বাঙালি বরাবরই দোষ এড়িয়ে যাওয়ায় পটু! কিছু অসংগতি হলেই ওমুকের দোষ, তোমুকের দোষ, সরকারের দোষ, বিরোধী দলের দোষ, মোল্লার দোষ, পুরোহিতের দোষ। দোষ দিতে বাকী রাখি না স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকেও। নিজের দায়িত্ব কর্তব্যে অতিরিক্ত উদাসীন। ‘থাক কিছু হইতো না’, গুজব জাতীয় মহামারিতে এ জাতি জর্জরিত। এ জাতির সর্বাঙ্গে ব্যথা।
একটি স্থিরচিত্র। দোকানের পাশেই ডাস্টবিন। এর সাথেই লোহার ছিদ্র ঢাকনার সচল ম্যানহোল। কেউ ডাস্টবিনে ফেলে। কেউ ম্যানহোলে ফেলে। একটু এগিয়ে না যেয়ে ঢিল ছুড়ে কেউ ডাস্টবিনে ফেলতে যেয়ে নিচে ফেলছে। মানুষ এখন অলস, ভীষণ উদাসীন। প্রযুক্তি মানুষকে বেশি অলস বানিয়েছে। একসময় মানুষ খেতেও চাইবে রিমোটে। মানুষের বন্ধু হয়ে উঠবে সোফিয়া নামক রোবটরা। প্রযুক্তির ব্যবহারে সমাজে থেকেও মানুষ অসামাজিক হয়ে উঠছে।
বুঝেও বুঝতে না পারা অভ্যাসে আমাদের দায়িত্ব কি. ?
সচেতনতা, সফলতায় পৃথিবীতে আমাদের অবস্থান কি.?
পৃথিবী সৃষ্টির শুরুর ইতিহাস ঐতিহ্যে এ বিশ্বে আমরা কারা.?
এমন প্রশ্নের উত্তর আমরা জানি! হয়তো জানি না! তবে আমরা মানুষ। বাংলায় কথা বলি। ক্ষুধা লাগলে খেতে হবে। লজ্জা ঢাকতে পোশাক পড়তে হবে। ঘুমাতে হবে। হাগতে মুততে হবে। বংশবৃদ্ধি করার প্রক্রিয়ায় নিজেকে যুক্ত করতে হবে। অসুখে চিকিৎসা নিতে হবে। পরিষ্কার, সুন্দর দেখলে চিনি। এগুলো জানি।
আমরা জেনেও এগুলোর সঠিক ব্যবহার করছি কি.?
নিজেদের না জানার অসংখ্য বিষয়তো পরেই আছে পৃথিবীর ইতিহাসে।
যতদুর জানি তা করতে কেনো আমাদের এতো অনীহা! কেনো নিজেদের জীবন নিয়ে এতো উদাসীনতা!
কেনো প্রকৃতির সাথে এই জুয়াখেলা.?
মানুষের সাথে প্রকৃতির সখ্যতা সৃষ্টির শুরু থেকেই। পরিবেশ প্রকৃতিকে মমতা দিয়ে রক্ষা করে। পরিবেশ-প্রকৃতি একে অপরের প্রেমে সৃষ্টিকর্তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। পৃথিবীর পরিবেশ-প্রকৃতি রক্ষা ও ভোগ করার দায়িত্বে লক্ষাধিক মতান্তরে ততোধিক জাতীয় প্রাণীর অস্তিত্ব। মানুষ সৃষ্টির সেরা প্রাণী! (মানুষেরই বলা)। সেরা এই মানুষই নষ্ট করছে পরিবেশ প্রকৃতি। কালের বিবর্তনে মানুষের এতোই হিংস্রতা বেড়েছে। নিজেরা নিজেদের হত্যা করে উল্লাস করি। প্রকৃতি ধ্বংস করে সাময়িক আরাম খুঁজি। আয়োজন করে উন্নয়নের নামে প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করছি। পারমানবিকে ধ্বংস করে দেই মানবতায় গড়া ইতিহাস সভ্যতা। লিপিবদ্ধ করি বিজয়ী দলের কৃতিত্বে ভরা অসাধারণ কালজয়ী রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। মানবতা বিচ্ছেদের সুরে তোলপাড় করে জাতিসংঘের জলসা ঘর।
পৃথিবীর ম্যাপে অপরুপ বঙ্গোপসাগরের কোলে পরম মমতায় জন্ম নেয়া বাংলাদেশ। সাথে সুন্দরবন সহ অন্যান্য প্রাকৃতিক পরম আত্মীয়েরা বাংলাদেশকে সভ্য সমৃদ্ধ করছে। এমন ষড়ঋতুর অপরুপ প্রকৃতি ঘেরা সবুজের দেশ পৃথিবীতে বিরল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারনে বর্তমানে দুই থেকে তিনটি ঋতু’র দেখা পাওয়া যায়। মানুষের উদাসীনতায় নদী, পাহাড়, বনাঞ্চল, পশু-পাখি সহ প্রাণ প্রকৃতি ধ্বংসের কারনে কবির বর্ননার ষড়ঋতু আজ ইতিহাসে লিপিবদ্ধ। প্রকৃতি ধ্বংসের কারনে পুরো বিশ্ব আজ জলবায়ুর রোগে মুমূর্ষু অবস্থায়। বিশ্ব নেতারা মিটিং-এ করে করেই যাচ্ছেন। জলবায়ু সমস্যার সমাধান হয়তো আমরা জানি, মানি না।
কে শুনে কার কথা.?
সমস্যার সমাধান করি অপরকে দোষ দিয়ে। সাময়িক ক্ষমতাবলে এড়িয়ে যাই। সৃষ্টিকর্তার অসীম করুণা প্রকৃতির পথচলাকে মানুষ রুদ্ধ করছে। প্রতিনিয়ত করছে। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রকৃতির পথচলা মানুষ দ্বারা রুদ্ধ হওয়ার ঘৃণিত অমানবিক উদাহরণের একটি তিস্তা বাঁধ। বাংলাদেশে ভারতের কৃত্রিম বন্ধুত্বের প্রমাণ এই তিস্তা বাঁধ। নদীর স্বাভাবিক বহমানতা রোধ করেছে তিস্তা বাঁধ। মানুষ আকাশ, মাটি, আগুন, পানি, প্রকৃতি, আল্লাহ, ভগবান, ইশ্বরের নামে ভাগ করে দেয়। নিজেদের স্বার্থে তৈরি করে আইন। আবার ভাঙ্গে সেই আইন। মানুষের আইন প্রয়োগের ফলে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা প্রশ্নবিদ্ধ! অথচ, নিজ সচেতনতা, মানবিকতার প্রকাশ, স্রষ্টার কৃতজ্ঞতা পেলেই মানুষ কেবল সভ্য হলো।
মানুষের নিজের নিরাপদ পথচলার সাথে প্রকৃতির পথচলাকেও নিরাপদ রাখতে হবে। আমরা অসচেতন হয়ে ডাস্টবিনে ফেলার আবর্জনা যেখানে সেখানে ফেলে ম্যানহোল আটকে দেই। এতে ময়লা আবর্জনা, প্লাস্টিক আটকে ড্রেনেজ ব্যবস্থা নষ্ট করে। সামান্য বৃষ্টি হলেই শহর জুড়ে জলাবদ্ধতা। বেয়াক্কেল জনগন ইচ্ছে হলেই ধুয়ে ফেলি সরকার’কে। অথচ, এই জলাবদ্ধতার পুরো আকামটাই করলাম অসচেতন, কুশিক্ষিত, পরিবেশ-প্রকৃতির হত্যাকারী কিছু খুনী। সমাজে বাস করা নিম্ন শ্রেণির কর্মীরা তখন ড্রেনেজ ব্যবস্থা পরিষ্কার করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ঐ মহান কাজটিতেই যেনো তাঁদের পরম আত্মতৃপ্তি। সমাজে মেথর না থাকলে হোয়াইট হাউসও এতোদিন দূর্গন্ধময় ময়লা আবর্জনায় ভরা থাকতো। পুরো পৃথিবী হয়ে যেতো ডাস্টবিন। মেথর’রা সমাজে সময়ের কাজ সময়ে করে। চলতে থাকা সমস্যা সাময়িক সমাধান মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। হুমকিতে থাকে পরিবেশ-প্রকৃতি। এই অসাবধানতায় ময়লা, আবর্জনা, প্লাস্টিকের বোতল, চিপসের প্যাকেট, দূষিত রাসায়নিক বর্জ যথাস্থানে না ফেলে এভাবে যেখানে সেখানে ফেলে তা ড্রেন>খাল>নদী>সাগর>মহাসাগরে মিলিত হয়। দুষিত হয় পানি, প্রকৃতি।
পানিবাহিত রোগে পৃথিবী দেখেছিলো কলেরা নামক মহামারি। বর্তমানে চলছে করোনা নামক মহামারি। এখানেও ঔষধ প্রকৃতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা আর সচেতনতা। পরিবেশ-প্রকৃতি অপরিষ্কার আর ধ্বংস খেলায় আমরা মেসি’র ফুটবলের চেয়েও ভালো খেলি। উদাসীনতা খেলায় আমরা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ক্ষমতা রাখি। সবাই যেনো দশ নাম্বার খেলোয়াড়। জার্সি নিয়ে মারামারি করি। আমরাই ‘থাক কিছু হইতো না’ ‘আল্লাহ ভরসা’ বেশি বেশি বলি।
সচেতনতা জেনেও বুঝি না। মানসিক অন্ধত্বে কিছুই দেখি না। এভাবে অসচেতনতার প্রেমে পরিবেশ-প্রকৃতিকে নিয়ে এগিয়ে গেলে হয়তো বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, অগ্নুৎপাত, ঘুর্ণিঝর, সুনামি, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে এ জাতি একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে!
এই জাতিই পৃথিবীর একমাত্র জাতি! যারা নিজেদের মাতৃভাষার ভাষার জন্য রক্ত ঝরিয়েছে। অর্জন করেছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। ২১শে ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করে পুরো বিশ্ব। এই গৌরব বাংলার। নিজেদের ভূখন্ডের জন্য নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয়ী। বিভিন্ন সেক্টরে আজ বাঙ্গালীরা বিশ্ব বরেণ্য। উদাসীনতা দূর করে নিজেদের সময় দিলে বাঙ্গালীদের মেধা হবে আরো বিশ্বনন্দিত। মানবতা, শিল্প, সাহিত্য, রাজনীতি, ক্রীড়া সহ বহু সেক্টরে বাংলাদেশ বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
বাঙালি মানুষ। মানুষ সব পারে।
লেখা – মুরাদ নূর
সুরকার ও সংস্কৃতি কর্মী
muradnoorbdicon@gmail.com