asd
Sunday, October 6, 2024

বাবা বলতেন, “আগে লেখাপড়া পরে গানবাজনা” – ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান…

– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।

সঙ্গীত জগতে প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেব যদি হন আকাশ! তাহলে তাঁর ছেলেমেয়ে এবং নাতি নাতনিরা সেই আকাশের এক একটি নক্ষত্র। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের আকাশে তেমনই এক নক্ষত্র ছিলেন প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী, সেতার বাদক ও সুরকার ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান। তিনি ছিলেন ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের চার ছেলের মধ্যে সবার বড়। উনার পরে তিন ভাই-বিখ্যাত সরোদ বাদক ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান, লেখক ও সঙ্গীত গবেষক মোবারক হোসেন খান এবং স্বনামধন্য সঙ্গীত পরিচালক ও সুরকার শেখ সাদী খান।
গত ২৯শে এপ্রিল ২০২০-এ ছিল ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান এর মৃত্যুবার্ষিকী। বর্তমানে ভয়াবহ করোনা ভাইরাসের কারণে দেশে চলছে লকডাউন। তাই নিরবে নিভৃতেই চলে গেল এই দিনটি। এই দিনটিকে স্মরণে রেখে, বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে অনেক অজানা ঘটনা শেয়ার করেছেন ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান এর একমাত্র ছেলে, ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান। যে ঘটনাগুলো এই প্রথম প্রকাশ করলেন তিনি। সেই অজানা ঘটনাগুলো জানার আগে, আমরা উস্তাদ আবেদ হোসেন খান সম্পর্কে একটু জেনে নেই।

শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান (১লা এপ্রিল, ১৯২৯ – ২৯ এপ্রিল, ১৯৯৬) ছিলেন একাধারে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিল্পী, সেতারবাদক ও সুরকার। তিনি ১৯৫০ সালে রেডিওর নিজস্ব সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে যোগ দেন। বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে তার সুরাপিত গান প্রচারিত হত। তিনি চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তিনি কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন কাদির রচিত উপন্যাস ‘নদী ও নারী’ চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। তিনি ৩৬ বছর বাংলাদেশ বেতারে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন এবং ১৯৯৬ সালে মুখ্য সঙ্গীত প্রযোজক পদে থাকাকালীন সময় অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে দুই বছর, দুই বছর করে তিনি তিনবার চুত্তিভিত্তিতে এই দায়িত্ব পালন করেন। ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান এবং সঙ্গীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান মিলে ৩ খণ্ডে রচিত করেন ‘সুর-লহরী’গ্রন্থটি। এই গ্রন্থটির প্রথম দুই খণ্ডে নাম ছিল সঙ্গীতজ্ঞ মোবারক হোসেন খান সাহেবের এবং তৃতীয় খণ্ডটিতে নাম ছিল ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান সাহেবের। এই গ্রন্থটি সঙ্গীত বিষয়ের পাঠ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। তিনি ঢাকা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে অন্যতম। ১৯৭৩ সালে তিনি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ‘ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সঙ্গীত নিকেতন’ নামক সঙ্গীত একাডেমী প্রতিষ্ঠা করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। সঙ্গীতে অবদানের জন্য তিনি ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ লাভ করেন।

এবার জানা যাক, শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান এর স্মৃতিচারণ থেকে তাঁর বাবার কিছু অজানা ঘটনা। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন তাঁর বাবাকে অনুধাবন করেন এভাবে-একজন রাশভারী বাবা, একজন ধৈর্য্যশীল দক্ষ শিক্ষক এবং একজন প্রিয় বন্ধু। তাঁরই নিজস্ব ধারাভাষ্যের আঙ্গিকে সাজানো হল ধারাবাহিকভাবে এই সাক্ষাৎকার। বাবার সাথে ছোটবেলাটা কেমন ছিল –

– বাবাকে অনেক ভয় পেতাম। তিনি কখনোই গায়ে হাত তুলেনি বা সেই সুযোগও পাননি! কারণ বাসায় যারা ছিলাম, আমিসহ প্রত্যেকেই বাবার সাথে চোখ তুলে কথা বলিনি। বাবার চোখের দিকে তাকালেই ভয় পেয়ে যেতাম কারণ সে কোনো অন্যায় দেখলে বড় বড় চোখ করে তাকাতেন। সেই চাহুনি দেখেই ভয় পেয়ে যেতাম। তাছাড়া বাবার সাথে আনন্দের একটা ঘটনা এখনো মনে পড়ে তা হল, কমলাপুর রেলস্টেশনের কাছে ‘টিক্কা পাড়া’ নামক এক জায়গায় প্রত্যেক ঈদের পরেরদিন মেলা হত। আমার বাবা, প্রত্যেক ঈদের পরেরদিন সেই মেলায় নিয়ে যেত। সেই দিনগুলোর কথা খুব মনে হয়।

– বাবার উৎসাহে কি গানবাজনার দিকে আসা –

– বাবা প্রথম দিকে গানবাজনার শেখার প্রতি কোনো উৎসাহ দেননি। সত্যি কথা বলতে! আমাকে সরোদের যন্ত্রটি ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, আমার দাদা। আমার দাদা সর্বশেষ একটা যন্ত্র বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিয়ে বল্লেন, “দাদু, এটাই আমার তৈরি শেষ যন্ত্র আর হয়তো কাউকে দিতে পারবোনা!” এরপর তিনি আর কারো হাতে যন্ত্রটি তুলে দিতে পারেননি কারণ তিনি একসময় মারা গেলেন। দাদা যখন যন্ত্রটি আমার হাতে তুলে দেন তখন আমার বয়স ছিল সাত বছর। বাবা তখন দাদাকে বলেছিলেন, এখন যদি গানবাজনা শুরু করে তাহলেতো পড়ালেখায় ক্ষতি হবে! তখন দাদা বাবাকে বল্লেন, নাহ! ক্ষতি হবে না। আমার বাবা সবসময়ই লেখাপড়াটাকে গুরুত্ব দিতেন বেশী। তাই তিনি বলতেন, আগে লেখাপড়া পরে গানবাজনা। এভাবেই চলছিল! বাবার সাথে আমার অনেক দূরত্ব ছিল কারণ তাঁকে অনেক ভয় পেতাম। তাই তাঁর কাছে অত ঘেঁষতামনা। তবে এই দূরত্বটা ছিল পড়ালেখার কারণেও বলতে পারেন। কারণ বাবা আমাকে বলেছিল, “যেদিন তুমি মাস্টার্স ডিগ্রী কমপ্লিট করবে, সেদিন থেকে আমি তোমার সাথে সর্ববিষয়ে ফ্রি হয়ে যাব! আমার আর কিছুই চাওয়ার থাকবেনা তোমার কাছে।” সেটা ছিল একদম সত্যি কথা! যেদিন আমার মাস্টার্স ডিগ্রী কমপ্লিট হয়ে গেল, তারপরের দিন সকালে আমি আর আমার বাবা যাব অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সে বাজাতে। তো ঐ দিন থেকেই দেখলাম যে, আমার বাবার সাথে আমার সম্পর্কটা বন্ধুর মত হয়ে গেল! সব বিষয়ে বাবার সাথে কথা বলতাম। বাবাও আমাকে ডেকে নিয়ে কথা বলতেন। বাবার শর্তটা আমি পুরণ করেছি মাস্টার্স ডিগ্রী কমপ্লিট করে, বাবাও তাঁর দেয়া কথা রেখেছিলেন। তখন থেকেই দুজনে ফ্রি হয়ে গেলাম আর কোনো বাঁধা ছিল না। আমাদের সম্পর্কটা এগিয়ে যেতে থাকল। তারপর ধরেন বাবার সাথে যত জায়গায় গিয়েছি যেমন বিদেশে- ফ্রান্স, ইংলেন্ড, আমেরিকাসহ যেখানে যেখানে গিয়েছি, আমার আর আমার বাবার সম্পর্কটা ছিল বন্ধুর মত। এই কথাটি আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।

– আপনার বাবার সাথে আপনার কোনো মান অভিমানের কথা কি মনে পড়ে –

– একবারই বাবার সাথে অনেক রাগ করেছিলাম। কেন করেছিলাম তা অবশ্য এখন মনে করতে পারছিনা। রাগ করার পর আমি আর বাসায় ভাত খাই না। না খেয়ে বাসার থেকে বের হয়ে যাই। বোনদের বাসায় গিয়ে ভাত খাই। মা আমাকে দু’তিনবার বলেছেন, কতদিন চলবে এসব ? এবার বন্ধ কর। বাবা সেই কথা শুনে, আমাকে ডাক দিয়ে বলেছিলেন, তুমি কি খেতে বসবা! না আমিও খাওয়া বন্ধ করে দিব ? তখন বাবার কথায়, বাবার সাথে খেতে বসলাম।

– খাবার দাবারের ব্যাপারে উনি কিরকম ছিলেন –

– খাবার দাবারের ব্যাপারে উনার বাধ্যবাধকতা ছিল।আমার মনে আছে,পাকিস্তান আমলে মুক্তি যুদ্ধের আগে তাঁর আলসার ধরা পড়েছিল। আলসার ধরার পর উনি জার্মানি থেকে একটা ওষুধ আনিয়েছিল কারণ তখন এখানে আলসারের ওষুধ পাওয়া যেত না। তারপর থেকে তিনি বাকী জীবন জাউভাত আর মশলা ছাড়া তরকারি খেতেন। এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তাইই খেয়ে গেছেন। উনার ডায়বেটিস ছিলনা কিন্তু তারপরেও মিষ্টি তেমন একটা খেতেন না। সেই কারণে বিয়েসাদীতে দাওয়াত করলে তিনি তেমন একটা যেতেন না। রিচফুড খাওয়া হবে সেই কারণে। কখনো যদি যেতে হত তখন দু’একটুকরা মাংস খেতেন। খাবার দাবার অনেক মেইনটেইন করে চলতেন। উনি সবসময় বলতেন, দেখ! তোমার যদি অফুরন্ত থাকেও তুমি কিন্তু ঐ অফুরন্ত একবারে শেষ কইরনা। এরকম একটা পর্যায়ে চলবা, তুমি ধনীও না, গরীবও না। মাঝারি একটা পর্যায়ে চলবা, দেখবা সারাটি জীবন তুমি একইরকম চলতে পারবা। সত্যি কথা বলতে কি জানেন, আমি শুরুটা যেভাবে করেছি আল্লাহ্‌ কিন্তু আমাকে একইভাবে রেখেছেন। এখনও আমি কারো কাছ থেকে দশ টাকাও ধার করিনি। এমনকি আমার বাবার কাছ থেকেও চাইনি। সব সময় বাবা বলতেন, তোমার ষ্ট্যাণ্ডার্ড যেন ঠিক থাকে। এক লাফে উপরে উঠতে যেওনা, পড়ে গেলে কষ্ট পাবে। উঠার দরকার নেই, যেখানে আছো ভালো আছো। এমনই মানুষ ছিলেন, আমার বাবা।

– শিক্ষক হিসেবে আপনার বাবা কেমন ছিলেন –

– কোনো কিছু শেখানোর ব্যাপারে বাবা সাংঘাতিক সিরিয়াস ছিলেন কারণ উনি ঢাকার স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডের সাথে জড়িত ছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জড়িত ছিলেন এবং ঢাকা সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়ের একজন প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। শেখানোর ব্যাপারে অসিম ধৈর্য্য ছিল তাঁর। যখন শেখাতে বসতেন তখন একটা জিনিস যদি না পারতাম তাহলে উনি একবার, দুইবার, তিনবার এমনকি সাত আটবার দেখাতেন। যদি দেখতেন এরপরেও হচ্ছেনা! তখন উঠে চলে যেতেন আর যাওয়ার সময় বলতেন, “উঠে যাও,বাইরে ঘুরে আসো”। বাইরে ঘুরে এলে আবার শেখাতে বসতেন। এতটা ধৈর্য্য ছিল তাঁর। শেখানোর সময় বাবার একটা জিনিস সবসময় দেখেছি, উনি কখনো বিরক্ত হতেন না। উনি যখনই শেখাতেন তখন খুব ধৈর্য্য সহকারে শেখাতেন। কখনই বিরক্ত হতেন না। শুধু মাত্র আমার বেলায় না! অন্যান্য স্টুডেন্টের বেলায় তিনি এমনই ছিলেন। অসীম ধৈর্যশীল একজন মানুষ ছিলেন তিনি।
বাবার মত আমার এত ধৈর্য ছিলনা তখন। বাবার ধৈর্য্যশীলতার একটি ঘটনা বললেই বুঝতে পারবেন, তাঁর কত ধৈর্য ছিল! একটা সময় অল ইন্ডিয়া রেডিও কনফারেন্সে বাজাতে গিয়েছি। স্টেজে যাওয়ার আগে দুজনে যন্ত্র মিলাচ্ছি এমন সময় উনি বল্লেন, হয় নাই। আবার মিলাচ্ছি, উনি আবারো বল্লেন, হয় নাই। এইরকম সাত আটবার হয়েছে। তারপর আমার মেজাজই খারাপ হয়ে গেছে! আমি আমার যন্ত্রটা রেখে উঠে দাঁড়িয়ে গিয়েছি। তখন বাবা আমাকে বললেন, শোন, বসো। আমার বাবা (ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেব) একটা কথা বলতেন, “যদি কাঁদো, কান্নাটা সুরে কাইন্দো। তাহলে শুনতে ভালো লাগবে!” অতএব তুমি যদি যন্ত্রটা বেসুরো বাজাও! যতই ভালো বাজাও, এটা শুনতে ভালো লাগবেনা। সেইজন্যে আমি তোমাকে বার বার বলতেছি, যন্ত্রটা ভালো করে মিলাও”। সম্ভবতঃ এই অনুষ্ঠানটি কাশ্মীরে ছিল। অল ইন্ডিয়া রেডিও কনফারেন্সের তখন একটা চেইন অনুষ্ঠান হত যেমন- কলকাতা, মাদ্রাজ, বোম্বে, দিল্লী, শ্রীনগর এবং কাশ্মীরে এসে শেষ হত।

– আপনার বাবার সাথে, আপনার কোনো মজার ঘটনা যদি বলতেন –

– দুটো মজার ঘটনা এখন মনে পড়ছে। কানাডাতে এক অনুষ্ঠানে আমি আর আমার বাবা বাজাতে বসেছি, যখন খুব ক্লাইম্যাক্সে তখন আমার যন্ত্র গেল ছিড়ে! আমি আর আমার বাবা দুজনে দুজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছি। আমার বাবা আস্তে করে বলে শেষ করব ? আমি বলি না, তার লাগাচ্ছি। বাবা বলে ঠিক আছে। পর পর বাবা কয়েকবার বলছে, শেষ করব ? আর আমি মাথা নেড়ে বলছি না। তারপর তার লাগিয়ে অনুষ্ঠানটি শেষ করলাম। আমার কাছে খুব মজা লেগেছে ব্যাপারটা, বাবা বলছে শেষ করব ? আর আমি মাথা নেড়ে না বলছি কিন্তু দর্শকসারি থেকে কেউই বুঝতে পারেনি।
আরেকদিন প্যারিসে। ঐ দিন কি একটা কাজ ছিল। আমরা কাজ শেষ করে দুপুর বেলা খাওয়ার জন্য এক ফরাসী রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম কিন্তু সমস্যা হল, ওখানে ইংরেজিতে কেউ কথা বলে না। সবাই ফরাসী ভাষায় কথা বলতেছিল। এখন কি খাবো চিন্তা করতেছি, এমন সময় বাবা বল্লেন, কি খাবা ? কি খাবো ? ওদের তো কিছুই বুঝাতে পারবো না! যাইহোক, বাবা কোনরকমে অনেকক্ষণ ধরে ওয়েটারকে বুঝিয়ে বলল, বিফ স্টেক এর কথা। ওয়েটার কি বুঝল কে জানে! সে চলে গিয়ে কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে ফিরে আসলো। খাবার নিয়ে আসার পর দেখলাম, যে বিফ স্টেক বানিয়ে দিয়েছে, তার মধ্যে ছুরি আর ঢুকে না, হা হা হা। তখন বাবা আমাকে বললেন, বাবারে! এটা খাওয়ার দরকার নাই। এটা খাইলে তোমার পেটে সমস্যা হবে। চল, এখান থেকে চলে যাই। অন্য কিছু খাই। এরকম অনেক মজার ঘটনা ঘটেছে।

– অনুষ্ঠান করতে গিয়ে অবাক কোনো কান্ড মনে আছে কি –

– হ্যাঁ, একবার ফ্রান্সে গেলাম বাজাতে। প্যারিসে অনুষ্ঠানটির আয়োজন করেছিল আঁলিয়াস ফ্রঁসেস হেড অফিস থেকে। সাতদিন একনাগারে একই স্টেজে অনুষ্ঠানটি হল। প্রত্যেকদিন রাত্রে এগারটা থেকে তিনটা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলতো। প্রথম যেদিন তাঁরা বল্ল, এগারটা থেকে রাত সাড়ে তিনটা পর্যন্ত অনুষ্ঠান, তখন আমরা ভাবলাম! এত রাত করে অনুষ্ঠান দেখতে কে আসবে ? অবাক কান্ড! অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগে মিলনায়তনে কোনো লোক নাই কিন্তু প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার যেই বেল বাজলো, সাথে সাথে পুরো হলরুম ভরে গেল। আবার যখন হাফ এন আওয়ারের ব্রেক হত, তখন ব্রেক হওয়ার পর কাউকে হলে দেখা যেত না। আবার বেল বাজানো হলে মিলনায়তন পুরোপুরি ভরে যেত লোকজনে। এটা আমার কাছে খুব অবাক লেগেছে। সবসময় জেনে এসেছি, ফ্রান্স হোল আর্টকালচারের জন্য বিখ্যাত। আর আমি তা চাক্ষুষ দেখে এসেছি। ওখানে প্রচুর পেইন্টিং গ্যালারি। এমনকি রাস্তার দুপাশে পেইন্টিং গ্যালারি দেখেছি।

– তাই হয়তো ভাবতে পারেননি, আপনাদের বাদ্যযন্ত্র বাজানো তাঁরা এভাবে নিবে! –

– হ্যাঁ, সেটাই। আমি আরও অবাক হয়েছি, সাতদিন ধরে অনুষ্ঠানে শুধু আমি আর আমার বাবা বাজিয়েছি। অন্য কোনো শিল্পী ছিল না। ভাবতে পারেন! প্রত্যেকদিন তাঁরা তিন থেকে চার ঘণ্টা আমাদের বাজানো শুনেছে। অবাক ব্যাপার!

– এরকম কোনো অপ্রতিকর অভিজ্ঞতা কি আছে, যা আপনার বাবার জীবনে ঘটেছে –

– হ্যাঁ, আমরা ফ্রান্সে অনুষ্ঠান শেষ করে চলে যাই লন্ডনে। ওখানে একটি বড় অনুষ্ঠান ছিল। যাইহোক, আমরা অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে তবলাবাদক ইউসুফ আলী খান বাবাকে বল্লেন (উনি আমার বাবাকে মামা ডাকতেন), মামা আপনার মাথায় আজকে কলপ লাগিয়ে দিব। বাবা বললেন, বাবারে! আমি মাথায় কলপ লাগাইনা। তারপরেও সে আবদার করে বলেন, না আজকে আমি আপনার মাথায় কলপ দিবই দিব। আমার বাবা উনি কিছু বল্লে, মানা করতে পারতেন না। তাই সে তার কথামত কলপ লাগিয়ে দিল। বিশ্বাস করবেন না! পুরো অনুষ্ঠান শেষ করে যখন আমরা হোটেলে ফিরলাম, তখন দেখলাম বাবার মাথাটা পুরোটাই ফুলে গেল! ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। এই অবস্থা দেখে আরও একদিন থাকলাম এইজন্যে যে, কিছু করা যায় কিনা! দেখলাম, এটা বেড়েই যাচ্ছে। এদিকে আবার আমাদের প্যারিস হয়ে ঢাকায় ফিরতে হবে। তখন ফ্লাইটে প্যারিসে চলে গেলাম। প্যারিসে যাওয়ার পর আমাদের দেশের যে রাষ্ট্রদূত ছিলেন তাঁকে সব জানালাম। আমাদের দেশের রাষ্ট্রদূতের যে ডাক্তার ছিল, সে তাঁকে খবর দিলেন। ডাক্তার ছিলেন ফ্রান্সেরই নাগরিক। সেই ডাক্তার এসে বাবাকে দেখে দুটো ওষুধ দিল। একটা দিয়ে গোসল করবে আরেকটি মাথায় লাগাবে। দুঃখের বিষয়! ওই ওষুধগুলো ব্যবহার করার পর মাথায় ফোস্কা পরে গেল। মাথা দিয়ে পানি পড়া শুরু করল। এরপর আমরা আর দেরি না করে, আমাদের দেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় একটা ছোট অনুষ্ঠান ছিল। ঐটা শেষ করেই পরের ফ্লাইটেই সোজা ঢাকায় ব্যাক করি। ঢাকায় আসার পর এয়ারপোর্ট থেকেই আমার বড় বোনের হাসব্যান্ড সরাসরি নিয়ে গেলেন মালিবাগে এক ডাক্তারের কাছে। ওই ডাক্তার দেখে বেশি কিছু না!
শুধু এভিল ট্যাবলেট দিলেন। বাবার এলার্জি হয়েছিল। বিশ্বাস করবেন না! ঐ ওষুধ খাওয়ার পর তিনদিনের মধ্যে বাবা সুস্থ হয়ে গেলেন। আমি দেখলাম, ফরাসি ডাক্তারের চেয়ে বাংলাদেশের এমবিবিএস ডাক্তার অনেক ভালো ট্রিটমেন্ট করতে পারে।

– আপনি বিদেশে অবস্থান করেননি কেন ? ওখানে তো আমাদের দেশের অনেকেই থেকে গিয়েছেন –

– ১৯৮৫ সালে যখন দেশ ছেড়ে বিদেশের পথে পা রাখলাম তখন প্রথমেই গেলাম ইংল্যান্ডে। ইংল্যান্ডে প্রায় এক দুইমাস থাকলাম। তারপর আমি ইমিগ্রেশনের জন্য এপ্লাই করলাম। তখন ইমিগ্রেশন খুব সহজে পাওয়া যেত। এপ্লাই করার পর ইমিগ্রেশন মিনিস্টারের বা হোম মিনিস্টার যে ছিলেন তাঁর কাছে ফাইলপত্র চলে গেল। হঠাৎ করে একদিন লন্ডনের একটা ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই তখন সাদাচামড়ার এক ছেলের কাছে ঠিকানাটি কোথায় জানতে চাইলে সে আমাকে ব্লাকনিগার বলে গালি দিচ্ছিল। তা আমার মনে খুব লেগেছিল। আমার খারাপ লাগার পর আমি ইউসুফকে বল্লাম, আমি আর এইদেশে থাকবনা। ইউসুফ বল্ল, দাদা বুকে পাত্থর বাইন্ধা থাইকা যাও।
আমি বল্লাম, নারে ভাই! নিজেকে ছোট করে থাকতে রাজি নই। আমি পরের দিন হোম মিনিস্টারের ফোন নম্বর যোগার করে তাঁর পিএসকে কল করে বললাম, হোম মিনিস্টারের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দিতে। তখন সে বল্ল, কেন ? আমি বল্লাম,তাঁর সাথে দেখা করতে চাই। সে বল্ল, দেখা করার দরকার কি ? কথা বল! তখন ফোনে হোম মিনিস্টারকে বললাম, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্টে এ্যানিমোর। আই ওয়ান্ট টু লিভ দিস কান্ট্রি। সে আমাকে বল্ল, তুমি কেন চলে যেতে চাইছো ? তারপর বল্ল,তোমার প্রোফেশন কি ? আমি বল্লাম, মিউজিশিয়ান। তুমি তাহলে চলে যেতে চাইছো কেন ? সবাইতো ইংল্যান্ডে থাকতে চায়। আমি বললাম না, আমি থাকব না, আমি চলে যাব। তুমি আমার পাসপোর্ট ফেরত দেও কাইন্ডলি! সে আমাকে অনেক বুঝাইল। তুমি ট্রাই কর, তুমি থাকো। এখানে তোমার ফিউচার আছে। আমি সোজাসুজি বল্লাম, না আমি থাকবনা। তখন সে বল্ল, ঠিক আছে। আমার পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা করল। আমি পাসপোর্ট পাওয়ার পরে বিভিন্ন দেশে ঘুরাঘুরি শুরু করলাম। আমি প্রথমে গেলাম ফ্রান্সে, ফ্রান্স থেকে সুইডেনে, জার্মানি, ইটালি করে সবশেষে গেলাম আমেরিকায়। আমেরিকাতে ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ কলেজ অফ মিউজিকে জয়েন করলাম। ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ সাহেবের সাথে প্রায় একমাস কাজ করে দেশে চলে এসেছি। খাঁ সাহেব অনেক অনুরোধ করেছিলেন উনার ওখানে থেকে তাঁর কিছু স্টুডেন্টকে শেখানোর জন্য।
যাই হোক, আমি তো আর থাকি নাই। দেশের বাইরে লন্ডনে ঐ তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে আমি আর কোনো দেশেই থাকার চেস্টা করি নাই। তাছাড়া বাবা মা দুজনেই চাননি আমি বিদেশে থাকি। তাই সবসময় আমার বাবা আমাকে চলে আসার জন্য বলতেন। দেশে এসে জানতে পারি। আমি যখন ওখান থেকে মায়ের সাথে কথা বলেছি, মা তখন অনেক কান্নাকাটি করেছেন। আর আমার বাবা! আমার বাবা আমার জন্য অফিসে যাওয়া পর্যন্ত ছেড়ে দিয়েছিল।

– আপনিতো তাঁদের একটি মাত্র ছেলে। তাই হয়তো আপনার প্রতি তাঁদের কেয়ারিংটা বেশি ছিল! –

– সাংঘাতিকভাবে কেয়ারিং ছিলেন! কিন্তু তা বুঝতে দিতেন না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার কোনদিনই বুঝতে দেন নাই। তবে আমি উপলব্ধি করতে পারতাম। একটি ঘটনা বলি, আমার আর আমার বাবার একটি অনুষ্ঠান হবে আমেরিকার বোস্টনে। এদিকে বাবার আবার অনুষ্ঠান ছিল মিসিগানে। আমাদের অনুষ্ঠানের দেড়মাস আগে। তাই বাবা মাকে নিয়ে আগেই চলে যান। বাবা, মিসিগান, নিউইয়র্কসহ আরও অনেক জায়গায় অনুষ্ঠান করে মাকে নিয়ে বোস্টনে আসলেন। আর আমি নিউইয়র্ক থেকে বোস্টনে গেলাম। দীর্ঘ দেড়মাস পর আমার বাবা মায়ের সাথে হোটেলে দেখা হল। এত বড় হয়ে গেছি। হোটেলে আলাদা রুমে একা আছি। আমার বাবা বার বার রুমে এসে আমাকে দেখে যেতেন। আমার মাও তাঁকে পাঠাতেন। আমার বাবা এসে খবর নিতেন, ঠিক আছি কিনা! ভয় পাই কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি, হা হা হা। এই ব্যাপার গুলো সবসময়ই করতেন।

– এবার একটি ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি কিছু মনে করবেন না, প্লিজ! আপনার বিয়েটা কি আপনার বাবা মায়ের পছন্দে হয়েছিল –

– বলতে পারেন তাঁদের পছন্দেই হয়েছে। তবে আমি আগের থেকেই চিনতাম কিন্তু বিয়ে করব, সেইরকম চিন্তা ছিলনা। আমার বোন জামাই, মনোয়ার ভাই, উনি ছিলেন আসল ঘটক। উনিই মা বাবাকে আমার এই বিয়ের ব্যাপারে বলেছেন। বাবা, তাঁকে বলেছেন, দেখো! তারপর কথা বলতে বলতে একদিন বাবা বললেন, ঠিক আছে। আসলে আমি যখন বিদেশে চলে গিয়েছিলাম, তখন তাঁরা আমাকে রীতিমত অনুরোধ করে নিয়ে এসেছিল ওখান থেকে। তাই তাঁরা খুব ভয় পেয়েছিল, আমি যদি আবার বিদেশে চলে যাই এবং সেখানে বিয়ে করে থেকে যাই। এর কারণ আমার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু, বিদেশে গিয়ে বিয়ে করে আর দেশে ফিরে আসেনি। তাঁর বাবা মা অনেক কান্নাকাটি করেছেন। সেজন্যে শেষ পর্যন্ত বাবা আমাকে এটাও বলেছিলেন, তুমি হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ যাকে খুশি বিয়ে করতে পার, আমার কোনো আপত্তি নাই। তারপর বার বার আমার কাছে এই বিয়ে নিয়ে কথা বলেছে। যখন দেখেছে আমার কোনো আপত্তি নাই তখন এই বিয়ে ফাইনাল করেছে। তাই বলতে পারেন, পারিবারিকভাবেই বিয়েটা হয়েছে।

– আপনার কাছ থেকে পাওয়া, আপনার বাবার সবচেয়ে সুখের দিন কোনটি ছিল –

– সেই দিনটি ছিল, সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ লাভ করি যেদিন। ঐ দিন বাবা আমাকে ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন আর বলছিলেন, “এটাই আমার জীবনের সার্থকতা! আমি যে দেখে যেতে পারলাম, তোমার এই সম্মাননা। আর কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, এটা আমার বড় পাওনা। এখন আর আমার কোনো দুঃখ নাই। আমি যা যা আশা করেছিলাম, তা সবই তোমার কাছ থেকে আমি পেয়েছি”। বাবার চোখে সেদিন আমি যে আনন্দ দেখেছি, তা আমিও কখনোই ভুলবো না।

– আপনার বাবার জন্মদিন এবং মৃত্যুদিন একই মাসে! খুবই অবাক কান্ড! –

– আসলেই খুব অবাক কান্ড! জন্ম হয়েছিল ১লা এপ্রিল, ১৯২৯সালে এবং মৃত্যু হয়েছে ২৯ এপ্রিল, ১৯৯৬ সালে।

– সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে আপনার বাবার জন্য রইল অসীম শ্রদ্ধা। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন এবং তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি। ভাইয়া,আপনার ও আপনার বাবার অজানা এতগুলো ঘটনা জানানোর জন্য সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে আপনার জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা ও কৃতজ্ঞতা। ভালো থাকবেন, সাবধানে থাকবেন এবং সবাইকে নিয়ে বাড়িতেই থাকবেন।

– সঙ্গীতাঙ্গন এর জন্য আমার পক্ষ থেকে রইল, অনেক অনেক শুভকামনা।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles