মাঝে মাঝে আব্বা শখ করে তবলা বাজাতেন – নায়করাজ রাজ্জাকের তনয় নায়ক সম্রাট…

– কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।

জন্মের শুরু থেকেই মানুষ গানের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হয়ে পড়ে। কেননা এমন কোনো মানুষ নেই যে কিনা শিশুকাল থেকে মায়ের মুখে ঘুম পাড়ানী গান না শুনে ঘুমিয়েছে। গানের সাথে যারা যুক্ত যেমন-গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক ছাড়াও প্রত্যেকটি মানুষ তাঁর মনের অজান্তেই গুণ গুণ করে গান গেয়ে উঠে। এমনকি দেখা যায় যে, কিছু মানুষ বাথরুমে চিৎকার করে গান করে, তাই তাঁদেরকে বাথরুম সিঙ্গার বলেও উপাধি দেয়া হয়। তাই বলা যায় গান সকলেই পচ্ছন্দ করে এবং গান না গাইলেও গানের প্রতি অসীম দুর্বলতা অনেকের মধ্যেই আছে। আজকে এমনই একজন মানুষ, যে কিনা অন্য জগতের মানুষ হয়েও গানের প্রতি দুর্বলতার কারণে গান নিয়ে কথা বলেছেন। সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে রহমান ফাহমিদার সাথে তিনি গানের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি হচ্ছেন আমাদের সকলের প্রিয় নায়করাজ রাজ্জাকের পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান, নায়ক সম্রাট। যার পুরো নাম খালিদ হোসাইন সম্রাট। নায়ক সম্রাটের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – মন দিয়েছি তোমাকে, কাজের মানুষ, আয়না কাহিনী ইত্যাদি। নায়ক সম্রাট ও রহমান ফাহমিদার মধ্যে সালাম এবং কুশল বিনিময় হয়ে যাওয়ার পর রহমান ফাহমিদা নায়ক সম্রাটের কাছে জানতে চান এইভাবে –

সঙ্গীতাঙ্গন যদিও সঙ্গীত বিষয়ক ম্যাগাজিন এবং আপনি গায়ক না তবে নায়ক! আপনার কাছে জানতে চাইছি, আপনি যেহেতু অভিনয়ের মধ্যে আছেন আপনি কি কখনো গান করেছেন অথবা গানের প্রতি কি আপনার এমন কোনো দুর্বলতা আছে ?

না, আমি গান করিনি। আমি গান গাইতে পারিনা এইজন্যে গান করা হয়নি। তবে আমি মিউজিক খুব পচ্ছন্দ করি এবং ছোটবেলা থেকেই মিউজিকের প্রতি খুব দুর্বল।

কি ধরণের গান আপনার পচ্ছন্দ ? রক, ফোক, মেলোডি, না অন্য ধারার কোনো গান।

আমার মেলোডি খুব ভালো লাগে। রোমান্টিক মেলোডি খুব পচ্ছন্দ। দেখা যায় মেলোডি কিছু আছে যা একুস্টিক ইনস্ট্রুমেন্টালে হয়। যেমন অর্কেস্ট্রা ইনস্ট্রুমেন্টালে হয় সেগুলি খুব পছন্দ। হেভি মেটাল রক বা যে গুলো একটু বেশী চিৎকার চ্যাঁচামেচি আছে ওগুলো পছন্দ না। একটু সফট টাইপের গান বেশী ভালো লাগে।

বাংলাদেশেতো অনেক ব্যান্ড আছে। সেই ব্যান্ডগুলোর মধ্যে কারো গানকি ভালো লাগে আপনার ?

আমার ব্যক্তিগত চার্টে আছে – সোলস, এলারবি ও মাইলস। এই তিনটি ব্যান্ডের গান আমি বেশী শুনেছি। এখনো ভালো লাগে তাঁদের গান।

আপনার বাবা নায়করাজ রাজ্জাক তো চলচ্চিত্রে বহু গায়কের গানের সাথে লিপ্সিং করেছেন। এমন কি কখনো হয়েছে যে, আপনাদের ছোটবেলায় মজার ছলে আপনাদেরকে নিয়ে কোনো গান করেছেন ? হয়তো বা তিনি নিজে নিজে কখনো গান করেছেন।

না, এমন কখনো হয়নি বা দেখিনি! তবে যেটা ছিল আমাদের বাসায় তা হল, আমার মা গান শিখতেন। আমার মায়ের গানের মাস্টার ছিল। আমার মা হারমোনিয়ামও বাজাতে পারতেন। আমাদের বাসায় হারমোনিয়ামের সাথে একসেট তবলা ছিল। মাঝে মাঝে আব্বা শখ করে তবলা বাজাতেন। দেখা যেতো, মা গান গাচ্ছেন আর আব্বা তবলা বাজাচ্ছেন, তা আমি দেখেছি। তাছাড়া আব্বার ভায়োলিনের শখ ছিল, একটা ভায়োলিনও ছিল আমাদের
বাসায় তবে আব্বাকে খুব একটা বাজাতে দেখিনি! সেরকম কোনো স্মৃতি নেই আমার। পরবর্তীতে ঐ ভায়োলিন নিয়ে আমি খেলতাম। যেহেতু মা গানের ট্রেনিং নিয়েছিল এবং ছোটবেলা থেকে দেখতাম মা গান গাইছে, তখন থেকেই আমার গানের প্রতি ভালো লাগা আলাদাভাবে ছিল আরকি! তবে কখনো গান করিনি।

আপনার আম্মা কি ধরনের গান গাইতেন ?

আধুনিক গান করতেন। আধুনিক কয়েকটা গান করেছেন বা প্রাকটিস করেছেন তবে আমরা বড় হয়ে যাওয়াতে তাঁর ব্যস্ততা বেড়ে গেল! তারপর আর হয়ে উঠেনি।

আপনার আব্বার তো অনেক সিনেমা আছে সুপার ডুপার হিট! সেই সাথে সিনেমার গানগুলিও অনেক জনপ্রিয়। এমনকি অনেক গান এখনো এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে ফেরে। আপনাদের কি এরকম কোনো ইচ্ছে আছে। নায়করাজ রাজ্জাকের জনপ্রিয় গানগুলি আপনাদের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রচার করার ?

হ্যাঁ, এরকম প্লান আছে কারণ আব্বার গানগুলো তো এখনো যথেষ্ট পপুলার। খুব তাড়াতাড়ি হয়তোবা গানগুলি নিয়ে আসব আব্বার ভক্তদের জন্য।

আপনার আব্বাদের সময়ের গান এখনো মানুষ শুনছে। আর এখন একটি গান জনপ্রিয়তা পেতে না পেতেই আরেকটি গান আসছে এবং আগের গানটি হারিয়ে যাচ্ছে! আপনাদের সময়ের এখনকার গান এবং আপনার আব্বাদের সময়ের গানগুলিকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন ?

কারণ আব্বাদের সময় গানের মেলোডি ভালো ছিল। আমার জন্ম তো ৮০’তে। আমি গান কিছু কিছু বুঝতে শিখি ৮৬/৮৭ থেকে। সেই ছোটবেলায়। আমি গানকে পরিপূর্ণভাবে উপলদ্ধি করেছি সেই ৯০-এর দিকে। ৯০-এর শেষের দিকের গানগুলি কিন্তু সবচেয়ে মেলোডিয়াস ছিল। সেটা বাংলা সিনামায় বলেন আর হিন্দি সিনেমায় বলেন। এখনো দেখা যায় আমি ঘুরেফিরে ঐ গানগুলি পচ্ছন্দ করি এবং শুনি। ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত গানগুলি আছে। এখন সেগুলো হয়কি! আমাদের মিউজিকগুলো এখন কম্পিউটারে হয়। টেকনোলজি ইউজ হয়। ভয়েজ মডুলেশন ইউজ হয়। ফলে দেখা যায়, যে গান হচ্ছে একবার শুনতে ভালো লাগছে, শ্রুতিমধুর হচ্ছে কিন্তু গানটির মেলোডি থাকেনা আর ইমোশন কাজ করেনা। আর আগেরকার গানগুলিতে যান, ৮০/৯০ দশকের গানগুলি যেরকম আপনি বুঝতে পারছেন, আর কথাগুলো ইউজিয়্যালী বুঝা মানেই কিন্তু আপনার ইমোশন কাজ করা! তার সংগে ছিল মেলোডিয়াস গানের সুর, মিউজিক এ্যারেন্জমেন্ট, মিউজিক ব্যাকিংগুলোও ছিল খুব সুন্দর। তখন মিউজিক একুস্টিক ভায়োলিন, একুস্টিক গীটারগুলো ইউজ করত আর সবচেয়ে ভালো ছিল ফ্লুট! যেগুলো ইউজ করত, এত
ভালো লাগতো। এখন আপনি দেখেন ভায়োলিন, একুস্টিক গীটার বলেন সবকিছু চলে আসছে সফটওয়্যারে। বাঁশী যেমন তেমন একটা বাজায়না কেউ। অনেক ইনস্ট্রুমেন্ট এখন কেউ বাজায় না এবং যে বাজাবে,দেখা গেল সেও নাই। এখন হয়েছে কি গানে টাচিং জিনিসগুলো নাই। এখন দেখা যায় একটি গান ধুপধাপ হচ্ছে, খুব সুন্দর লাগছে, ভিডিওগুলো কালারফুল করছে, ছেলেমেয়েরা নাঁচানাঁচি করছে কিন্তু ঐ যে রোমান্স ছিল, ইমোশন ছিল একটি গানের সেন্টিমেন্ট ছিল যেমন – স্যাড সং শুনলে মন খারাপ লাগতো, রোমান্টিক সং শুনলে ভালো লাগত বা একটি হ্যাপী সং শুনলে মনের মধ্যে একটা জয় ফিলিং আসতো, ঐ জিনিসগুলো কিন্তু এখন নাই। এখন দেখেন আপনি, একই রিদমে রোমান্টিক, স্যাড সব গান হচ্ছে। সব সিচুয়েশন একটার মধ্যে চলে আসছে। তার মানে কি ? গান শোনার চেয়ে দেখার বিষয়টা প্রাধান্য পাচ্ছে বেশী।

হয়তো এ জন্য গানের মূলধারা হারিয়ে যেতে বসেছে!

হ্যাঁ, ঠিক তাই! আমরা কেন এখনো ৯০ দশকের গান শুনি, ২০ বছর হয়ে গেছে এখনো সেই গানগুলো শুনতে ভালো লাগে কেন ? কারণ গানে রিদম ছিল, মেলোডি ছিল ও ইমোশন ছিল।

এখন কিন্তু ঐ গানগুলো রিমেক করছে!

উপায় নাই তো রিমেক না করে! এখন নিজেরা ঐ ধরণের গান করতে পারছেনা বলেই তো আগের গানগুলি রিমেক করছে।

আপনি এখনো পর্যন্ত যে গানগুলি শুনেন, কোন্ কোন্ শিল্পীর গান আপনার ভালো লাগে, দেশের এবং দেশের বাইরে ?

আমি ইন্ডিয়ান গানগুলি শুনলে অলওয়েজ মেলোডিতে যাই। ইদানিং অরজিৎ সিং-এর গান বেশী ভালো লাগে। কুমার সানু ও উদিত নারায়ণের গান আমি এখনো শুনি। মেয়েদের মধ্যে শ্রেয়া ঘোষালের গান ভালো লাগে। তারপর আগে ছিল অনুরাধা পাড়োয়াল, মিষ্টি গলা ছিল তাঁর ঠিক আছে! তারপর অলকা ইয়াগনীর গান ভালো লাগে। আমাদের দেশে এন্ড্রু কিশোরের গান, তপন চৌধুরীর গান ভালো লাগে। মাইলসের কথা তো আগেই বলেছি, হামিন আহমেদ, শাফিন আহমেদের গান ভালো লাগে। আইয়ুব বাচ্চু সাহেবের গানগুলা কেন মনে ধরত কারণ গানের মত গান ছিল। এখন প্রতিক অনেক ভালো গায়। ইমরানের গানও ভালো লাগে। যেই গানগুলোর সুর ভালো কথা ভালো সেই গানগুলি ভালো লাগে। শিল্পী ব্যাপার না, সুর কথাই গানের মূল বিষয়। তাছাড়া আমি ইংরেজি গান বেশী শুনি। ইংরেজি গানের মধ্যে ইনস্ট্রুমেন্ট বেশী শুনি। আমি খুঁজে খুঁজে ডিফারেন্ট টাইপের বিভিন্ন দেশের গান বের করি। দেখি কোন গানের সুরটা ভালো, মেলোডি ভালো যেটা আমাকে টাচ করে। আমি কিছুদিন আগে নতুন একটা ব্যান্ড খুঁজে পেলাম, IVAN TORRENT-কে অর্কেস্টাল মিউজিক করেন। এত সুন্দর মিউজিক কম্পোজিশন! আমার
মনে হয় বিশাল অর্কেস্ট্রা নিয়ে বাজাচ্ছেন। আমি জানি না সে কম্পিউটার প্রোগ্রাম করে না রিয়েল অর্কেস্ট্রা ইউজ করে! গানগুলো শুনে আমার খুব ভালো লাগলো বিভিন্ন সিচুয়্যাশোনাল মিউজিক করে সে। তারপর আমি শুনছি ALAN WALKER -এর গান। একটু সফটটাইপের মিউজিক করে নরমালি ও হল ইউরিপিয়ান ডিজে কিন্তু তার গানের মধ্যে মেলোডি আছে। গানের যে কথাগুলো যে ছেলে বা মেয়েগুলোকে দিয়ে গাওয়ায় সে, দেখলাম খুব ভালো মিউজিশিয়ান। তারপর এক সময় একটা অস্ট্রেলিয়ান ব্যান্ড ছিল SAVAGE GARDEN। এখন হয়তো ওরা কন্টিনিউ গান করেনা। MARK ANTHONY-র গান ভালো ছিল। অনেক শিল্পীর গান ভালো। দেখা যায় ওদের দেশের গানে কিন্তু মেলোডি আছে। দেখা যায় মেলোডি আছে যে গানগুলো সেগুলো হিট করে যায়। MICHAEL JECKSON-র সব গানই ভালো লাগে।

আজকাল যা হচ্ছে, গানের মূলধারা হারিয়ে গেছে কারণ যে শিল্পী সেই গীতিকার এবং সেই সুরকার।

হ্যাঁ, সেইই সব! সে অল ইন ওয়ান। যেরকম আমাদের হাবীবের প্রথম দিকের চার পাঁচটি গান এত সুন্দর ছিল, খুব ভালো লাগতো। আমি হাবিবের গান শুনতাম। হৃদয় খানের প্রথম এ্যালবাম খুব ভালো লাগত। যেমন আমাদের আরেফিন রুমির প্রথম গানগুলি সুন্দর লাগতো কিন্তু পরে টেকনো করতে গিয়ে বা মর্ডান পপ করতে গিয়ে গানগুলি লাগছে ভাল কিন্তু কেমন যেন মেকানিক্যাল হয়ে গেছে! আগে যেমন দরদ ছিল ইমোশন ছিল তা নাই কেমন যেন ড্রাই হয়ে গেছে টোটাল ব্যাপারটা! ডিফারেন্সটা হল এটা, আগের গানের সাথে এখনকার গানের।

আপনি এখন কি কি কাজ করছেন ভাইয়া!

আমি এখন ফ্যামিলি বিজনেস চালাচ্ছি সেই সাথে নিজের ব্যবসাবাণিজ্য, জাস্ট এগুলো দেখাশুনা করছি। মিডিয়াতে আগের মত কাজ করছিনা।

আপনার কয়টি মেয়ে ?

আমার দুইটি মেয়ে।

আপনার আম্মা কেমন আছেন ?

মাশাআল্লাহ ভালো আছেন।

আপনার আব্বার না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার, আগের কিছু স্মৃতি যদি তাঁর ভক্তদের জন্য শেয়ার করতেন! শেষের কিছুদিন তো তাঁর শরীর অনেক খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

হ্যাঁ, ২০১৫ থেকেই আব্বার শরীরে নানান রকম সমস্যা দেখা দিয়েছিল। বেশিরভাগ সময় অসুস্থ থাকতেন বলে কারো সাথে দেখা করতে চাইতেন না এবং কোথাও যেতেই চাইতেন না। সে বলত সারাজীবন এত কাজ করছি এত বাইরে ছিলাম, বাসায় থাকি, একটু রেস্ট নেই। তাই বাসায় বসে বসে টিভিতে ক্রিকেট খেলা বা ফুটবল খেলা ইত্যাদি দেখতেন আর আমার মেয়েদের সাথে খেলতেন। এই কারণে আসলে বাইরের জগত থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। মসজিদে যেত আর মসজিদ থেকে বাসায় আসতো। খেতেন, ঘুমাতেন আর টিভি দেখতেন। আব্বা ৮বার হজ্জ করেছিলেন। ১৯৮৩ থেকে শুরু করেছিলেন, ২০০৯ এ শেষ বার হজ্জ করেন। দোয়া করবেন আমার আব্বার জন্য।

আল্লাহ্‌ আপনার আব্বাকে এবং আমাদের সবার প্রিয় নায়করাজ রাজ্জাককে জান্নাতবাসী করুন, আমীন।

আপনার সাথে কথা বলে অনেক ভালো লাগলো। সময় দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে আমি রহমান ফাহমিদা আপনার জন্য এই দোয়া করছি, আপনি আপনার কাজ নিয়ে অনেকদুর এগিয়ে যান এবং শুভকামনা রইল আপনার পরিবারের সকলের জন্য।

সঙ্গীতাঙ্গন ও আপনার জন্যেও রইল অনেক অনেক শুভকামনা।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisement -

Latest Articles