– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে তাঁর প্রতিভা বিকশিত হয় পারিবারিক বন্ধন থেকে। বিশেষ করে দাদার বাড়ি বা বাবার বাড়ি থেকে বংশানুক্রমে চলে আসে। যদি ভাগ্যক্রমে কারো বাবা মায়ের দুই পরিবারেই থাকে সুর আর সঙ্গীতের প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ এবং যারা কিনা নিজেদের কাজ দ্বারা কিংবদন্তি হয়ে আছেন পৃথিবীর বুকে। সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করে কেউ কি ঘরের কোণে চুপ করে বসে থাকতে পারে! যার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে বইছে সুরের ঝংকার এবং সঙ্গীতের মূর্ছনা। তাই তো সে বিদেশ বিভূঁইয়ে গিয়েও সঙ্গীতকে আকড়িয়ে ধরে আছেন। শত ব্যস্ততার মাঝেও কাজ করে যাচ্ছেন যন্ত্রসঙ্গীত ও কণ্ঠসঙ্গীত নিয়ে। তাঁর নাম তানিম হায়াত খান রাজিত। যে কিনা একাধারে সরোদশিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীতশিল্পী। যিনি এই উপমহাদেশের সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের নাতি এবং সঙ্গীত গবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন খান ও ৬০দশকের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী ফওজিয়া ইয়াসমিনের পুত্র। বাবার দিক থেকে পারিবারিকভাবে আছেন অসংখ্য গুণী শিল্পী। যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সঙ্গীতভুবনে এক একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আবির্ভূত হয়েছেন, যেমন – ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ, ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক শেখ সাদী খান এরকম আরও অনেক গুণীজন। তেমনিভাবে মায়ের দিক থেকে আছেন বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন, নিলুফার ইয়াসমিন এবং সাবিনা ইয়াসমিন। সঙ্গীত জগতের সেই সৌভাগ্যবান ব্যক্তি তানিম হায়াত খানের সাথে সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে রহমান ফাহমিদার কথা হয় তাঁর সঙ্গীত জীবনের বিভিন্নদিক নিয়ে। সুদূর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি থেকে তিনি তাঁর মূল্যবান তথ্যগুলো সঙ্গীতাঙ্গনকে জানান। সঙ্গীতাঙ্গনের পাঠকদের জন্য তথ্যগুলো শেয়ার করা হল।
আপনার সঙ্গীত জীবনের সুত্রপাত কখন এবং কিভাবে ?
আমার সঙ্গীত জীবনের শুরু হয় তবলার মাধ্যমে, ১৫বছর বয়সে। আমি ছায়ানটে তিন বছর পণ্ডিত মদন গোপাল দাসের কাছে তবলার তালিম নিয়েছি। এরপর আমি পশ্চিমা সঙ্গীতের সাথে পরিচিত হই এবং মিউজিক ডিরেক্টর সজল দাসের কাছে আমি কর্ড প্রোগ্রেশন আর বেজ গিটার শিখি। ১৯৯৮সালে আমি পারিবারিক যন্ত্র ‘সরোদ’ হাতে তুলে নেই। আমার সরোদে হাতেখড়ি আমার চাচাতো ভাই উপমহাদেশখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান এর কাছে। পারিবারিকভাবে এই পরিবারে ৪/৫বছর বয়স থেকেই বাদ্যযন্ত্র হাতে তুলে দেয়া হলেও আমার সরোদের শুরু অনেক দেরিতে হয়, ২৩ বছর বয়সে।
এই উপমহাদেশের যন্ত্রশিল্প ও সঙ্গীতশিল্পের জন্য আপনার বাবা এবং মায়ের পরিবারের সদস্যগণ বিভিন্নভাবে বিখ্যাত। সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আপনার অনুভূতি কেমন এবং আপনার সঙ্গীতজীবনে তাঁদের অবদান কতটুকু ?
একটা কথা কি, জন্মটা তো ভাগ্য! কিন্তু নিজেকে তৈরি করার জন্য রেয়াজেরতো কোনো বিকল্প নেই। আমার সৌভাগ্য যে আমি এমন একটা পরিবারে জন্ম নিয়েছি, এই অনুভূতিটা অসাধারণ! যদিও আমি অনেকদিন পর্যন্ত জানতামই না যে, আমাদের বাবার দিকে সংগীতের এতো মারাত্মক গভীরতা। বাবা মা কেউ এগুলো নিয়ে আলোচনা করতেননা। কারণ তাঁদের কাছে পড়াটা ছিল খুব বেশি ইম্পরট্যান্ট। এমন মা বাবার ছেলেমেয়ে হিসেবে আমরা যে সংগীতকে প্রফেশন হিসেবে নেবো এটাই কি স্বাভাবিক না ? কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের বাড়িতে কখনোই গান-বাজনার আসর বসেনি। কখনোই বাবাকে আমি রেয়াজ করতে দেখিনি। বরং দেখেছি সারাটাক্ষণ বই পড়তে আর লেখালেখি নিয়ে থাকতে। তাই আমাদের হাতেখড়ি হলো বইয়ের সাথেই, সংগীতের সাথে না। মা দরজা জানালা বন্ধ করে প্রতিদিন সকালে রেয়াজটা চালিয়ে যেতেন, তাই ওই এক ঘন্টাই ছিল সংগীতের সাথে আমাদের সম্পর্ক। আমি তখন মায়ের কোলে শুয়ে থাকতাম যখন মা হারমোনিয়াম নিয়ে গলা সাধতেন। আমার গিটার শেখার বা সরোদ শেখার পুরোটাই, সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত উৎসাহ থেকে। তবে পড়াশুনা শেষ করে প্রফেশনাল ক্যারিয়ার করে অস্ট্রেলিয়াতে চলে আসবার পরে, মায়ের এই ব্যাপারে উৎসাহ ছিল অনেক এবং সে খুব উৎসাহ দিয়েছেন কারণ তখন এইটুকু নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল যে, আমি আর মিউজিককে ক্যারিয়ার হিসেবে নিচ্ছিনা।
বর্তমানে আপনি বাংলাদেশের বাইরে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন, সেখানে আপনার পেশা কি এবং আপনার পেশাগতক্ষেত্রে এত ব্যস্ততার মধ্যে সংগীত সাধনার জন্য কিভাবে সময় বের করে নিচ্ছেন ?
আমি পেশায় একজন একাউন্টেন্ট। আমি চার্টার্ড একাউন্টিং ফার্ম পিটিওয়াই (Pty Ltd)-এ চাকরি করে এখন ডিপার্টমেন্ট অফ এডুকেশন নিউ সাউথ ওয়েলসের TAFE Digital -এ হেড অফ একাউন্টিং হিসাবে শিক্ষকতা করছি। সময় বের করে নেয়াটা একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ তবে প্যাশন থাকলে সেটা বের করে নেয়া সম্ভব বলে মনে করি। তবে এই ব্যাপারটা আমার অর্ধাঙ্গিনী সুমি আর দুই ছেলেমেয়ে তুর্য আর তূর্ণার সহযোগিতা না থাকলে কখনোই মিউজিক নিয়ে যতটুকু এগিয়েছি ততটুকুও এগোতে পারতাম না।
সংগীত না যন্ত্রশিল্প! কোনটি বেশী আকর্ষণ করে আপনাকে ? সরোদ ছাড়া আর অন্য কোনো যন্ত্রশিল্পের প্রতি আপনার কি কোনো অভিজ্ঞতা আছে ?
দুটোতেই আকর্ষণ আছে তবে আমি আগে সরোদ শিল্পী, পরে একজন গায়ক ও সুরকার। যেহেতু মায়ের দিক থেকে গানটা এসেছে তাই গান গাইছি, তবে সেটা শখে। আর আমার বিখ্যাত চাচারা সবাই যন্ত্রসংগীত বাজানোর পাশাপাশি দারুন সুর করতেন। তাই আমার মাঝেও সেটা চলে এসেছে। এখন পর্যন্ত আমার সুরে প্রচুর গান রিলিজ হয়েছে। এ বছরে আমার সুরে আরও ১০টা গান রিলিজ হবে। যার একটা গান আমার ছোটখালা সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে আমার ডুয়েট করা। এটাও আমার জন্য একটা বড় সৌভাগ্য এবং মাইলস্টোন। সরোদ ছাড়াও আমি তবলা, গিটার, দোতারা বাজাতে পারি।
আপনি তো একজন সরোদশিল্পী পাশাপাশি মিউজিক কম্পোজার ও সংগীতশিল্পী। আজকাল যে কোনো শিল্পী একটি গান নিজেই লেখেন, নিজেই সুর করেন আবার নিজেই সেই গানটি গান। সেই সাথে একুস্টিক যন্ত্রের ব্যবহার নেইই বলা চলে! শুধুমাত্র একটি কম্পিউটারে সফটওয়্যার ব্যবহার করে একটি গান রেকর্ডিং হয়। সেই ক্ষেত্রে আগে একটি গানের পেছনে যে শ্রম দেয়া হতো তা কিন্তু নেই! আগে একটি গান রেকর্ডিং-এর ক্ষেত্রে গীতিকার, সুরকার এবং শিল্পীর মধ্যে সমন্বয় ছিল এবং যার যার কাজ সে সে করতো। একটি টিমওয়ার্ক ছিল। আপনার কাছে একটি গান রেকর্ডিং -এর ক্ষেত্রে কোন্ বিষয়টাকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে মনে করেন ?
আমি এই একটা জায়গাতে আবার পুরানো স্টাইল-এ ফিরে গেছি, যদিও শুনতে অদ্ভুত লাগতে পারে যে কি করে আমি সিডনিতে বসে গীতিকার, সুরকার আর শিল্পীদের সাথে একসাথে বসে কাজ করি! উত্তর হলো টেকনলজি। আমি একটা সুর করবার সময় গীতিকারের সাথে অনলাইনে থাকি, সুর করতে করতে যদি শব্দের কোনো পরিবর্তন দরকার হয় বা শব্দের কারণে সুরের পরিবর্তন করতে হয় তখন সেটা সাথে সাথেই আলোচনা করে নেই। কাজেই আমি টিমওয়ার্কটা কিছুটা হলেও করতে পারছি। আর আমার যে গানগুলো তৈরি হয় সেগুলোতে একুইস্টিক মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট থাকবেই তাতে খরচটা বেশী পড়লেও গানে প্রাণ থাকে। শুধু সফটওয়্যার ভিত্তিক গান আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব একটা পছন্দ নয়। আর আমি শুধু একজন মিউজিক ডিরেক্টরের সাথেই কাজ করি যার নাম এজাজ ফারাহ্। যিনি নিজেও ক্লাসিক্যালই ট্রেইন্ড। তাতে আমাদের কেমিস্ট্রিটা দারুণ জমে।
৮০/৯০দশকের গান, যে গানগুলো এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে এখনো বিরাজ করছে এবং বর্তমান সময়ের গান যা কিনা ইউটিউবে রিলিজ হয়ে মাস যেতে না যেয়েই হারিয়ে যাচ্ছে অথচ ভিউয়ারস মিলিয়নও ছাড়িয়ে যাচ্ছে! সেই সময়ের গান আর এই সময়ের গানকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন, আপনার অভিজ্ঞতার আলোকে ?
আমি ব্যক্তিগতভাবে ভিউ দিয়ে গানের মূল্যায়ন না করলেও এটাই এখন একটা গানের সাফল্যের চাবিকাঠি হয়ে যাচ্ছে, তবে এটাই ঠিক মিলিয়ন ভিউ মানেই যে সে গান স্থায়িত্ব পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আসলে এখন আমাদের হাতে অপশন বেশি। প্রথম ২০সেকেন্ডে গান পচ্ছন্দ না হলে আমরা ইউটিউব থেকে অন্য লিংকে চলে যাই বা টিভি চ্যানেল বদলে ফেলি। আগে কিন্তু সেই অপশন ছিলনা। কাজেই শ্রোতাদের মনোযোগ পাবার মত পর্যাপ্ত পরিমান সময় একজন সুর স্রষ্ঠার বা গায়ক/গায়িকার ছিল। যেকারণে মানুষ পুরো গান শুনে জাজ করত, গানটির ভালো মন্দ। টেকনোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্টের সাথে সাথে আমাদের শোনার ধৈর্য্যও কমে গেছে। এটার কারণে একটা গান শুনতে শুনতে ভালো লেগে যেতে পারে, এই সুযোগটা বড়ই কম এখন। ভালো গান আগেও হতো, এখনো হচ্ছে তবে শোনার মাধ্যমের আধিক্যের কারণে আর গান স্কিপ করে যাবার অপশন থাকার কারণে এখনকার গানগুলো স্থায়িত্ব পাবার সম্ভাবনা কমে যাচ্ছে।
আপনার সন্তান কয়জন ? তারা কি সংগীতের সঙ্গে যুক্ত আছেন ?
আমার একছেলে তুর্য (আরিয়ান তাহজীব খান) আর এক মেয়ে তূর্ণা (রিনান আরশি খান)। তুর্যর সরোদে হাতেখড়ি হয়েছে আর তূর্ণা ওয়েস্টার্ন ক্লাসিক্যাল ভোকাল শিখছে মিউজিক স্কুলে গিয়ে। তবে আমার মেয়েরও গানের থেকে পারিবারিক ট্রেন্ড যন্ত্রের দিকে আগ্রহ বেশি। তবে ওরা দুজনে আমার বাবামায়ের মত চিন্তা করে, যেমন আমার মত রেগুলার প্রফেশনের পাশাপাশি মিউজিককে রাখবে।
আপনার স্ত্রী আপনাকে সংগীতশিল্পী হিসেবে না সরোদশিল্পী হিসেবে দেখতে বেশী পচ্ছন্দ করেন ?
সরোদশিল্পী হিসেবে। আমিও নিজেকে সেটাই দেখতে ভালোবাসি। কারণ এটাই আমাকে আরও অনেকের থেকে আলাদা করে। এই সরোদ বাজিয়েই আমি ২১তম কমনওয়েলথ গেমসে বাংলাদেশকে রিপ্রেসেন্ট করেছি অস্ট্রেলিয়ার গোল্ডকোস্টে। সাথে ছিল অন্যান্য দেশের মিউজিশিয়ান, যেমন- ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার।
যন্ত্রসংগীত এবং সংগীত নিয়ে আপনার কি ভবিষ্যতে কিছু করার কোনো পরিকল্পনা আছে ?
নিজেকে আরও তৈরি করা, রেয়াজ করে যাওয়া, বাজনাটাকে পরের লেভেলে নিয়ে যাওয়া, জীবনভর সাধনা করা। গান আর সুরকার হিসাবে যা করবো সেটাই বোনাস, না হলেও কোনো আপসোস নাই।
বর্তমানে আপনি কি নতুন কোনো কাজ করছেন ?
আমি কাজের মানুষ। নতুন কিছু নিয়ে না থাকতে পারলেই অস্থির লাগে। আগেই বলেছি আমার সুরে দশটি গান আসছে সামনে, এছাড়াও সরোদের দুইটি ফিউশন রিলিজ হবে শীঘ্রই। তারমাঝে একটা দীপ্তি অরণীর আইরিশ Whistle-এর সাথে সরোদের ফিউশন।
সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে, এত ব্যস্ততার মাঝে সঙ্গীতাঙ্গন এর একক সঙ্গীত সন্ধ্যায় অংশগ্রহনের জন্য অনেক ধন্যবাদ এবং সেই সাথে শুভকামনা রইল আপনার ও আপনার পরিবারের জন্য।
আপনাকেও ধন্যবাদ এবং শুভকামনা রইল সঙ্গীতাঙ্গন এর জন্য।
আজ শুক্রবার ছুটির দিন (৬ই নভেম্বর ২০২০) সন্ধ্যা ৬টায় এই বিশিষ্ট সরোদ শিল্পী, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী ‘সঙ্গীতাঙ্গন’ পত্রিকার ফেইসবুক পেইজে ‘একক সঙ্গীত সন্ধ্যা’য় লাইভে আসছেন সঙ্গীত প্রিয়দের গান শোনাতে ও আড্ডা দিতে। সঙ্গীত শিল্পী তানিম হায়াত খান রাজিত এর সাথে লাইভে যুক্ত হতে চোখ রাখুন সঙ্গীতাঙ্গনের ফেইসবুক পেইজে।
www.facebook.com/shangeetangon অথবা এই পেইজের সাথে যুক্ত থাকুন।