asd
Friday, November 22, 2024

লাকী চাচার ধ্যান জ্ঞান একটাই ছিল, সুর আর গান! – জনপ্রিয় গায়িকা সামিনা চৌধুরী…

– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।

“কবিতা পড়ার প্রহর এসেছে রাতের নির্জনে
জোনাকির আলো নিভে আর জ্বলে শাল মহুয়ার বনে”-

“আমায় ডেকোনা ফেরানো যাবেনা
ফেরারী পাখিরা কুলায় ফেরেনা”

স্বনামধন্য গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরীর কথা, প্রখ্যাত সুরকার লাকী আখন্দের সুর এবং গানগুলো গেয়েছেন জনপ্রিয় গায়িকা সামিনা চৌধুরী। আমরা সবাই সে কথা জানি! তবে কথা হল, জোনাকির আলো এখনো হয়তো জ্বলে শাল মহুয়ার বনে! হয়তো ফেরারী পাখিরা পথ ভুলে কুলায় ফিরেও আসতে পারে! কিন্তু এই আলো আঁধারের খেলা ছেড়ে এবং অনেক ভক্ত অনুরাগীদের কাঁদিয়ে এই গানগুলির অসাধারণ সুরের স্রষ্টা লাকী আখন্দ ফেরারী পাখির মত না ফেরার দেশে চলে গেছেন প্রায় তিন বছর হল। আর ফিরে আসবেন না! আজ এই প্রখ্যাত অসাধারণ সুর স্রষ্টা, সঙ্গীত পরিচালক ও জনপ্রিয় গায়ক শ্রদ্ধেয় লাকী আখন্দের জন্মদিন। আজকে তাঁর এই জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁর কিছু স্মৃতি জানার জন্য শরণাপন্ন হয়েছিলাম এই অসাধারণ গানগুলোর জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সামিনা চৌধুরীর কাছে। জনপ্রিয় এই শিল্পী শ্রদ্ধেয় লাকী আখন্দের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন –

লাকী চাচার ধ্যান জ্ঞান একটাই ছিল, সুর আর গান! আমার জন্য উনি যখন একটা গান করতেন, তখন গীতিকার আর উনি সুরকার দু’জনে মিলে ভালো করে গানটি করে, তারপর আমার কাছে নিয়ে আসতেন। আমি উনার সাথে যতগুলো গান করেছি, সেগুলোর প্রত্যেকটিই ভাল ছিল, সুন্দর ছিল। উনি এই কথাটি সবাইকে বলতেন, ‘আমি যে ওয়েস্টার্ণ ফিলটা চাই, এটা আমি সোমাকে ছাড়া আর কারো কাছে পাইনা!’ একটা গানের মধ্যে যে ওয়েস্টার্ন জিনিস উনি দিতেন সেইটা সে আমার গলার মধ্যে পেতেন। তাই উনি এই কথা বলতেন। তাছাড়া উনার একটা ব্যাপার ছিল, উনি করতেন কি! উনার গানগুলি শিল্পীদের দিয়ে গাওয়ালেও পরে আবার নিজে গাইতেন। কারণটা হচ্ছে, উনি গায়ক। উনিতো শুধু সুরকার ছিলেন না! গান গাওয়ার একটা স্পৃহা তাঁর মধ্যে ছিল। উনারা তিন ভাইবোনই গান করতেন। লাকী চাচা, হ্যাপী চাচা আর জেসমিন খালা। উনার যে বোন জেসমিন, উনিও খুব সুন্দর গান গাইতেন। তিন ভাইবোনই গান পাগল ছিলেন।

আমাদের বাসায় প্রায়ই গানের আসর বসতো। সবাই মিলে গান করতাম। এমনকি, বাচ্চার জন্মদিন! গান হবে। খালাতো বোনের জন্মদিন! গান হবে। আমার খালু যেহেতু গীতিকার কাওসার আহমেদ চৌধুরী, তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল লাকী চাচা। তাঁরা একসাথে গান করতো। সব গানই তাঁদের একসাথে। যার সুবাদে লাকী চাচা ও হ্যাপী চাচা সবসময় আমাদের বাসায় আসত। মানে আমাদের জন্মদিন, সেদিন আমাদের এখানে আসতেন। খালাতো বোনের জন্মদিন সেদিনও আসতেন, লাকী চাচা। গান বাজনা হতো খুব তখন। আমাদের বাসায় অনেক সময় তাঁর জন্মদিনের দিন সবাই মিলে গান বাজনা করতাম। একটা সময় তিনি আমাদের ফ্যামিলি মেম্বারের মত হয়ে গিয়েছিলেন।

– তারমানে আপনাদের পারিবারিক সব অনুষ্ঠানেই উনি আসতেন।
– একদম! লাকী চাচার কোনও হেজিটেশন ছিলনা যে, আমি একজন বিশাল মাপের শিল্পী, সুরকার! আমি কেন যাব ? মানে আমাদের সাথে মিশে গিয়েছিলেন। আমাদের সাথে মিশতে পারলেই, তিনি খুশি হতেন। কারণ উনি খুব ওনার ফ্যামিলিকে মিস করতেন! তাই তিনি যে কোনো একটা ফ্যামিলির সাথে মিশতে পারলে খুব খুশি হতেন।

কবিতা পড়ার প্রহর এবং আমায় ডেকো না গানগুলি করার সময় আমার অনেক গলা বসা ছিল। উনি আমাকে অনেক সাহস দিয়েছেন, তুমি গাও। পারবা, পারবা, পারবা। আমার তখন ভীষণ গলা বসা, মানে আমি গান করতেই পারবো না।গলা ফ্যাসফ্যাস করছে, কোনো আওয়াজ নেই! কথা বলতে পারছি না। অথচ কিভাবে যেন রেকর্ডিং করে ফেললাম। প্রথমে করলাম, কবিতা পড়ার প্রহর। তারপর করলাম, আমায় ডেকোনা গানটি। তারপরেও গানগুলি মানুষের যে ভালো লেগেছে, আলহামদুলিল্লাহ! তারপর অনেক পরে, প্রায় দশ বছর পর হঠাৎ যখন লাইভ টাইভ শুরু হল, তখন উনি আমায় ডেকোনা গানটি গাইল নিজে গীটার বাজিয়ে। উনি যেহেতু একোডিয়ান বাজাতেন, একোডিয়ান বাজানোর ফলে উনার রিদম সেন্স অদ্ভুত সুন্দর ছিল। প্রত্যেকটা গানের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রিদম বাজাতেন। আবার উনি ক্লাসিকাল খুব ভালো গাইতেন। যার জন্য ক্লাসিকাল সুরগুলোও সেইরকম মেলোডিয়াস এবং সেমি মেলোডিয়াস গানগুলো খুব সুন্দর হত।

লাকী চাচা, খুব নম্র ভদ্র ছিলেন তা সবাই জানেন। তিনি খুবই জেন্টেলম্যান ছিলেন। আমাদের সাথে খুব আদর করে কথা বলতেন। জোরে কখনও কথা বলতে দেখিনি। আসলে আমাদের দেশে একটা ব্যাপার কি, আমাদের পরিসরটা অনেক ছোট তো! চেয়ে চেয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু চেয়ে চেয়ে কাজ করাটা আমরা শিখিনি! আমি, লাকী চাচা, হ্যাপী চাচা। আমরা হচ্ছি যে, গান গাইতে পারব কিন্তু চাইতে পারবো না। যার ফলে লাকী চাচাও কারো কাছে কিছু চাইতেন না।

  • তার মানে আপনাদের কাছে চেয়ে নেওয়ার চেয়ে, আত্মসম্মানটা অনেক বড় ব্যাপার!
  • হ্যাঁ, অনেক বেশী। আসলে উনি কিন্তু একটি গানের পেছনে জান প্রান দিয়ে দিতেন। আপনি যদি উনাকে একটা গান করে দিতে বলতেন! দেখা যেত, ওটা নিয়ে লেগে পড়েছে! আমিও তাইই। গান করবো তবে নিজে চেয়ে গান করবো না।
  • উনি শুনেছি, গানের ব্যাপারে খুব খুঁতখুঁতে ছিলেন। পারফেক্ট না হলে গান প্রকাশ করতেন না।
  • হ্যাঁ, সাংঘাতিক খুঁতখুঁতে ছিলেন। উনাকে রেডিওতে কাজ দেয়া হল। ওখানে বসে বসে উনি গান করতেন। কিন্তু উনি কি শুধু রেডিওতে বসে থাকার মানুষ! একটা সময় রাহুলদেব বর্মণ উনাকে অনেক আদর করতেন। উনার রেকর্ডিং বাজানো শুনে, রাহুলদেব বর্মণ বলেছিলেন, প্লিজ! লাকী তুমি বোম্বেতে থেকে যাও। কিন্তু উনি কি বোকামিটাই না করলেন! উনি বাংলাদেশে চলে আসলেন, বাংলাদেশের মানুষের জন্য। বাংলাদেশের মানুষতো তাঁকে মূল্যায়নও করতে পারলো না। বাংলাদেশের সব শিল্পীরই লাইফ ফিনিশিংটা দুঃখ কষ্টের হয়! যার জন্য, আমি আসলে দুঃখ করি না। আমি কোনো কিছু নিয়েই দুঃখ করি না। আমি মনে করি, আমার রিজিক যতটুকু আছে, ততটুকুই পাবো। আল্লাহ্‌র তরফ থেকে যখন গান গাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে, তখন আর গাইবো না। সবসময় আল্লাহ’র ওপর বিশ্বাস রাখবো। লাকী চাচা, যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন এবং আল্লাহ তাকে বেহেশত নসীব করুন, এই দোয়া করি।
  • সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে আপনার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভকামনা এবং সেই সাথে এই দোয়া করি, আপনি আমাদের আরও অনেক সুন্দর সুন্দর গান উপহার দিন। ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles