Saturday, April 20, 2024

কিংবদন্তি সেতার বাদক পণ্ডিত রবি শঙ্কর-এর দশম প্রয়াণ দিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি…

– রহমান ফাহমিদা, সহকারী সম্পাদক।

পৃথিবীতে কিছু কিছু মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেও যুগে যুগে মানুষের মনে বা হৃদয়ে আসন গেড়ে শ্রদ্ধাভরে রয়ে যায় তার নিজস্ব কর্মের মাধ্যমে। তেমনি একজন মানুষ, পণ্ডিত রবি শঙ্কর। আজকে তাঁর দশম মৃত্যুদিবস। তিনি ২০১২ সালের ১১ ডিসেম্বর, ৯২ বছর বয়সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের, স্যান দিয়েগো, ক্যালিফোর্নিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন। তাই সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে তাঁর নবম মৃত্যদিবসে শ্রদ্ধান্জলি।

পণ্ডিত রবি শঙ্কর ছিলেন একজন বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞ যিনি সেতারবাদনে কিংবদন্তিতুল্য শ্রেষ্ঠত্বের জন্য বিশ্বব্যাপি সুপরিচিত। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাইহার ঘরানার শ্রষ্টা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান সাহেবের শিষ্য রবি শঙ্কর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য এবং ভারতীয় সঙ্গীতকে ১৯৬০-এর দশকে পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছে প্রথম তুলে ধরেন। তাঁর সাঙ্গীতিক কর্মজীবনের পরিব্যাপ্তি ছয় দশক জুড়ে। ২০১২ খ্রীষ্টাব্দে মৃত্যুকালে রবি শঙ্কর দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক কর্মজীবনের জন্য গিনেস রেকর্ডের অধিকারী ছিলেন।

রবি শঙ্করের ছেলেবেলাটা কেমন ছিল-
রবি শঙ্করের পূর্ণ নাম ছিল রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী, ঘরোয়া নাম ‘রবু’। আদি পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলায় হলেও তার জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের বারাণসী শহরে। বেশ সচ্ছল পরিবারেই জন্ম হয় তার। সেখানেই বড় হয়েছেন তিনি। রবি শঙ্কর ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবার চেয়ে ছোট। তার বাবা শ্যাম শঙ্কর চৌধুরী ছিলেন একজন প্রথিতযশা বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ এবং আইনজ্ঞ। কিন্তু রবি শঙ্করের প্রায় পুরো ছেলেবেলা কাটে বাবার অবর্তমানে। বস্তুত একরকম দারিদ্র্যেতার মধ্যেই রবি শঙ্করের মা হেমাঙ্গিনী তাকে বড় করেন।
বড় ভাই উদয় শংকর ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী। ঐ সময়টা তিনি প্যারিসে ছিলেন। রবি শঙ্কর ১৯৩০-এ মায়ের সাথে বড় ভাইয়ের কাছে যান। এবং সেখানেই আট বছর স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করেন। বার বছর বয়স থেকেই রবি শঙ্কর বড় ভাইয়ের নাচের দলের একক নৃত্যশিল্পী ও সেতারবাদক ছিলেন। ঐ বয়সেই তিনি অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছেন ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে।

পন্ডিত হয়ে ওঠার গল্পটা শুরু এরকমভাবে-
পন্ডিত রবি শঙ্কর প্রখ্যাত সেতার বাদক হিসেবে বিশ্ব জয় করলেও তার শুরুটা ছিল একটু অন্যরকম। বড় ভাই উদয় শঙ্কর আগে থেকেই নৃত্যজগতে বেশ সাড়া ফেলতে শুরু করেছিলেন। পূর্ববর্তীতে তিনি রবি শঙ্করের মেধার পরিচয় পেয়ে তার দলে যোগ দিতে বলেন। সংসারের টানাপোড়ন আর অল্প বয়সের কারণে একপ্রকার ঝোঁকের বশেই রবি শঙ্কর রাজি হয়ে যান। সেই থেকে তার যাত্রা শুরু। ১০ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে তিনি তার বড় ভাই প্রখ্যাত নৃত্যশিল্পী উদয় শংকরের নাচের দলের সাথে প্যারিসে যান। এর ঠিক তিন বছর পর তিনি নৃত্য সংগঠনের সদস্য হন এবং নাচ শিখতে শুরু করেন। নৃত্যে পারদর্শীতার কারণে তিনি বড় ভাইয়ের সাথে ইউরোপ, আমেরিকা ভ্রমণ করেন। এরকম একটি অনুষ্ঠানের জন্য তিনি ইউরোপ ভ্রমণ করেন। এ সময়ে এই দলে ছিলেন মাইহার রাজদরবারের প্রধান সংগীতশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান। তিনি রবি শঙ্করকে দেখেই বুঝতে পারলেন, ঠিকমত তালিম পেলে ছেলেটা একদিন বিশ্ব জয় করবে। তাই তিনি রবি শঙ্করকে একজন একক সেতারবাদক হিসেবে তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন এবং শর্ত দিয়ে বসেন, শিক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই শিক্ষায় তাঁকে একনিষ্ঠ থাকতে হবে। এজন্য ইউরোপ ভ্রমণ শেষে নৃত্যদল ত্যাগ করে তালিম নিতে রবি শঙ্কর মাইহারে চলে যান। কারণ রবি শঙ্কর তখন নৃত্যের পাশাপাশি সেতারও বাজাতেন।
১৯৩৮ সালে ১৮ বছরের এক যুবক মাইহারে আসেন অমর শিল্পী আযার্য আলাউদ্দিন খানের কাছে সেতারের দীক্ষা নিতে। আযার্য, রবি শঙ্করের একনিষ্ঠতা আর ভক্তি দেখে অবাক হয়ে যাচ্ছিলেন। দীক্ষা গ্রহণকালে তিনি আচার্যের পুত্র আলী আকবর খানের সাহচর্যে আসেন। এরপর আর কখনো তাকে পেছনে তাকাতে হয়নি। ওস্তাদ আলী আকবর খানের সাথে পরবর্তিতে বিভিন্ন স্থানে সেতার-সরোদের যুগলবন্দি বাজিয়েছিলেন। ১৯৩৮-৪৪ সাল পর্যন্ত গুরুর বাড়িতে থেকেই তিনি তাঁর শিক্ষা গ্রহণ সম্পন্ন করেন। গুরুর দেয়া সেই শর্ত তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।

পন্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গীত জীবনের পথচলা-
১৯৪৪ সাল পর্যন্ত তিনি নিষ্ঠার সাথে সকল যন্ত্র এবং ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের উপর শিক্ষালাভ করেন। এরপর তিনি মাইহার থেকে মুম্বাই যান এবং সেখানকার ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনের সাথে যুক্ত হয়ে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৪৫ সালে কবি ইকবালের ‘সারা জাঁহা সে আচ্ছা’ কবিতার সুর করেন তিনি। কর্মক্ষেত্রে দায়িত্বশীল আচরণের জন্য ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকে তিনি “অল ইন্ডিয়া রেডিও’- এর নয়াদিল্লী শাখার সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্ব পান। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাস পর্যন্ত তিনি এই পদে কর্মরত ছিলেন।
১৯৫০ সালের দিকে সিনেমার আবহ সঙ্গীতে কাজ শুরু করেন। বেশ কিছু হিন্দি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনায় কাজ করা ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের অপু-ত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপারাজিত, অপুর সংসার)-এর মত বিখ্যাত সিরিজের পরিচালকও ছিলেন পন্ডিত রবি শঙ্কর। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে একক সেতার পরিবেশনার সুযোগ পান তিনি। এরপর তিনি পাশ্চাত্য দেশে পারফর্ম করতে শুরু করেন এবং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।

পন্ডিত রবি শঙ্করের ১৯৫৫ সালে ওস্তাদ আলী আকবর খানের মিউজিয়াম অফ মডার্ণ আর্টের এক পরিবেশনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শ্রোতাদের আগ্রহের সৃষ্টি হয় ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের উপর। ইউরোপ, আমেরিকায় ভারতীয় রাগ সঙ্গীত তুলে ধরার জন্য ১৯৫৬ সালে জানুয়ারি মাসে পন্ডিত রবি শঙ্কর অল ইন্ডিয়া রেডিওর চাকরি ছেড়ে দেন এবং যুক্তরাজ্য, জার্মানি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ করেন। এরপর একের পর এক তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে থাকেন এবং শাস্ত্রীয় সংগীতকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান।
১৯৫৬ সালে লন্ডন থেকে তার তিনটি রাগের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এরপর ১৯৫৮ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো সংগীত উৎসবে অংশগ্রহণ করেন তিনি এবং একই সাথে তিনি কিছু পাশ্চাত্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনাও করেন তিনি। একই বছরে তিনি মুম্বাইতে ‘কিন্নর স্কুল অফ মিউজিক’ প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯৬৭ সালে তিনি দ্য মনোটারি পপ ফেস্টিভ্যালে সেতার পরিবেশন করেন এবং মেনহুইনের সাথে জার্মানির বেষ্ট চেম্বার মিউজিক পারফর্মেন্স ফর ওয়েস্ট মিটস ইস্ট পুরস্কারে ভূষিত হন। এরপর মুম্বাইয়ে প্রতিষ্ঠিত তার কিন্নর সংগীত বিদ্যালয়ের একটি শাখা খোলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যান্জেলেস এবং ক্যালিফোর্নিয়ায়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়, পন্ডিত রবি শঙ্কর কর্নসার্ট ফর বাংলাদেশ আয়োজন করেন এবং সেখানে সেতার পরিবেশন করে বাঙালিদের জন্য ফান্ড সংগ্রহ করেন। এরপর তিনি অসুস্হ হয়ে পড়লে অনেকদিন সংগীত জগত থেকে বিশ্রামের সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৮৯ সালে নৃত্যনাট্য ঘনশ্যাম এর মাধ্যমে আবার কাজে ফিরে আসেন। কিন্তু ১৯৯২ সালে আবার গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে স্থায়ীভাবে বিরতি নেন।

পন্ডিত রবি শঙ্কর তার সংগীত জীবনে অর্জন করেছেন ৪টি গ্র্যানি অ্যাওয়ার্ড যার মধ্যে সর্বশেষ অ্যাওয়ার্ড তার মৃত্যুর পরবর্তিতে ঘোষণা করা হয়। এছাড়াও পেয়েছেন নানা পুরস্কার এবং অর্জন করেছেন বিশ্বখ্যাত নানা সম্মাননাও।
পণ্ডিত রবি শঙ্করকে নিয়ে বিশিষ্ট জনদের মূল্যায়ন-
ভারতীয় চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, রবি শঙ্করের সেতার, বিসমিল্লাহ খানের সানাই আর আল্লারাখা খানের তবলা যে শুনেনি ভারতবর্ষে সঙ্গীতের সুধাই তো তার পক্ষে পাওয়া সম্ভব না।
ইহুদি মেনুহিন বলেছেন, রবি শঙ্কর আমার জন্য সঙ্গীতের এক অনন্য অমূল্য উপহার নিয়ে এসেছিলেন। তাঁর মাধ্যমেই আমি আমার সঙ্গীত অভিজ্ঞতায় নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পেরেছি। আমার কাছে তাঁর সঙ্গীত প্রজ্ঞা এবং মানবিকতাকে একমাত্র মোজার্টের সাথে তুলনীয় মনে হয়।
জর্জ হ্যারিসন বলেছিলেন, রবি শঙ্কর হচ্ছেন বিশ্ব সঙ্গীতের দেবপিতা।
ফিলিপ গ্রাস বলেছেন, রবি শঙ্করের কাছে আমার অনেক ঋণ; তিনি ছিলেন আমার শিক্ষকদের একজন।
সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে এই কিংবদন্তি সেতারবাদক পন্ডিত রবি শঙ্করের প্রতি রইল, অসীম শ্রদ্ধা। তিনি যেখানেই থাকুন,ভালো থাকুন।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles