Tuesday, March 19, 2024

অবসকিউর -এর তিনযুগ পূর্তি এবং ব্যান্ড প্রতিষ্ঠাতা টিপু’র চিন্তা ভাবনা!…

– রহমান ফাহমিদা, সহকারী-সম্পাদক।

আশি দশকে বাংলাদেশের যতগুলো জনপ্রিয় ব্যান্ড রয়েছে তার মধ্যে একটি হচ্ছে, ‘অবসকিউর’। আশির দশকে সাইদ হাসান টিপু এই ব্যান্ডটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ খুলনায় অবসকিউর প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। তার আগে বন্ধু মানাম আহমেদের সাথে একটি স্টুডিও করার স্বপ্ন দেখতেন, যেটা বাস্তবায়ন হয়েছে ২০০৩ সালে। ১৯৮৪ সালে তাঁর ‘চাইম’ ব্যান্ডে যোগ দেয়া হয় বন্ধুর সুবাদেই। এক বছর ‘চাইম’-এ থাকাকালীন ইংরেজি গান করতেন টিপু। তারপর নিজের বাংলা গান করার আগ্রহ থেকেই খুলনার তরুণদের সাথে করে ‘অবসকিউর’-এর যাত্রা শুরু করেন। বারবার সদস্য পরিবর্তন হওয়াতে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে ব্যান্ডটিকে। তবে এখনকার ব্যান্ডের লাইনআপ যথেষ্ট স্থির এবং পরিণত। আশির দশকে সারগাম স্টুডিও থেকে অবসকিউরের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে অবসকিউর প্রথম অ্যালবাম ছিল ‘অবসকিউর ভলিউম ওয়ান’। সেই অ্যালবামের আলোচিত ১২টি গানের মধ্যে অন্যতম হল, মাঝরাতে চাঁদ, ভণ্ড বাবা, মমতায় চেয়ে থাকা ইত্যাদি। ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় অ্যালবাম। এই অ্যালবামের – তুমি ছিলে কাল রাতে, আঁধার ঘেরা স্বপ্ন, সন্ধ্যা আকাশ গানগুলি
আলোচিত হয়। ৯৩/৯৪ সালে প্রকাশিত হয় রকিং ঘরণার অ্যালবাম ‘স্বপ্নচারিণী’। নব্বই দশকের মাঝ থেকে অবসকিউরের সঙ্গীত আয়োজন হারিয়ে যায়। আবার ২০০৭ সালে আবারও গানের মঞ্চে আসে অবসকিউর। টিপু বেশ কিছু একক অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন। একক অ্যালবামগুলো হল- একাকী একজন(১৯৯০), ভবের পাগল (১৯৯২), রঙধনু হতে চাই (২০০৭) এবং সর্বশেষ রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম ‘সকলই ফুরালো’ (২০০৮) প্রকাশ করেছেন। তবে সেটি করেছেন ভক্তদের অনুরোধে। এর পর থেকে ব্যান্ড নিয়ে চলেছে তাঁর ভাবনা।

অবসকিউর-এর তিনযুগ পূর্তি উপলক্ষে সঙ্গীতাঙ্গন পত্রিকা থেকে অবসকিউর ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সাইদ হাসান টিপুর সাথে কথা হল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে। সঙ্গীতাঙ্গন এর সাথে কথা প্রসঙ্গে ব্যান্ড এবং বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি যা বলেছেন, তা তুলে ধরা হল-

অবসকিউর-এর তিনযুগ পূর্তি হল! ব্যান্ড নিয়ে সামনে তাঁদের পরিকল্পনা কি এবং এত বছর পার করার অনুভূতিটা কেমন জানতে চাইলে, তিনি বলেন-
অন্যরকম কোনো ব্যাপার নাই। সারা জীবন যেভাবে চেষ্টা করে আসছি, সেভাবেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। ব্যান্ডের শুরু থেকেই ইচ্ছা ছিল যে, সোশ্যাল এওয়ারনেস তৈরি করা! যার জন্যে আমাদের গানে বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে, দেশের বিভিন্ন অসংগতির কথা। রোমান্টিক গানের পাশাপাশি অন্য গানও করেছি, বিশেষ করে ২০১৩ থেকে আমরা মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গান করা শুরু করেছি। আগামীতেও খুব ইচ্ছা আছে যে, আমরা এই টপিকটি নিয়ে কাজ করব। ব্যান্ডের ত্রিশ বছর যে পার হয়েছে এটা আসলে কোন দিক দিয়ে যে পার হয়ে গেল, বুঝতেই পারলাম না। মনে তো হয়, এই তো সেদিন!

আশি/নব্বই দশকের শ্রোতারা ঘরে বসে ক্যাসেটে যে গান শুনতো। আশে পাশের বাড়িতে জোরে জোরে গান বাজানো হত এবং মার্কেটগুলোতে সব সময় গান বাজতো। দেখা যেত সেই গান শুনতে শুনতে তাদের মুখস্ত হয়ে গেছে। ফলে সেই গান মানুষের মুখে মুখে ফিরতো। এখন তো সেই ব্যাপারটি নেই! এই বিষয়ে তিনি বলেন-
সেই আগের মত ক্যাসেট প্লেয়ার কেউ ব্যাবহার করে না এবং ক্যাসেটের সেই মার্কেটও নাই। দোকান নাই কিছু নাই সবই উঠে গেছে। সিডির দোকানগুলোও উঠে গেছে। এখন গানগুলো মোবাইলের হয়ে গেছে এই তো! চেঞ্জ তো হবেই। সারা পৃথিবী সামনের দিকে যাচ্ছে। আমরা অডিওর কথা যদি চিন্তা করি! সারা পৃথিবী একটা সিস্টেমে কাজ করে। সেটা যে কোনো মিডিয়াতেই হোক না কেন। মানুষতো গান শোনে এবং গানটা তো ফ্রি না! আমাদের গান করতেও পয়সা খরচ হয়, শ্রম ব্যায় হয়। আমাদের ক্রিয়েটিভিটির ব্যাপার আছে। আসলে গান তো ফ্রি নাহ! আমাদের সমস্যা হয়ে গেছে, সবার ধারণা এটা ফ্রি। আমরা গান করে দিব আর সবাই এমনে এমনেই শুনবেন, অবস্থাটা এরকম হয়ে গেছে। যার জন্যে অডিও বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ এবং ভবিষ্যতে এটা ঠিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা! সেটা নিয়ে সবাই কাজ করছে। আমরাও চেষ্টা করছি। দেখা যাক, কি হয় সামনে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সাথে সাথে সঙ্গীত জগতেরও ৫০ বছর পূর্তি হল! আপনি যখন থেকে এই সঙ্গীত জগতে পদার্পণ করেছেন তখনকার ব্যান্ডের গান আর এখনকার ব্যান্ডের গানের মধ্যে আপনি কি ধরণের পরিবর্তন দেখছেন, জানতে চাইলে তিনি বলেন-
পরিবর্তন তো হচ্ছেই। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে, পরিবর্তন হওয়া ভালো। পরিবর্তন সবাই চায় মানে ভালোর দিকে যাক সেটা সবাইই চায় কিন্তু আমাদের এখানে হয়েছে কি ক্রাশ বেশি হয়েছে। উল্টোপাল্টা লিরিকের গান যাচ্ছে। তাই গান যেটা হচ্ছে তার কোনো স্থায়িত্ব নেই! একবার শোনার পর আর শুনতে ইচ্ছা করে না, তাই না! আর মনেও থাকে না কি শুনলাম! বেসিক্যালি ভাল গান হতে হলে যে সকল বিষয়ে মন দিতে হয় গানের কথা ভাল হতে হবে, সুর ভাল হতে হবে এবং গায়কী ভাল হতে হবে তাই না! সব মিলিয়েইতো একটা গান ভাল হয়। সেই চেষ্টাটি না করে খুব কুইক রেজাল্ট চাই তো, তাই এই অবস্থা। আমাদের যে মনোনিবেশ করা দরকার মিউজিক নিয়ে সেটা খুবই কম হয়। রাতারাতি অ্যালবাম হয়ে যায়, রাতারাতি গান হয়ে যায়।

চর্চাটা খুব কম হয়, মনে হচ্ছে আমার। আর আগে যে ব্যান্ডগুলো দিনের পর দিন প্র্যাকটিস করে ষ্টেজে উঠত, এখন কি সেইরকম আছে আপনার মনে হয়-
হ্যাঁ, চর্চা তো নাইই! আসলে আমাদের গান শেখানোর লোকইতো কেউ নাই। আগের ব্যান্ডগুলো যাদের করা তাঁরা ঠিকই প্র্যাকটিস করেছে। পুরনো ব্যান্ডগুলো যদি ধরেন প্রত্যেকেই চর্চার মধ্যে আছে, চর্চা ছাড়া কিছুই হচ্ছে না। কিন্তু আমি বলছি ওভারঅল অডিও সিচুয়েশন নিয়ে যে গান আমাদের দেশে হচ্ছে, কুইক রিলিজ। সবকিছু রাতারাতি হচ্ছে আবার হারিয়েও যাচ্ছে।

আমার মনে হয় হারিয়ে যাচ্ছে এই জন্যে যে, ইউটিউবে একজন গুণী শিল্পীর সাথে ওলটপালট জিনিসগুলো আসছে তাই হারিয়ে যাচ্ছে। কারণ মোবাইল সবার হাতে হাতে ফলে শ্রেনীভেদ নাই-
আসলে সত্যি কথা হয়েছে কি! যারা গান শুনত, আমরা যখন শুরু করেছিলাম সেই আশির দশকে! তখন আপনিও গান শুনতেন, এখন কি আর সেভাবে শোনেন ? সবাই কিন্তু মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমরা শুনতে চাইলে, মোবাইলেও ভাল গান শুনতে পারি, তাই না ? কিন্তু ঘটনা হচ্ছে যে মাঝে এত আজেবাজে গান হয়েছে ফলে আমাদের দেশে যে শ্রোতারা গান শুনত, সেই শ্রোতাদের শ্রেণীটি আর নাই। এখনকার শ্রেনীতো হচ্ছে রাস্তার লোকজন বেশী! সমস্যাটাতো সেইখানে। এখন যে গান হিট হচ্ছে, আপনি যদি ইউটিউবের ভিউয়ারস দেখেন, সেখানে দেখবেন গানের কোয়ালিটিটা কি ? তো! সেই কোয়ালিটির গান হচ্ছে আর সেই গানের ভিউয়ারস সেভাবে বাড়ছে। ভালো গানের ভিউয়ারস নাই, আর ভালো গান শোনার লোকও নাই।

যাই হোক! সঙ্গীত জগতের এই ৫০ বছর পূর্তিতে আপনার প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি কি, তা যদি বলেন-
আমার কোনো অপ্রাপ্তি নাই। আমার পুরোটাই প্রাপ্তি। আমার গান নিয়ে কোনো হতাশা নাই। সবচেয়ে বড় কথা! আমি সবসময় একটা কথা বলি যে, আমাকে যেই পরিমান এই দেশের মানুষ ভালোবাসে, এইটা আসলে বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার, তাই না! কোনো অপ্রাপ্তি নাই, সব ঠিক আছে। সব কিছুই ভাল আছে এবং চেষ্টা করছি ভাল কিছু করার।

আপনার কি কোনো আক্ষেপ আছে যে, আপনি এখনো এরকম গান করতে পারেন নাই, যেরকম আপনি করতে চান!-
না, নাহ! এরকম কোনো ব্যাপার আমার মধ্যে নেই। কারণ আমরা এতকিছু নিয়ে কাজ করেছি যে সেই আক্ষেপটি নাই। সবচেয়ে বড় কথা যেটা, সবসময় খুব ইচ্ছা ছিল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করার! সেটার ওপরেও আমরা অলরেডি কাজ করে ফেলেছি এবং সেই কাজ নিয়ে ম্যাক্সিমাম মানুষের কাছে পৌঁছেতে পেরেছি। এস্পেশিয়েলি ‘আজাদ’ গানের কথাই যদি ধরেন! ‘আজাদ’ ছোট ছোট বাচ্চাদের থেকে শুরু করে বড়দের মধ্যেও যে পরিমান সাড়া ফেলেছে! আমরা যেখানে হিট করতে চেয়েছি সেই জায়গায় পৌঁছেতে পেরেছি। আমাদের টার্গেট যেটা ছিল যে, গান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে জানাবো। এই যে এতগুলো মানুষ ত্যাগ স্বীকার করছে, তাঁদের কথা জানাবো। সেটাও কিন্তু আমরা করতে পেরেছি এবং আগামীতেও আরও কিছু করার পরিকল্পনা আছে। একটা ভাল কিছু করার চেষ্টা করব, আশা করি।

এখনতো লকডাউন চলছে! তাই সবকিছুই বন্ধ। এখন সময়টাকে কিভাবে কাজে লাগাচ্ছেন এবং গানের প্র্যাকটিস করতে পারছেন কি!-
হ্যাঁ, সবকিছু বন্ধ! তাই গানের প্র্যাকটিস করতে পারছি না। কারণ সবাই একসাথে বসতে পারছি না বা একসাথে হওয়া যাচ্ছে না। এখন সত্যি কথা বলতে কি! রীতিমত সিনেমা দেখে সময় কাটছে। আর কম্পিউটারে বসে সারা পৃথিবীর খোঁজ-খবর নিচ্ছি এটাই হচ্ছে কাজ।

যাই হোক, সাবধানতা অবলম্বন করবেন এবং পরিবারের সবাইকে নিয়ে সুস্থ ও ভালো থাকবেন। যে পরিস্থিতি এখন! আমরা সবাই চাই পৃথিবীটা আবার স্বাভাবিক হয়ে যাক। সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে আপনার জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা।
সঙ্গীতাঙ্গন এবং আপনার জন্যেও রইল অনেক অনেক শুভকামনা।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles