– মোশারফ হোসেন মুন্না।
৬৪ কলার মধ্যে সঙ্গীতকে বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ কলা বিদ্যা। সঙ্গীত সম্পর্কিত প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থ ‘সঙ্গীত পারিজাত’ গ্রন্থের রচয়িতা অহোবল সঙ্গীতের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘গীতং, বাদ্যং, নৃত্যং ত্রয়ং সঙ্গীত মূচ্যতে’ অর্থাৎ গান, বাদ্য ও নাচ এই তিনটির সম্মিলিত রূপকেই সঙ্গীত বলে। কিন্তু শাস্ত্র যাই বলুক মনের কথা সুর দিয়ে প্রকাশ করাকেই সঙ্গীত বলে মনে করি আমরা। সে হোক যন্ত্র, মন্ত্র, কণ্ঠ কিংবা নৃত্যের মাধ্যমে। সঙ্গীতের উৎপত্তি
মানব সৃষ্টির মতই অজানা। কখন ও কোথায় এ রহস্য কিন্তু আজও উন্মোচিত হয়নি। কোনটা কার আগে সৃষ্টি তার সঠিক তথ্য আজও মেলেনি। কিন্তু সৃষ্টিতত্ত্ব অজ্ঞাত থাকলেও রয়েছে এর ধারাবাহিকতা। ধারাবাহিকতার আদলে উদ্ভব হয়েছিল সঙ্গীতের নতুন নতুন ধারা ও রূপ, আবার পালাক্রমে তা হয়েছে লুপ্ত। সঙ্গীতের উৎপত্তি ও বিকাশ সম্পর্কিত আলোচনা বিশ্ব সঙ্গীতের আলোকে করা বেশ গবেষণা ও সমন্বয়ের বিষয়। অন্যদিকে বিশ্বসঙ্গীতে ভারতীয় উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রয়েছে বিপুল প্রভাব বিস্তারকরনের ক্ষমতা। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বলতে যদি কেউ বুঝে থাকেন বর্তমান ভারত নামক দেশের সঙ্গীতকে তাহলে বিরাট ভুল হবে। ৪০০০ বছর পুরানো ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দাবীদার ও চর্চার ক্ষেত্র শুধু বর্তমান ভারত নয়, বৈদিক যুগ হতেই সমগ্র উপমহাদেশ (বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ) এ সমৃদ্ধ সংস্কৃতির গর্বিত ধারক ও বাহক।
ভারতীয় উপমহাদেশের পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ এমনকি পশ্চিমা দেশগুলোতে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রভাব অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ স্থানে থাকার প্রেক্ষিতে ভারতীয় সঙ্গীতের আলোকে সঙ্গীতের উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে গবেষণা করা উপযুক্ত মনে করেন অনেকে। ভারতীয় সঙ্গীতের ভিত্তি গড়া এবং পর্যায়ক্রমে বেড়ে উঠতে লেগেছে হাজার যুগ ও মনিষীদের অবদান। ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গীতের উদ্ভব ও বিকাশকে নিন্মোক্ত ৫টি যুগ ভেদে ভাগ করে তুলে ধরা যায়:-
সিন্ধু সভ্যতা যুগ, বৈদিক যুগ, বৈদিকত্তর যুগ, মধ্যযুগ, আধুনিক যুগ।
সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠা সিন্ধু সভ্যতায় প্রকৃতি পূজারী মুনি-ঋষিদের কাছে ভারতীয় সঙ্গীত হল দেবদেবী হতে প্রাপ্ত ঐশ্বরিক জ্ঞান। সে সময় সাম বেদের মন্ত্র গুলি সাধারণভাবে গাওয়া হত, তাই প্রথম অবস্থায় ৩ টি নোট(সা, রে, গা) দিয়েই কাজ চলে যেত। মন্ত্র উচ্চারণের স্বরগমও ছিল সহজ। যেমন – গা গা – রে রে -সা সা সা । উপমহাদেশের প্রাচীন সঙ্গীতের পরিচয় পাওয়া যায় সিন্ধু সভ্যতা যুগে (খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০-২০০০) পাওয়া মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার অনেক মূল্যবান নিদর্শনের পাশাপাশি নানা প্রকার চামড়ার বাদ্যযন্ত্র, তন্ত্রীযুক্ত বীণা, বাঁশী, মৃদঙ্গ, করতাল ও নৃত্যশীলা নারীমূর্তি ইত্যাদির মাধ্যমে। এ যুগের শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট উন্নত ছিল বলে জানা যায়।
বৈদিক যুগ – খ্রিষ্টপূর্ব (২০০০-১০০০):
বৈদিক যুগে খ্রিষ্টপূর্ব (২০০০-১০০০) গড়ে উঠা ‘সামগ’ নামে আচার্যদের তত্ত্বাবধানে তিনটি স্বরকে (স ম গ) নিয়ে সামবেদের মন্ত্রগুলোকে সুর করে গাওয়া হত। তাছাড়া, বেদের মন্ত্রগুলোকে সুর দিয়ে গাওয়ার জন্য সাম বেদ নামে আলাদা একটি অংশ ভাগ করা হয়। সামবেদের সঙ্গীতকে আবার চার ভাগে ভাগ করা হয়, যার মধ্যে দু’ধরণের গান ছিল; সমবেত সঙ্গীত, আর বাকি দু’ধরণের ছিল একক সঙ্গীত। একপর্যায়ে ঋষিরা লক্ষ্য করেন তিনটি নোট দিয়ে কাজ চলছিল না। প্রকৃতি পূজারী ছিলেন বিধায় সবকিছুতেই প্রকৃতি নির্ভর ছিলেন প্রাচীন ঋষিরা। বিভিন্ন পশুপাখির আওয়াজ শুনে তাঁরা তৈরি করলেন সাতটি স্বর বা নোট। যথাক্রমেঃ
ষড়জ (সা), ঋষভ (রি), গান্ধার (গা), মধ্যম (মা), পঞ্চম (পা), ধৈবত (ধা), নিষাদ (নি)।
সামবেদে মোট ৪৯ রকমের তাল, ২১ রকমের মূর্ছনা আর ৭ টি মূল স্বর এর উল্লেখ আছে। ভিন্ন ভিন্ন দেবতা হতে প্রাপ্ত জ্ঞান হিসেবে বিভিন্ন প্রাণীর ডাকের সাথে মিলিয়ে প্রাচীন ঋষিরা স্বরগুলোর অন্তর্নিহিত অর্থ রেখে দেহের অভ্যন্তরীণ যোগশাস্ত্রের আধ্যাত্মিক চক্রে প্রতিস্থাপন করে স্বরগুলোকে প্রচলন করেন।
বৃটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক স্টুয়ার্ট পিগট বৈদিক যুগের গানে সাত সুরের ব্যবহার নিয়ে বলেছিলেন, ‘There are some interesting evidence for Aryan Music. Cymbals were used to accompanying dancing, and in addition to this and the drum there were reed flutes or pipes, a stringed instrument of the lute class, and sharp of lyre which is mentioned as having seven tones or notes. This last piece of information is important for our knowledge of ancient music.’।
আজ এই পর্যন্তই। বাকি তিনটি যুগ নিয়ে অন্য কোন দিন লিখবো। আপনাদের সঙ্গীত বিষয়ে আমাদের লেখা দিয়ে এতোটুকু উপকার হলেও আমরা স্বার্থক। সবার সুন্দর সুস্থ সুখী জীবন কামনায়।