asd
Saturday, September 28, 2024

জয় বাংলার লোক, ড্যাবা ড্যাবা চোখ…

– মোশারফ হোসেন মুন্না।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গাওয়া শিল্পী আব্দুল জব্বারের শেষ গানটি ছিল –
‘বাংলাদেশের হৃদয় তুমি
তুমি বাংলার মিতা,
আমরা সবাই একটি জাতি,
তুমি জাতির পিতা’।

গানটি লিখেছেন গীতিকবি আমিরুল ইসলাম। বেইলি রোডের একটি স্টুডিওতে গোলাম সারোয়ারের সুরে আব্দুল জব্বার গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বলে জানান আমিরুল। গান, আব্দুল জাব্বার ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমিরুল তার স্মৃতিচারণায় লিখেছেন, জব্বার ভাই আড্ডা প্রিয় ছিলেন। আমার খুব মনে পড়ে, সেদিন জব্বার ভাই অনেক গল্প করেছিলেন। তার মুখে অসংখ্যবার বঙ্গবন্ধুর কথা শুনেছি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসার কথা শুনেছি। যতদিন জব্বার ভাইয়ের সান্নিধ্যে ছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে বাবা বলে ডাকতে শুনেছি। তার কাছ থেকে জেনেছি তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক টেবিলে ভাত খেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুকে গান শুনিয়েছেন। জব্বার ভাই বলতেন, ‘বাবা আমাকে জাতীয় কণ্ঠশিল্পীর মর্যাদা দিয়ে গেছেন। আশীর্বাদ করে গেছেন। এটা আমার বিরাট সৌভাগ্য। মাঝে মধ্যে বাবা আমাকে ডেকে পাঠাতেন। আমার গান শুনতেন। বলতেন, পাগলা, সাবধানে থাকিস। তোর অনেক দায়িত্ব।’

শিল্পী আব্দুল জব্বারের অস্তিত্বজুড়ে ছিল নিখাদ দেশপ্রেম।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি একটি গানের এ্যালবাম করতে চেয়েছিলেন। সে সময় আর তিনি পেলেন না। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আরেকটি গান লিখতে বলেছিলেন।
‘বঙ্গবন্ধু দেখেছি তোমায়
দেখেছি মুক্তিযুদ্ধ,
হায়েনাদের তাড়িয়ে দিয়ে
করেছ মাটি শুদ্ধ’।
– এমন কথার একটি গান লিখেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর গানটি রেকর্ড করা হলো না।
আব্দুল জব্বার প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কথা খুব বলতেন। শিল্পীর ‘শোন বন্ধু শোন, প্রাণহীন এই শহরের ইতিকথা’- গানটি তার খুব প্রিয় ছিল। তিনিও জব্বার ভাইয়ের ‘তুমি কি দেখেছ কভু’ গানটির প্রশংসা করতেন। মাঝে মধ্যে তিনি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাসায় যেতেন, খেতেন। তার স্ত্রী হাসতে হাসতে জব্বার ভাইকে বলতেন, ‘জয় বাংলা লোক, ড্যাবা ড্যাবা চোখ’।

শিল্পী আব্দুল জব্বারের গান কে না ভালবাসতেন। সাধারণ দর্শক-শ্রোতা থেকে শুরু করে সঙ্গীত বোদ্ধারা পর্যন্ত সকলেই তার দরাজ কণ্ঠের ছোঁয়ায় বিমোহিত হতেন। এমনকি মহানায়ক উত্তম কুমার আব্দুল জব্বারের গাওয়া গানে লিপসিং করতে না পারার আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এদেশের কোনও একজন পরিচালক উত্তম কুমারের কাছে গিয়ে তার সিনেমায় অভিনয় করার অনুরোধ জানালে উত্তম কুমার কয়েকটি শর্ত দিয়েছিলেন। তার মধ্যে একটি শর্ত ছিল শিল্পী আব্দুল জব্বারের কণ্ঠে রুপালী পর্দায় ঠোঁট মেলানো। উত্তম কুমারের সবগুলো শর্ত ওই পরিচালকের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। শেষমেশ পরিচালককে উত্তম কুমার পরামর্শ দিয়েছিলেন, তিনি যেন বাংলাদেশে ফিরে এসে বঙ্গবন্ধুকে নায়ক করে সিনেমা নির্মাণ করেন এবং আব্দুল জব্বারকে দিয়ে গান করান। তাহলে তার সিনেমা হিট হবে।

শিল্পী আব্দুল জব্বারের এ্যালবামের নেপথ্য কথা –
বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ ছিল শিল্পী আব্দুল জব্বারের কাছে এক ও অভিন্ন সত্তা। একাত্তরের সময় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে আব্দুল জব্বার যখন ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসঙ্গীত গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তহবিল সংগ্রহ করে বেড়াচ্ছিলেন, তখন ভারতের বিখ্যাত গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার আব্দুল জব্বারকে সেখানকার একটি চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। আব্দুল জব্বার সে প্রস্তাবে রাজি না হয়ে বরং জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে কবে? অবশ্য তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য ওই গীতিকারের লেখা ‘মাগো ভাবনা কেন’- গানটি গেয়েছিলেন।

আর পাঁচজন জাত শিল্পীর মতো আব্দুল জব্বারের আর্থিক টানা-পোড়েন থাকলেও কখনো তাকে কারও কাছে হাত পাততে দেখিনি। তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যার কাছে নিজের দুরবস্থার কথা জানিয়েছিলেন বটে।
সেটা ছিল শিল্পীর অধিকার। একবার আমি তাকে কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলাম। তিনি তা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্কটকালে যিনি একটা দেশের সরকারকে ১২ লাখ রুপি দান করতে পারেন, তিনি আমার সামান্য কয়টি টাকা গ্রহণ করবেন এমনটা আশা করা আমার বোকামি ছিল।
এই বাংলার আলো বাতাসে নদী মাঠে ঘাসে আরও ক’টা দিন বাঁচতে চেয়েছিলেন আব্দুল জব্বার। কিন্তু আমরা তাকে বাঁচাতে পারিনি। শরতের সকালের ঝমঝম বৃষ্টি আর অগণিত ভক্তদের শেষ শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় সিক্ত সাদা কাফন মোড়ানো তার নিথর দেহটি যখন শহিদ মিনারের বেদি থেকে সমাহিত করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, পাথরের মতো নিশ্চল বোবা চোখে অস্ফুট স্বরে বার বার তিনি হয়তো বলতে চেয়েছিলেন, ‘আমাকে তোমরা নিয়ো না কবরে, থেকে যেতে চাই আমি প্রতিদিনের খবরে’।

প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে আব্দুল জব্বার গানের ভুবন থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন সত্য। কিন্তু লক্ষ কোটি যোজন দূরে থেকেও নিকষ কালো অন্ধকার ভেদ করে বাংলা গানের আকাশে ধ্রুবতারা হয়ে তিনি জ্বলজ্বল করে জ্বলবেন যুগযুগ ধরে। এখনও আমি কান পেতে শুনতে পাই তিনি যেন আমাকে বলছেন, ‘আমিরুল, আমার জন্য গান লেখো’। আমি আর কোনওদিন তার জন্য গান লিখব না। ব্যথায় বিষাদে অশ্রুতে ভিজে আমার কলম বারবার থেমে যেতে চায়।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles