রবীন্দ্রনাথের গানের পেছনের গল্প…

প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে দুর নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্‌নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক

– রেজাউল করিম…

রবীন্দ্রনাথ যখন শিলাইদহ থেকে শাহজাদপুর আসেন, তখন নদীপথে চলনবিল দিয়ে আসছিলেন। তাঁর সঙ্গে একটি ছোট্ট নোট বই ছিল, নাম ছিল ‘মজুমদার পুথি’। এই নোট বইটিতে একটি কবিতা পাওয়া গিয়েছিল। যার নাম ছিল ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’। পরবর্তিতে এর শব্দের পরিবর্তন করে সুর দিয়ে গানটি গাওয়া হয়। একবার শান্তি নিকেতনে ‘ঋতুরংগ’ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ঋতুর গান হচ্ছিল। রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, সব ঋতুরই গান রয়েছে, কিন্তু হেমন্তের কোন গান নেই। তখন তিনি ‘তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা’ গানটি হেমন্ত ঋতুর গান হিসেবে গাইতে নির্দেশ দিলেন। পরবর্তিতে ‘নটরাজ’ লেখার পর বেশ কিছু হেমন্তের গান পাওয়া যায়। জোড়া সাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে অনেক গুণী সঙ্গীতজ্ঞ আসতেন, থাকতেন, গান শেখাতেন। তেমনই একজন ওস্তাদ ছিলেন যদুনাথ ভট্ট, যাকে সবাই যদুভট্ট বলেই জানেন। রবীন্দ্রনাথ যাদের কাছে গান শিখেছিলেন, তিনি তাদেরই একজন। মাত্র চার মাস ঠাকুর বাড়িতে ছিলেন। তাঁর বেশকিছু রচনা ছিল, যার দ্বারা রবীন্দ্রনাথ আকৃষ্ট হয়েছিলেন, প্রভাবিত হয়েছিলেন। যদিও আড়াল থেকে তাঁর অনেক গানই রপ্ত করে নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর ‘রুমা ঝুমা’ গানটিকে রবীন্দ্রনাথ ভেঙে রচনা করলেন ‘শূন্য হাতে ফিরি হে’ গানটি। রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি গানের পেছনে রয়েছে এ রকম একাধিক গল্প।

এভাবেই রসময় সব সংগীতের জন্ম হয় বিভিন্ন পরিবেশে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে। লালন শাহের গানের অন্যতম অনুসারী গগন হরকরাও রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে আসতেন মাঝে মাঝে। রবীন্দ্রনাথের বাউলাঙ্গের অনেক গানের মধ্যেই গগন হরকরা তথা লালনের গানের ছাপ ফুটে উঠেছে। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ যা এখন আমাদের জাতীয় সংগীত, তার মধ্যেও গগন হরকরার গান ‘আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে’ এই গানটির স্পষ্ঠ ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। ‘কতবার ভেবেছিনু আপনা ভুলিয়া’…. অথবা ‘কেন গো সে মোরে যেন করেনা বিশ্বাস’….. অথবা ‘ফুলে ফুলে ঢলে ঢলে বহে কি বা মৃদু বায়’…. এসব গানগুলিও রবীন্দ্রনাথ বিদেশী গানের সুরের অনুসরন করে সৃষ্টি করেছেন। নজরুলেরও এমন অনেক গানেও অন্য অনেক মৌলিক গানের সুরের স্পষ্ঠ ছাপ পরিলক্ষিত হয়। এখানে কথিত পঞ্চকবির গান করেন এমন একজন শিল্পী নজরুলের একটি গানকে হঠাৎ খৈয়াম গীতি বলে বসেন কারন ভাবানুবাদের সময় কবি সেটাকে খৈয়াম গীতিকাই লিখেছেন। আমি তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারিনি যে কবি লিখলেও একহাজার বছরের বিগত ওমর খৈয়ামের গীতিকবিতা হলেও সেটা এখন নজরুল সংগীতই। শত বার্ষিক হিসাবে কাব্য সাহিত্যের পরিক্রমায় তা এখন নজরুল সংগীত। আর একই কারনে রবীন্দ্রনাথের রচিত ব্রম্ম সংগীত, বাউল সংগীতগুলি সবই এখন রবীন্দ্র সংগীত। এমনকি আমাদের জাতীয় সংগীতও যথার্থ রবীন্দ্র সংগীত এবং কোনক্রমেই আর হরকরা সংগীত নয়।

সংগীতের ইতিহাসে এরকম বিবর্তন হয়েই থাকে এবং তা নিঃসন্দেহে বেশ গ্রহনীয়ও বটে। এই বিষয়টা মোটেই অনুকরন নয় বরং অনুসরন বা অনুরনণ। যা স্বতস্ফুর্ত ও সুন্দর তার অনুসরন হতেই পারে, এটা সর্বজন বিদিত সংগীতের বিবর্তন।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest Articles