্না।

মোবারক হোসেন ১৯৩৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামের এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ একজন প্রখ্যাত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতশিল্পী এবং মাতা উমার উন-নেসা। তার চাচা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ। তাঁরা ছয় ভাই ও তিন বোন। ভাইরা হচ্ছেন – ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, মোবারক হোসেন খান, সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান, তানসেন খান এবং বিটোফেন খান। আর তাঁর তিন বোন আম্বিয়া, কোহিনূর, ও রাজিয়া।

পারিবারিক ঐতিহ্য অনুযায়ী সবাই সঙ্গীতে মগ্ন। তাই তার পিতা চেয়েছিলেন তিনি যেন সঙ্গীতের পাশাপাশি পড়াশুনা করেন। এজন্য সঙ্গীতে দীক্ষা গ্রহণের পূর্বে তিনি মাইনর স্কুলে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। দেশ বিভাগের পূর্ব থেকে তার পিতার গান শিখানোর উদ্দেশ্যে কুমিল্লা জেলায় যাতায়াত ছিল এবং ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তারা সপরিবারে সেখানে চলে যান। মোবারক সেখানে কুমিল্লা জিলা স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ১৯৫২ সালে মেট্রিক পাস করেন। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। মোবারক হোসেনের কর্মজীবন শুরু হয় বাংলাদেশ বেতারের অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে ২০ অক্টোবর, ১৯৬২। পরে তিনি বেতারের মহাপরিচালক হিসেবে ৩০ বছর কর্মরত ছিলেন। এসময়ে তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার সঙ্গীত বিষয়ক লেখা কেউ প্রকাশের দায়িত্ব না নিতে চাইলে তা প্রকাশের দায়িত্ব নেন রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই। লেখালেখি সূত্রে পরিচয় হন কবি আল মাহমুদের সাথে। আল মাহমুদ তখন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক। তার মাধ্যমে ১৯৮০ সালে শিল্পকলা একাডেমি থেকে প্রকাশ করেন তার প্রথম সঙ্গীত বিষয়ক বই সঙ্গীত প্রসঙ্গ। বিভিন্ন পত্রিকায় তার সঙ্গীত বিষয়ক লেখা নিয়ে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় বই বাদ্যযন্ত্র প্রসঙ্গ। এরপর তিনি রচনা করেন সঙ্গীত মালিকা। এই বইটিও প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি। পরবর্তীতে তিনি সঙ্গীত ও শিশু বিষয়ক ১২০টির মত গ্রন্থ রচনা করেন।

মোবারক হোসেন সঙ্গীতশিল্পী ফৌজিয়া ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন। তাদের তিন সন্তান – কন্যা রিনাত ফৌজিয়া সঙ্গীতশিল্পী, পুত্র তারিফ হায়াত খান স্থাপতি এবং অপর পুত্র তানিম হায়াত খান। পরিবারের মাঁয়া কাটিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন মোবারক হোসেন খান। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

তাঁর কন্যা সঙ্গীতশিল্পী রিনাত ফৌজিয়া, বাবাকে স্মরণ করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে। পাঠক/পাঠিকাদের জন্য লেখাটি এখানে সংযুক্ত করা হলো –
মোবারক হোসেন খান একজন সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীত গবেষক এবং লেখক। তাঁর জন্মভূমি ব্রাহ্মনবাড়িয়া জেলার নবীনগর থানার শিবপুর গ্রাম। পিতা ওস্তাদ আয়েত আলি খান ছিলেন উপমহাদেশের একজন প্রসিদ্ধ সঙ্গীতশিল্পী এবং সুরবাহারবাদক। পিতৃব্য সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। মোবারক হোসেন খান ঢাকা বিশ্যবিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম এ পাশ করেন। পেশাগত জীবনে তিনি দীর্ঘদিন বেতারে চাকরী করেন (১৯৬২-১৯৯২), বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করেন (১৯৯৫-১৯৯৬) এবং নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতির পদ অলংকৃত করেন (২০০১-২০০৪)। সঙ্গীত, অনুবাদ ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে তিনি বহু গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ১২০ এর বেশি। সঙ্গীত গবেষণায় তিনি তিনি একুশে পদক (১৯৮৬), স্বাধীনতা পদক (১৯৯৪), গবেষণা সাহিত্যে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং অনুবাদে অলক্ত সাহিত্য পুরস্কারে (২০১০) ভূষিত হয়েছেন।

আমার কাছে প্রথম পরিচয়, তিনি আমার বাবা। আমার বাবা যে পরিবারে জন্মগ্রহন করেছিলেন সে পরিবার ছিলো একটি সংগীতের পরিবার। আমার পিতামহ ওস্তাদ আয়েত আলী খান ছিলেন একজন সুরসাধক, সুরবাহার শিল্পী। সুরসম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের ছোট ভাই। খুব স্বাভাবিকভাবে জন্মের পর থেকেই সুরের সাথে পরিচয় আমার বাবার। ছোটবেলায় কথা বলতে শেখার সাথে সাথেই গান গাইতে শিখে গেলেন। বাসায় বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের চর্চা হয়। হারমোনিয়াম হেকে শুরু করে সেতার, সরোদ, সুরবাহার, বেহালা, তবলা-বাঁয়া আরো কত কি! বাসার আর সব শিশুদের মত আব্বা হারমোনিয়ামটা টেনে নিয়ে গুণ গুণ করে গান গাইতে শুরু করলেন। পরিবারে একটা রেওয়াজ ছিলো, ছেলেরা যখন স্কুলে যাবার মত বড় হয় তখন লেখাপড়ার পাশাপাশি তাকে কোন একটা বাদ্যযন্ত্রে হাতেখড়ি দেওয়া হতো। আব্বাকে হাতেখড়ি দেওয়া হলো বেহালা যন্ত্রে। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে আব্বা দাদুর বাদ্যযন্ত্রের কারখানায় চলে যেতেন। সেখানে আরো কয়েকজন একসাথে শিখতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন আব্বার চাচাতো ভাই আমিনুর হোসেন খান, তিনি বাজাতেন এস্রাজ। আরেকজন ছিলেন উনার ভাগ্নে ওস্তাদ খুরশিদ খান।
সেতারে তালিম নিতেন। পরে তিনি দেশের একজন সেরা সেতারশিল্পী হয়েছিলেন। আব্বা এঁদের সাথে কয়েক বছর তালিম নিয়েছিলেন। কিন্তু পরে পড়াশোনার চাপে হোক বা অন্য কোন কারণে হোক, শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পারেননি। লেখাপড়ায় বরাবর ভালো ছিলেন। সেজন্য দাদুর দিক থেকে একটা চাপ ছিলো ভালোভাবে লেখাপড়া করার জন্য। যার ফলে ক্রমে আব্বা লেখাপড়া নিয়ে বেশী ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। সংগীত চর্চাটা সেভাবে ধরে রাখতে পারলেন না। তাঁর সংগীত চর্চাটা ছিলো অনিয়মিত। বেহালা ছেড়ে দেবার পর তিনি ‘মন্দ্রনাদ’ নামে একটা যন্ত্র বেশ কিছুদিন বাজিয়েছেন। যন্ত্রটা অনেকটা বেহালার আকার। কিন্তু অনেক বড়। আর বাজানোর ধরণটা আলাদা।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের পরামর্শা ওস্তাদ আয়েত আলী খান এই যন্ত্রটা উদ্ভাবন করেছিলেন। এরপর কিছুদিন বাজিয়েছেন ‘চন্দ্রসারং’। এই যন্ত্রটা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের পরামর্শে ওস্তাদ আয়েত আলী খান নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া তবলা বাজানো রপ্ত করেছিলেন ছোটবেলে থেকেই। ছাত্রজীবনে অনেক অনুষ্ঠানে তবলা সংগত করেছেন, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে। তাছাড়া উচ্চাঙ্গ সংগীতেও তাঁর দক্ষতা ছিলো। চাচাতো ভাই ওস্তাদ খাদেম হোসেন খান, ভাগ্নে ওস্তাদ খুরশিদ খানের মত গুণী শিল্পীদের সাথে বাজিয়েছেন তিনি। কিন্তু সবশেষে মনে ধরলো বাবার যন্ত্রটাকে। বাবাকে একদিন বললেন, আমি সুরবাহার বাজাবো। দাদুর খুব আদরের ছেলে ছিলেন আব্বা। তাঁর কোন আবদারে দাদু না বলতেন না। তিনি অনুমতি দিলেন এবং নিজের সুরবাহার যন্ত্রটা ছেলেকে বাজাতে দিলেন।

চাকুরী জীবন শুরু করা পর্যন্ত তিনি নিয়মিত সুরবাহার বাজিয়েছেন। পরবর্তী সময়ে চর্চা সেভাবে ধরে রাখা সম্ভব হয় নি। তবে বিটিভির ‘সুরলহরী’ অনুষ্ঠানে অনেকদিন পর্যন্ত সুরবাহার পরিবেশন করেছেন।
আজ ২৪ নভেম্বর, তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর আত্মার চিরশান্তির জন্য প্রার্থনা করি।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles