Saturday, April 13, 2024

ছোটবেলায় গান শেখার চেষ্টা করি নি তা নয়! দাবা’র রানী – রানী হামিদ…

– রহমান ফাহমিদা, সহকারী সম্পাদক।

সঙ্গীতাঙ্গন- পত্রিকার মূল বিষয় হচ্ছে সঙ্গীত এবং সঙ্গীত জগতের মানুষদের নিয়েই লেখা হয় কিন্ত আমি যেহেতু সহকারী সম্পাদক হিসেবে এই পত্রিকায় লেখালেখি করছি, তাই ভাবলাম সঙ্গীতাঙ্গন-পত্রিকায় এমন একজনের সাক্ষাৎকার ছাপাবো যে কিনা সঙ্গীত জগতের বাইরে ক্রিড়াঙ্গনে বিশাল একটা জায়গা নিয়ে অবস্থান করছেন। যেখানে কেউ তাঁকে হারাতে পারছে না। এই সাক্ষাৎকারটি নেয়ার পেছনে যে আমাকে সাহায্য করেছেন, সে আর কেউ নয়! তাঁরই সুযোগ্য সন্তান, বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় ফুটবল তারকা কায়সার হামিদ ভাই। তাঁর কাছে আমি অনেক কৃতজ্ঞ, এই সাক্ষাৎকারটির আয়োজন করে দেয়ার জন্য যদিও তাঁদের বাসায় গিয়ে সাক্ষাৎকারটি নেয়ার কথা ছিল কিন্ত করোনার কারণে আর যাওয়া হয় নি! তবে পরবর্তী সময়ে যাবার ইচ্ছে আছে। সাক্ষাৎকারটির শিরোনাম দেখে অনেকেই হয়তো ভাবছেন, এটা কি করে সম্ভব! সঙ্গীতাঙ্গন-পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার। হ্যাঁ, যাকে নিয়ে লিখছি সে নিজেও খুব অবাক হয়েছেন! সেই প্রসঙ্গে পরে আসছি। শুধু এতটুকু জানিয়ে রাখি যে, সে সঙ্গীত নিয়েই কথা বলেছেন এবং সেই সাথে খেলাটাও বাদ যায় নি। তার সাথে সাক্ষাৎকারে যাওয়ার আগে জেনে নেই তার কিছু কথা।-

তিনি হচ্ছেন বাংলাদেশি বিখ্যাত মহিলা দাবাড়ু শ্রদ্ধেয় রানী হামিদ। যে কিনা বর্গাকৃত ৬৪টি ঘরে দাপিয়ে বেড়ান এবং বাংলাদেশের প্রথম মহিলা আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার। যার দিবানিশি কেটে যায়, বর্গাকৃত ৬৪টি ঘরে-রাজা, মন্ত্রি, হাতি, ঘোড়া, নৌকা ও সৈন্যদের নিয়ে।
রানী হামিদ দাবার রাজ্যের একচ্ছত্র রানী। নামের মত তিনি দাবাতেও রানী। তার আসল নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন। ডাক নাম রানী। বিয়ের পর স্বামীর নাম যুক্ত করে হন, রানী হামিদ। ক্রিড়া জগতে তিনি রানী হামিদ নামে অধিক পরিচিত। তার সুবিশাল এই পরিচয়ের আড়ালে তার আসল নামটি ঢাকা পড়ে গেছে।
রানী হামিদ ১৯৪৪ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারি সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা সৈয়দ মমতাজ আলী পেশায় একজন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন এবং মা কামরুন্নেসা খাতুন ছিলেন গৃহিণী। পিতার কর্মস্থল বারবার পরিবর্তনের কারণে চট্টগ্রামের নন্দকানন গার্লস স্কুলে পড়াশোনা শুরু হলেও ম্যাট্রিক পাস করেন সিলেট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৫৯ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা এম এ হামিদের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। পরবর্তীতে এম এ হামিদ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন ১৯৭০-এর দশকে। শ্রদ্ধেয় আবদুল হামিদ একজন দক্ষ সাঁতারু ছিলেন। পরবর্তীতে এম এ হামিদ বাংলাদেশ হ্যান্ডবল ফেডারেশনের সভাপতিও ছিলেন। এম এ হামিদ ও রানী হামিদ এর তিন ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে কায়সার হামিদ বাংলাদেশের একজন নামকরা ফুটবল খেলোয়াড়। মেজো ছেলে সোহেল হামিদ ও ছোট ছেলে ববি হামিদও জাতীয় পর্যায়ের খেলোয়াড় ছিলেন। মেয়ে জেবিন হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

৭৫ বছর বয়সেও অপ্রতিরোধ্য আন্তর্জাতিক মহিলা দাবা মাস্টার শ্রদ্ধেয় রানী হামিদ। এখন পর্যন্ত জাতীয় মহিলা দাবা অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৯বার। এর অর্ধেকেরও বেশি বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন, শ্রদ্ধেয় রানী হামিদ। জাতীয় মহিলা দাবার ৩৯তম আসরেও অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন তিনি। বাংলাদেশের দাবা খেলার মহিলা চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ। দাবা খেলায় তাঁর মাথার মুকুট এখনও পর্যন্ত কেউ ছিনিয়ে নিতে পারে নি। ১৯৭৯-৮৪ সাল পর্যন্ত টানা ছয় বার জাতীয় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন হন রানী হামিদ। তারপর থেকে ১৯৮৮, ৯০, ৯২, ৯৬, ৯৮, ২০০১, ০৪, ০৬, ০৮, ০৯, ১১, ১৮, ১৯ প্রতিযোগিতায় মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। ২০১৯ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ২০ বার চ্যাম্পিয়ন হন তিনি। জাতীয় পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় এতবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার রেকর্ড কারো নেই।
জাতীয় পর্যায়ে ছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়েছেন। ১৯৮১ সালে তিনি প্রথম কোন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। আন্তর্জাতিক মানের কোচিং ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই ভারতের হায়দ্রাবাদে প্রথম এশীয় দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করে তিনি বেশ সুনাম অর্জন করেন। এছাড়াও ১৯৮৩, ৮৫, ৮৬ সালে ব্রিটিশ মহিলা দাবায় তিনবার চ্যাম্পিয়ন হবার বিরল কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। ১৯৮৪ সালে তিনি পুরুষ টিমের সদস্য হয়ে গ্রিসের দাবা অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার উপাধি পান এবং আন্তর্জাতিক রেটিং লাভ করেন। ২০০৫ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে তিনি রানার্সআপ হন। ২০১৫সালে কমনওয়েলথ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে স্বর্ণপদক অর্জন করেন তিনি।

শ্রদ্ধেয় রানী হামিদের বিশাল প্রাপ্তির কিছু অংশ তুলে ধরা হল। এবার সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে যখন তাঁকে কল করলাম এবং তাঁর সাথে সঙ্গীত নিয়ে আমার যে কথা হয়েছে! তা হুবুহু তুলে ধরা হল-
আসসালামু আলাইকুম-
ওয়ালাইকুম আসসালাম।
আমি তাঁকে বললাম, আমি একটি সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা সঙ্গীতাঙ্গন থেকে কথা বলছি। আমার খুব জানার ইচ্ছে যে, আপনি তো দাবা’র মত এত কঠিন একটি খেলা খেলেন যে খেলাটি সবাই আয়ত্ত্ব করতে পারে না। আমার প্রশ্ন হল- আপনার কি কখনও গানের প্রতি ইন্টারেস্ট ছিল ?
সে আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন- আপনি কোথা থেকে বলছেন ?
আমি বললাম- আমি সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা সঙ্গীতাঙ্গন থেকে বলছি।
তখন তিনি অবাক হয়ে হেসে হেসে বললেন, সঙ্গীত থেকে আপনি খেলার প্রতি ইন্টারেস্ট নিলেন! (যদিও পরে আমার অনুরোধে তুমি করেই বললেন)।
আমি বললাম, আমি ভাবলাম! আপনি এত কঠিন খেলা খেলেন, যেখানে অনেকেই এই খেলায় তেমন কিছু অর্জন করতে পারে নি। অথচ আপনি পরপর কয়েক বছর জাতীয়ভাবে দাবা’র ‘মুকুট’ ধারণ করে আছেন। আমরা যারা মেয়েরা আছি তারা সবাই আপনাকে নিয়ে খুব গর্ববোধ করি। তাই ওখান থেকেই ভাবনাটা এল। তাই আমি জানতে চাইছি, আপনি দাবা’র মত এত কঠিন খেলা খেলেন। আপনার কখনও কি গান শেখার প্রতি আগ্রহ হয়ে ছিল এবং গানকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?-
তিনি আবার হেসে হেসে বললেন, আমার তো মনে হয় গানই বেশী কঠিন! ছোটবেলায় গান শেখার চেষ্টা যে করি নি, তা নয়! ছোটবেলায় আমার বাবার খুব শখ ছিল আমরা গান শিখি। আসলে তখন আমাদের মুসলিম সমাজ, ইসলামিক মাইন্ডের সবাই এবং মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে গানটাকে সেভাবে নিত না। তারপরেও বাবা চাইতেন আমরা গান শিখি কিন্ত আমার চাচা খুব কড়া মানুষ ছিলেন। উনি গানবাজনা পছন্দ করতেন না। উনি বলতেন, কেন গান শিখবে ? তারপরেও বাবার ইচ্ছায় গানের স্যার রেখে সা রে গা মা পা শেখা হয়েছিল এবং কাজী নজরুলের ‘কে বিদেশী মন উদাসী’ -গানটা শিখেও ছিলাম কিন্ত আমার খেলার প্রতি বেশী ঝোঁক ছিল। তাই গানের স্যার বিকেলে আমাদের বাসায় গান শেখাতে এসে একদিনও পেত না। তাছাড়া তখন স্কুল থাকত পাঁচটা পর্যন্ত। বিকেল ছাড়া আর টাইম নেই। সন্ধ্যার সময় তো হাউজ টিউটরের কাছে পড়াশোনা করতে হত। কিন্ত বিকেলে খেলা ফেলে গান শিখব! সা রে গা মা পা করব, ভাবতে পারতাম না। খেলার প্রতি প্রচণ্ড আকর্ষণ থাকাতে গানের স্যার নিজেই মাঠে গিয়ে ধরে বেধে এনে আমাকে গান শেখাত। ওতে যা একটু শিখেছিলাম। তারপর কয়েকমাস যাওয়ার পর আব্বা
গানের স্যারকে বলল, থাক্! ওর গান শেখার শখ নাই। তবে গান তো সবারই ভালো লাগে। আমারও ভালো লাগে। গান ভালো লাগে না, এমন কোন মানুষ তো নেই, তাই না!

গান তো অনেক ধরণের আছে। আপনার কি ধরণের গান পছন্দ ?
নাহ! ওরকম কোনো একটার প্রতি আকর্ষণ নাই। ভালো গান যাইই শুনি তাইই ভালো লাগে। সেখানে নজরুল সঙ্গীত, রবীন্দ্র সঙ্গীত, আধুনিক, এমনকি হিন্দি গান যখন যেটা ভালো লাগে তখন তাইই শুনি। আমার এরকম কোনো প্যাশন নাই যে, আমার এই গান ভালো লাগে বেশি। যে কোনো ভালো গানই ভালো লাগে।

বাংলাদেশে আপনার কি এমন কোনো পছন্দের শিল্পী আছে ?
বাংলাদেশের সব শিল্পীর গানই ভালো লাগে। একজন করে পছন্দ নাই। যেমন পাকিস্তান আমলে রুনা লায়লা যখন প্রথম গান করা শুরু করে তখন রুনা লায়লা’র গান পছন্দ করেছিলাম। আবার দেখা যায় একেক সময় একেক গ্রুপ আসে। যেমন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একটা গ্রুপ ‘পপ সঙ্গীত’ নিয়ে আসল, ‘এমন একটা মা দেনা’ খুব জনপ্রিয় গান ছিল। তোমার মনে আছে গানটা ?
হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে। তখনকার জনপ্রিয় পপশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ ভাইয়ের গাওয়া গান।-
তখন সময় সময় এই গানগুলো খুব ভালো লাগতো। আমার এমনেতে কমন যেটা তা না, আমার আসলে গান যেটা ভাল সেটা শুনতে ভালো লাগে। সেটা চেনা শিল্পী হোক বা অচেনা শিল্পী হোক! তাতে আমার কোনো অসুবিধা নেই, গান ভাল হলেই হল।

যেহেতু সে দাবা খেলার ‘রানী’ তাই সঙ্গীত বিষয়ক পত্রিকা হলেও তাঁর খেলা নিয়ে একটু জানার লোভ সামলাতে পারলাম নাহ! তাই প্রশ্ন করলাম তাঁকে- আপনার দাবা খেলার প্রতি এত আকর্ষণ কিভাবে হল। আপনার পরিবারে কেউ কি এই খেলায় যুক্ত ছিলেন ?-
না, না এটা একটা আশ্চর্যের বিষয়! আমি এত চঞ্চল ছিলাম যে, এত চঞ্চল থাকা সত্ত্বেও দাবার প্রতি আমার অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল। যখন আমি জানতাম না,দাবা কি জিনিস! তখন থেকেই আমার ভেতরে এর একটা জায়গা তৈরি ছিল, তো কি আর বলবো।

এখন আপনার পরিবারের আর কেউ কি দাবা খেলেন ?-
খেলেছে মানে এরকম, সবাই খেলেছেন। কিন্ত দাবা খেলাটাকে কেউ ধরে রাখে নি। নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। যেমন কায়সার আউটডোরে ফুটবলে ব্যস্ত হয়ে গেল।

কায়সার ভাই কখনও কি দাবা টুর্নামেন্টে খেলেছেন ?-
ওর ছোটটা সোহেলকে নিয়েছিলাম খেলতে টুর্নামেন্টে। কায়সারকে টুর্নামেন্টে নিতে পারিনি। কারণ তখন ক্লাস থেকে কড়াকড়ি ছিল! মানে অন্য খেলায় যেতে দিত না। আস্তে আস্তে তো পরে বন্ধই হয়ে গেল। প্রথম দিকে তো মনে কর, একটা প্লেয়ার সব খেলাই খেলত- যে ফুটবল খেলছে, সে ক্রিকেটও খেলতেছে, বাস্কেটবলও খেলছে। সে সবই খেলছে। কায়সারের অবশ্য পরে আস্তে আস্তে ফুটবলই ওর প্রফেশন হয়ে গেল।

এত ব্যস্ততার মধ্যে সময় দেয়ার জন্য সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ ও শ্রদ্ধা। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে সাবধানে থাকুন। শুভকামনা রইল।
সঙ্গীতাঙ্গন এবং তোমার জন্যেও শুভকামনা রইল।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles