– মোশারফ হোসেন মুন্না।
আজ তোমার জন্মদিন, কি দেবো বলো উপহার
হৃদয় ছাড়া দেবার মতো, কিছু তো নেই আমার
তাই জন্মদিনে তোমার, হৃদয় দিলাম উপহার
আজ তোমার জন্মদিন, এ গান দিলাম উপহার…,
প্রিয় ফুলের তোড়া পাবে,
শুভেচ্ছা ও উপহার দেবে রঙিন খামে
ফুল সে তো ঝড়ে যাবে,
রাত শেষে উপহার গুলো পুরনো হবে
আতশবাঁজির রঙিন আলো নিভে গেলেই আঁধার
তাই জন্মদিনে তোমার, হৃদয় দিলাম উপহার
আজ তোমার জন্মদিন, এ গান দিলাম উপহার…,
শুভক্ষণের এমন দিনে,
দূরের মানুষ কাছে আসে ভালোবেসে
সবাই আবার নেবে বিদায়,
সব আয়োজন শেষ হলে একটু হেসে
কোলাহলের শেষেই তুমি একা হবে আবার
তাই জন্মদিনে তোমার, হৃদয় দিলাম উপহার…,
আজ তোমার জন্মদিন, কি দেবো বলো উপহার
হৃদয় ছাড়া দেবার মতো, কিছু তো নেই আমার
তাই জন্মদিনে তোমার, হৃদয় দিলাম উপহার
আজ তোমার জন্মদিন, এ গান দিলাম উপহার…।
জনপ্রিয় শিল্পী খুরশিদ আলমের আজ শুভ জন্মদিন। মানুষের জীবনের একটা বিশেষ দিন। এ নিয়ে কথা হয় তার সাথে সঙ্গীতাঙ্গন এর। তিনি জানান যে, আজ আমার জন্মদিন ও পবিত্র ঈদ উল আযহা। ডাবল পাওনা। তবে করোনা ভাইরাস সব কেড়ে নিয়েছে। আমার জন্ম ১৯৪৬ সালে। গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাট জেলার কালাই থানার হারুনজাও গ্রাম। তার বাবা এ এফ তসলিম উদ্দিন আহমেদ, মা মেহেরুন্নেসা খানম। তিন ভাই, দুই বোনের মধ্যে তিনি বড়। জন্মের পর পুরান ঢাকার কাজি আলাউদ্দিন রোডের নাজিরাবাজারে যৌথ পরিবারে থাকতেন। চাচা ডা. আবু হায়দার সাইদুর রহমান ঢাকা ডেন্টাল কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস পড়ার সময় ঢাকা মেডিক্যালভিত্তিক ‘ঢাকা শিল্পীসংঘ’-এ গান করতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন। তাঁর কাছেই হাতেখড়ি। নবাবপুর সরকারি হাই স্কুলে পড়ার সময় গানের শিক্ষক শেখ আবুল ফজলের কাছে তালিম নিয়েছেন বলে জানান তিনি। তিনি বলেন স্কুলের নানা অনুষ্ঠানে গেয়েছেন। ১৯৬২ ও ৬৩ সালে ইস্ট পাকিস্তান এডুকেশন উইকে পর পর দুইবার রবীন্দ্রসঙ্গীত ও আধুনিকে পুরো পূর্ব-পাকিস্তানে প্রথম হয়েছি। সেই থেকে বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা উৎসাহিত করতে লাগল। ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত নাজিমউদ্দিন রোডের রেডিও অফিসে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতাম। তবে ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করে দিলেন। ফলে ১৯৬৬ সালে খোন্দকার ফারুক আহমেদের কাছে দুই দিনে সাতটি আধুনিক গান শিখে বেতারে অডিশন দিলাম। বিচারক ছিলেন আবদুল আহাদ, ফেরদৌসী রহমান ও সমর দাস। গান গাওয়ার পরে সমরদা বললেন, তোমার গলা আমাদের পছন্দ হয়েছে; কিন্তু তুমি একজনকে কপি করো। বললাম জি। তিনি বললেন, কপি করলে তুমি কোনো দিনও ভালো শিল্পী হতে পারবে না। সবাই বলবে খুরশীদ আলম সেই শিল্পীর মতো গান গায়। তুমি থাকো কোথায়?’ ঠিকানা বললাম। তিনি বললেন, ‘আমি লক্ষ্মীবাজার থাকি। সকাল ৭টার মধ্যে চলে আসবে। আমি তোমার অনুকরণের ছাপ মুছে দেওয়ার চেষ্টা করব।’ সকাল ৭টায় চলে যেতাম, ৮টায় ফিরতাম। তিনি এক ‘সা’ প্রথমে পাঁচ, পরে ১০, ১৫, ২০ সেকেন্ড এভাবে এক-দেড় মিনিট ধরে গাওয়াতেন। আমাদের বাসার পাশেই ছিল মসজিদ। আশপাশের বাড়িগুলোতে হাজি সাহেবরা থাকতেন। তাই আমাদের হিন্দু বাড়িটির প্রদীপ দেওয়ার চওড়া গর্তে গলা ঢুকিয়ে রেওয়াজ করতাম, যাতে তাঁদের কোনো সমস্যা না হয়। এভাবেই গান শিখা হতো। দাদা জসিম উদ্দিন আহমেদের প্রতিষ্ঠিত আজিমপুরের ওয়েস্ট এন্ড হাই স্কুলে এক বছর পড়েছি। এরপর কাপ্তানবাজারের নবাবপুর হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক।
আমার চাচার সঙ্গে সুরকার, গীতিকার ও উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের ওস্তাদ আজাদ রহমানের খাতির ছিল। তিনি তখন কলেজ অব মিউজিকের অধ্যক্ষ। এখান থেকে প্রথম ব্যাচের ছাত্র হিসেবে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। রবীন্দ্রসঙ্গীতে ভালো নম্বর পেয়েছিলাম। তবে দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে গ্র্যাজুয়েশন করতে পারলাম না বলে জগন্নাথ কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করলাম। তিনি জানান ১৯৬৭ সালে শাহবাগ বেতারে প্রথম গান করে ২০ টাকা সম্মানী পেয়েছিলাম।
প্রথম গেয়েছি – ‘চঞ্চল দুনয়নে বল না কী খুঁজছ ?/ চম্পা না করবী না পলাশের গুচ্ছ?’ গীতিকার জেবুন্নেসা জামাল, সুরকার আজাদ রহমান। সেদিন গীতিকার কবি সিরাজুল ইসলামের লেখা ও আজাদ রহমানের সুরে আরেকটি গান গেয়েছিলাম – ‘তোমার দু-হাত ছুঁয়ে শপথ নিলাম/থাকব তোমারই আমি কথা দিলাম।’ বেতারে আমার অনেক আধুনিক গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। সমর দাস, আবদুল আহাদ, আবদুল লতিফ, ধীর আলী, মনসুর আলী, কাদের জামেরী, রাজা হোসেন খান, খুরশিদ খান, আজাদ রহমান, আলম খান, খোন্দকার নুরুল আলম, দেবু ভট্টাচার্যের মতো নামকরা সুরকারের সুরে গান গাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে। তখন নানা ধরনের স্কেচ প্রোগ্রাম হতো।
বর্ষাকালে দুই-তিনজন ভালো শিল্পীর বর্ষার গান হতো। এখন এগুলো হয় না। ফেরদৌসী আপা, হাসিনা মমতাজ বা আনজুমান আরা বেগম, লায়লা আরজুমান্দ বানু আপার সলো গান থাকত। আমরা কোরাস গাইতাম। একুশে ফেব্রুয়ারি, ঈদে বিশেষ অনুষ্ঠানেও গাইতাম। বেতারে আমার ‘যে সাগর দেখে তৃপ্ত দুচোখ মুগ্ধ তোমার মন’, ‘ঝলক দিয়া কাকন পরে’, ‘সূর্যটা আগুনের পিণ্ড’, ‘খোঁপার বাগান খালি করে ওই গোলাপটা আমায় দাও’সহ আরো বহু জনপ্রিয় গান আছে। অনেকের সঙ্গে গাওয়ার স্মৃতিওতো আছে।
অবশ্যই। ফিরোজা বেগম, ফেরদৌসী রহমান, রওশন আরা মাসুদ, রওশন আরা মুস্তাফিজ, ইসমত আরা, জিনাত রেহানা, বেদারউদ্দিন আহমেদ, এম এ হামিদ, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, খোন্দকার ফারুক আহমেদ, মাহমুদুন্নবী, মোহাম্মদ আবদুল জব্বার, মোহাম্মদ রফিকুল আলম, আনজুমান আরা বেগম, ফরিদা পারভীন, নার্গিস পারভীন, মালা ও রূপা খান, নাজমুল হুদা বাচ্চু, সোহরাব হোসেনসহ অনেকের সঙ্গে গান গেয়েছি। ফেরদৌসী আপা তো এখনো আমাদের আইডল। আমাদের ভুল হলেও তিনি বুঝতে দিতেন না। শুধু বলতেন, ‘এভাবে গানটি গাও, তাহলে ভালো হবে ভাই।’ তখন গান খুব বাণীপ্রধান ছিল। অশ্লীল শব্দ গানে ছিল না। এই ডিজিটাল যুগের গানে এসব চলে এসেছে। কারণ লোকে এগুলো গ্রহণ করেছে। আনজুমান আপার সঙ্গে চলচ্চিত্রেও গেয়েছি। তাঁরা আমাদের মঙ্গল চাইতেন। কাদের জামেরী খুব ভদ্র, গুণী ও মেধাবী সুরকার ছিলেন। তিনি সব সময় বলতেন, ‘তোমার মতো আমারও বয়স ছিল। আল্লাহর ওয়াস্তে এসব জিনিস বাইরে খেও না। কেউ দিলেও খাবে না।’ তিনি যেগুলো খেতে বারণ করেছিলেন, সেগুলো এখনো বাইরে আমি খাই না। বেতারের কর্মকর্তারাও আমাদের অভিভাবকের মতো ছিলেন। সিনেমায় প্রথম রেকর্ডিংয়ের দিন বেতারের সঙ্গীত বিভাগের প্রত্যেক অফিসার আমাকে উত্সাহ দেওয়ার জন্য ফার্মগেটের ইস্ট পাকিস্তান গ্রামোফোন কোম্পানিতে গিয়েছিলেন। তখন আমাদের মধ্যে সহযোগিতা ছিল। গীতিকার কোন কোন জায়গায় উচ্চারণ ভুল করে বা উচ্চারণ করতে কষ্ট হয়, সেসব বাদ দিয়ে শিল্পীর জন্য গান লিখতেন। যখন বাণিজ্যিক কার্যক্রমে গাইতাম, যন্ত্রীরা বলতেন, ‘এই জায়গাগুলো ফাস্ট হয়ে যাচ্ছে, একটু স্লো করো।’ এখন অনেক ভালো শিল্পী আছেন। কিন্তু তাঁদের মাথার ওপর তখনকার মতো ছাঁয়া নেই। সমরদা, খান আতাউর রহমান, আবদুল আহাদের মতো ভুল ধরিয়ে দেওয়ার কেউ নেই। বেতার আমাকে অনেক দিয়েছে।
বেতার, বেতারের শ্রোতারা আমাকে খুরশীদ আলম বানিয়েছেন। বেতারে ড. মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কে জি মোস্তফা, আজিজুর রহমান, খান আতার মতো সুরকার, গীতিকবির সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছে। তিনি বলেন এখন আমার সময় কাটে গান শুনে। আগের মতো তেমন কোন গান গাওয়া হয়না। সারাক্ষণ এখন আগের প্রিয় শিল্পীদের গান শুনি। অনেক প্রিয় গান আছে। খান আতার লেখা ও সুর করা সুবীর নন্দীর ‘দিন যায় কথা থাকে’ গানটি খুব ভালো লাগে। এন্ড্রুর ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’ ৫০০ বার শুনলেও তৃপ্তি মেটে না। হাদী ভাইয়ের ‘যেও না সাথী’ খুব ভালো লাগে। শ্যামল মিত্রের ‘চেনা চেনা লাগে তবু অচেনা’ গানটির শুধু ‘এলোমেলা পথচলা/মনে মনে কথা বলা’ এই লাইনটির জন্য ‘সীমানা পেরিয়ে’ ৪০০ বার দেখেছি। সাবিনার ‘ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না’, ‘রেইন’ ছবিতে রুনার ‘আয় রে মেঘ আয় রে’ – গানের মতো কোনো গানই আমাকে আন্দোলিত করে না। আজ জন্মদিনে একটা কথাই বলতে চাই। গান হোক ভালো মানের। গান যেনো মানুষের মনে দাগ লেগে যায়। বাংলা গানকে ভালো একটা অবস্থানে নিয়ে যাক। আজ জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাই প্রিয়শিল্পী খুরশিদ আলমকে। এবং প্রার্থনা করি সুস্থ জীবনের।
ছবি – পিয়াস।