Wednesday, April 24, 2024

গানের পিছনের গল্প – সোয়া চাঁন পাখি – বারী সিদ্দিকী…

প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে দুর নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্‌নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক

– তথ্য সংগ্রহে মীর শাহ্‌নেওয়াজ…

শিল্পীঃ বারী সিদ্দিকী
সুরকারঃ ওস্তাদ উকিল মুন্সি
গীতিকারঃ ওস্তাদ উকিল মুন্সি
ছবিঃ শ্রাবণ মেঘের দিন

গীতিকবি ও বাউল গায়ক সাধক উকিল মুন্সীর জন্ম ১৮৮৫ সালের ১১ জুন। মৃত্যু ১৯৭৮ সালে। পিতার বাড়ি নেত্রকোনার খালিয়াজুরী উপজেলার নূরপুর বোয়ালী গ্রামে।

প্রায় হাজারখানিক গান রচনা করলেও সারাদেশে উকিল মুন্সী তিনটি গান দিয়ে পরিচিত।

১) আমার গায়ে যত দুঃখ সয়
২) আষাঢ় মাইসা ভাসা পানিরে এবং
৩) সোয়া চাঁন পাখি।

এই তিনটি গান ব্যবহৃত হয়েছিল হুমায়ূন আহমেদের চলচ্চিত্র ‘শ্রাবণ মেঘের দিন’-এ। গায়ক ছিলেন বারী সিদ্দিকী, তার বাড়িও নেত্রকোনা। তিনটি গানই রোমান্টিকতা ও বিরহী ভারে শ্রোতাদের আপ্লুত করে।

‘সোয়া চাঁন পাখি’ এর অর্থ হল শুয়ে আছে আমার চান পাখি। গানটা শুনলেই মনের ভিতরটা হুহু করে কেঁদে উঠে। তবে আমরা কি জানি যে এই গানটির পেছনে রয়েছে এক বেদনাময় ইতিহাস।

স্ত্রীর সাথে উকিল মুন্সীর সম্পর্ক নিয়ে একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয়ে থাকে সেই প্রেক্ষাপটে রচিত হয়েছে তার ‘সোয়া চাঁন পাখি’ শিরোনামের অতি জনপ্রিয় এই গানটি। গায়ক বারী সিদ্দীকীর বরাতে জানা যায় মৃত বউয়ের শিয়রে বসে উকিল মুন্সী এই গানটি রচনা করেন। উকিল মুন্সি তার স্ত্রীকে অসুস্থ অবস্থায় রেখে এক গানের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন। অনুষ্ঠান চলাকালীন সময়ে খবর এলো যে তার স্ত্রী আর এ পৃথিবীতে নেই। উনি যে জায়গায় অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন সে জায়গাটি ছিলো তার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। যার ফলে ফিরতে কয়েকদিন সময় লেগে গেলো। ততদিনে তার স্ত্রীকে কবর দেয়া হয়ে গিয়েছে। তিনি তার স্ত্রীকে শেষ বারের মতোও দেখতে পারেন নি। তখন তিনি তার স্ত্রীর কবরের পাশে বসে গানটি গেয়েছিলেন। উকিলের গানের সাথে সাথে শিষ্য রশিদ উদ্দিন তাৎক্ষনিক একই সুরে গান গেয়ে উকিলকে সান্ত্বনা দেন। বারী সিদ্দীকী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে এই গানের দুটো অংশই গেয়ে থাকেন। আবার কিছু বইয়ে লেখা আছে এই গানটি উকিলের নয়, রশিদ উদ্দিনের।

কিন্তু উকিল মুন্সীর ছাত্রী ও ছেলে আবদুস সাত্তারের দ্বিতীয় স্ত্রী রহিমা খাতুন এই গানের রোমান্টিক তত্ত্বটি নাকচ করে দিয়ে আধ্যাত্মিকতার একটি নতুন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বললেন, এইসব বানানো কথা। উকিল মুন্সী এই গান বেঁধেছিলেন তার পীর মুর্শীদকে নিয়ে। পীরের বাড়ি থেকে ফিরে এসে উকিল এই কথাটা তাকে জানান। উকিলের অনেক গানের সাথে আছে তার পীর মুর্শীদের গভীরতর সম্পর্ক।

রহিমা খাতুনের জবানে, উকিলের পীর ছিলেন হবিগঞ্জের রিচি-র মোজাফফর মিয়া। যিনি সাহেব বাড়ীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) নামে পরিচিত। এই দরবার শরীফ হবিগঞ্জ শহরের কাছাকাছি, জাহাঙ্গীর দরবার শরীফ নামে পরিচিত। মোজাফফর আহমেদ হযরত শাহজালাল (রঃ) এর তিনশ ষাট জন শিষ্যের একজন সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সিলসিলার উত্তরসূরী। উকিল মুন্সী মোজাফফর আহম্মেদের পাঁচ খলিফার একজন। উকিলেরও কয়েকজন মুরিদ ছিলো।

পীরের নির্দেশেই উকিল তার গানে একতারা ছাড়া অন্য কোন বাদ্য যন্ত্র ব্যবহার করেননি। পীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) এর জলসায় নিয়মিত অংশগ্রহণ ছাড়াও বারহাট্টার চন্দ্রপুরের পীর মোফাজল হক চিশতী, ঝিমটির চান মিয়া শাহ ফকির, পূর্বধলার লেটিরকান্দা পাগলা বাড়িসহ বিভিন্ন পীর-ফকিরগণ ছিলেন তার গানের মুগ্ধ শ্রোতা। উকিল মুন্সীও তাঁদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেন।

পীর মোজাফফর আহম্মদ (রঃ) উকিলের গান খুবই পছন্দ করতেন। এমনকি তার মৃত্যুর কিছু আগেও উকিলের গান গেয়ে যান। উকিলের সাথে পীরের সম্পর্ক বোঝাতে গিয়ে উকিল মুন্সীর ছোট মেয়ে রাজিয়া খাতুন একটা কাহিনী বলেন। একবার পীরের দরগায় ওরস ছিলো। শরীর খারাপ থাকায় উকিল যেতে পারেন নাই। পীর সাহেব বেজায় রেগে গেলেন। ভক্তদের বললেন- উকিল মুন্সী আসলে তাকে ভিতরে ঢুকতে দিবা না। তার জন্য ওরছটাই নষ্ট হলো। কয়েকদিন পর উকিল মুন্সী পীরের সাথে দেখা করতে গেলেন। তিনি পীরের ঘরে ঢোকার আগেই গানে টান দেন- নিঃদুনিয়ার ধনরেৃ। এই গান শুনে পীর ঘর থেকে বের হয়ে উকিলকে হাতে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভক্তরা অনুযোগ করে বলল, আমাদের বললেন তারে যেন ঘরে উঠতে না দিই। আর এখন আপনি নিজেই তপস্যা ভেঙ্গে তারে নিয়ে যেতে আসলেন। পীর সাহেব কিছুই বললেন না।

সেই মাশুক পীর যখন মারা যান, আশেক উকিল মুন্সী তার শিয়রে বসা। পীর নিজ কন্ঠে উকিলের- “আতর গোলাপ ছিটাইয়া শুইয়া রইলাম বিছানায়, বন্ধু তোমারি আশায়…” গানটি গাইলেন। তারপর সবাইকে বিদায় জানিয়ে নিজেকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেন। চাদর ঢাকা অবস্থায় তিনি মারা যান।

এই ঘটনা উকিলের মনে বড় প্রভাব ফেলে। সেখানে উকিল “সোয়াচাঁন পাখি” গানটি রচনা করেন। এভাবে একটি গানের মানে যখন পরিবর্তন হয়ে যায়- তখন অন্য গানগুলো নিয়েও কথা চলে আসে। এভাবে উকিলের গানের রোমান্টিকতা ও বিরহের আরেকটা প্যার্টান আমাদের গোচর হয়। এর সাথে বাহ্যকৃত্যের যোগ আছে। সত্যকে জানা ও নিজেকে মাসুম করে তোলার বিষয়টি এই গুরু-শিষ্য পরম্পরার সাথে যুক্ত। এছাড়া এটা নিছক দু’জন ব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক নয়, পরমের সাথে সম্পর্কের যোগসুত্র হলো এই দুনিয়াবী সম্পর্ক।

“সোয়াচাঁন পাখি, আমার সোয়াচাঁন পাখি।
আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছ নাকি?

তুমি আমি জনম ভরা, ছিলাম মাখামাখি।
আজি কেন হইলে নীরব, মেলো দুটি আখিরে রে, পাখি।
আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছ নাকি?

বুলবুলি আর তোতা ময়না, কত নামে ডাকি,
তোরে কত নামে ডাকি।
শিকল কেটে চলে গেলে রে, শিকল কেটে চলে গেলে,
কারে লইয়া থাকিরে পাখি।
আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছ নাকি?

তোমার আমার এই পিরীতি, চন্দ্র, সুর্য সাক্ষী।
হঠাৎ করে চলে গেলে, বুঝলাম না চালাকি।
আমি ডাকিতাছি, তুমি ঘুমাইছো নাকি।”

অলংকরন – গোলাম সাকলাইন…

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles