Friday, April 19, 2024

বিলিন হয়ে যাওয়া পুরান ঢাকার ‘কাসিদা অব ঢাকা’…

– শাহরিয়ার খান সাকিব।

কাসিদা শব্দটি আরবি। এর অর্থ প্রশংসা বা প্রশস্তিমূলক কবিতা। ইসলাম ধর্মের প্রথম পর্বেই আরবি সাহিত্যে কাসিদার বড় ভান্ডার গড়ে উঠেছিল। ধীরে ধীরে অন্যান্য ভাষায়ও প্রসার লাভ করে। বিশেষ করে ফারসি, তুর্কি, উর্দু ভাষায় কাসিদার বিস্তর দেখা মেলে। পুরান ঢাকায় পবিত্র রমজান এলেই সাহ্রির সময় মহল্লায় মহল্লায় কাসিদা গাওয়া হতো। উদ্দেশ্য, রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগানো। বছর কুড়ি আগে ঢাকার মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা এলাকায়ও কাসিদার প্রচলন ছিল।
এশিয়াটিক সোসাইটি প্রকাশিত ঢাকা কোষ বইতে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ রয়েছে, নবাবি আমলে ঢাকা শহরের প্রায় প্রতিটি মহল্লার সর্দাররা কাসিদা দলের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ঢাকার নবাব আহসান উল্লাহর সময় কাসিদা গাওয়ার ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। নবাব নিজে কাসিদা রচনা করতেন। আহসান উল্লাহর রচিত উর্দু কাব্যগ্রন্থ কুল্লিয়াতে শাহীন-এ বেশ কিছু কাসিদা স্থান পেয়েছে। এ ছাড়া বাংলার সুবাদার ইসলাম খাঁর সেনাপতি মির্জা নাথনের মোগল অভিযানের বর্ণনামূলক গ্রন্থ বাহারিস্থান-ই-গায়েবীতেও মোগল পৃষ্ঠপোষকতায় কাসিদা চর্চার উল্লেখ রয়েছে।
বর্তমানে পুরান ঢাকায় কোথাও কোথাও উর্দু কাসিদা গাওয়ার প্রচলন থাকলেও নবাবি আমলে চলত ফারসি কাসিদা। কাসিদা গাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাকরণ, উচ্চারণ, সুর, তাল, লয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কাসিদা গায়কেরা পাক-পবিত্রতা, আদবের সঙ্গে গান পরিবেশন করে থাকেন। রমজানে ঢাকার কোথাও কোথাও বিভিন্ন ব্যক্তির আয়োজনে কাসিদা প্রতিযোগিতা আয়োজনের কথা শোনা যায়।
বাংলার ঐতিহ্য কাসিদাকে এবার প্রামাণ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে। বাংলাঢোলের প্রযোজনায় ১৭মে বাংলাফ্লিক্স, রবিস্ক্রিন, এয়ারটেল স্ক্রিন, টেলিফ্লিক্স ও বিডিফ্লিক্স লাইভ অ্যাপগুলোতে এক যোগে উন্মুক্ত করা হয়েছে ‘কাসিদা অব ঢাকা’। ২০ মিনিট ব্যাপ্তির এই প্রামাণ্যচিত্রটি গবেষণা ও নির্মাণ করেছেন অনার্য মুর্শিদ। ‘কাসিদা অব ঢাকা’র চিত্রগ্রহণ করেছেন রাসেল আবেদীন তাজ, সম্পাদনা করেছেন অনয় সোহাগ, আবহ সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন প্রিন্স শুভ আর নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছেন অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। নির্বাহী প্রযোজক এনামুল হক জানান, কিছুদিনের মধ্যে এটি দেখা যাবে বাংলাঢোলের ইউটিউব চ্যানেলে।
অনার্য বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস প্রামাণ্যচিত্রটির মাধ্যমে অনেকেই কাসিদার ব্যাপারে নতুন কিছু জানতে পারবেন, এ ব্যাপারে আগ্রহী হবেন, হারিয়ে যাওয়া কাসিদাকে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। বাংলাঢোলকে ধন্যবাদ এমন একটি হারানো ঐতিহ্যকে দর্শকের সামনে তুলে আনার জন্য। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরীর বইতে উল্লেখ করা হয়েছে, ১৯৪৭-এর পর উদুর্ভাষী মোহাজেররা ঢাকায় এসে কাসিদায় নতুন মাত্রা যোগ করেন। পুরান ঢাকার মহল্লায় মহল্লায় ভোররাতে কাসিদা গায়কেরা বেরিয়ে পড়তেন। গান গেয়ে ঘুম ভাঙাতেন। এটিকে তাঁরা সওয়াবের কাজ মনে করতেন। আর ঈদের দিন মহল্লায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে নজরানা নিয়ে আসতেন। তবে ঢাকায় রমজানের সময় কবে, কখন থেকে কাসিদার প্রচলন শুরু হয়, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। ধারণা করা হয়, মোগল আমলে শুরু হলেও ইংরেজ আমলে এসে তা লুপ্ত হয়ে যায়। তবে হাকিম হাবিবুর রহমানের বর্ণনা থেকে ধারণা করা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হয়তো আবার তার প্রচলন ঘটে।
পাঁচ রকমের কাসিদার কথা বিভিন্ন বইপত্রে উল্লেখ আছে। এগুলো হলো: চানরাতি আমাদ, খুশ আমদিদ, আলবিদা, ঈদ মোবারক ও বিশেষ কাসিদা। রমজান শুরুর পর এর ফজিলত বর্ণনা করে যে কাসিদা পরিবেশন করা হতো, তার নাম ‘চানরাতি আমাদ’। প্রথম ১৫ রোজা পর্যন্ত রোজাকে খুশ আমদিদ জানিয়ে গাওয়া হতো ‘খুশ আমদিদ’। তারপর ‘আলবিদা’ বা বিদায় চলত ২৭ রোজা পর্যন্ত। ঈদের পরদিন গাওয়া হতো ‘ঈদ মোবারক কাসিদা’। ‘বিশেষ কাসিদা’ও পরিবেশিত হতো জনপ্রিয় সিনেমার গান থেকে। একেক কাসিদা একেক সুরে গাওয়া হয়। শাহেদি, মার্সিয়া, নাত-এ রাসুল, ভৈরবী, মালকোষ প্রভৃতি রাগে এর সুর প্রয়োগ করা হয়। অধিকাংশ কাসিদার সুর তৎকালীন ছায়াছবির গান থেকে নেওয়া। কাসিদা মূলত কোরাসসহকারে গাওয়া হয়। যেখানে সাত থেকে আটজন তালিমপ্রাপ্ত গায়ক সম্মিলিতভাবে অংশ নেন। তাঁদের মাঝে যিনি ‘সালারে কাফেলা’, তিনি সংগীত রচনা, সুর প্রয়োগ ও উপস্থাপনার পাশাপাশি দল পরিচালনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন।
ভণিতায় রচয়িতার নাম উল্লেখ থাকে। যাঁরা কাসিদার গান রচনা করেন, তাঁদের বলা হয় কাসেদ।
কয়েক রকমের কাসিদার উদাহরণ:
চানরাতি আমাদ
চাওদ উই তারিখ কা হ্যায় চান্দ ইয়ে রামাজান কা
দেখলো ইয়ে বাহাসে রাহাত হ্যায় জিসমো জানকা
পাঁচ ওয়াক্ত কা মোমেনা পড়তে রাহো হারদাম নামাজ
দেহান তুমকো হ্যায় আগার কুচ দিন কা ইমান কা…
আরো গাওয়া হতো,
আ গায়া অ্যায় সামোয়া মাহে মোবারক আ গায়া
ছা গায়া সারি ফিজা পার নূর বানকার ছা গায়া…

খুশ আমদিদঃ
খুশ আমদিদ খোশকে লাব পার আবরে রাহমাত খোদ নিসাওয়ার হো গায়া
মারাতাবে মাহে কারামসে দেকতেহি আজ হাম…

আলবিদাঃ
অ্যায় মাহে মোবারাক মাহে কারাম
যানেকা আভি সামান নাহ্ কার

সাহ্রির কাসিদাঃ
আল্লাহকা বান্দেকো হাম আয়ে জাগানেকো
হার দিলমে রামজানকি পায়গাম পাওচায়েঙ্গে

ঈদ মোবারকঃ
লুটল অ্যায় সায়োমো মারাকানা ইল্লাল্লাহাকা
ঈদকি দিন হ্যায় পিও পায়মানা ইল্লাল্লাহাকা

উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে এ পর্যন্ত এই অঞ্চলে অনেকেই কাসিদা রচনা করেছেন। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন মুনসেফ, এজাজ, হামিদ-এ-জার, হাফেজ দেহলভি, জামাল মাশরেকি, তালিব কবির, মুজিব আশরাফি, সারওয়ার, শওকত প্রমুখ।
পুরান ঢাকার লালবাগ এলাকায় এখনো স্বল্প পরিসরে কাসিদা গাওয়ার প্রচলন রয়েছে। এ ক্ষেত্রে একজনের বিশেষভাবে নাম উল্লেখ করতে হয়। তিনি আমলীগোলার শিল্পপতি আনোয়ার হোসেন। ঢাকার ইতিহাসের আকর গ্রন্থ কিংবদন্তির ঢাকার লেখক নাজির হোসেনের ছোট ভাই তিনি। আনোয়ার হোসেন নিজেও কাসিদার সুর করেন। কণ্ঠ দেন।
কাসিদার পৃষ্ঠপোষকতা, সুর ও কণ্ঠে আরও যাঁদের অবদান রয়েছে, তাঁরা হলেন বকশীবাজারের মো. জুম্মন মিয়া (১৯৩৭), উর্দু রোডের মঞ্জুর আলম (১৯৪৪), বকশীবাজারের মানিক চান (১৯৫২), হোসেনি দালানের সৈয়দ ফসিহ হোসেন (১৯৫৬) প্রমুখ। তাঁদের অধিকাংশ ব্যবসায়ী হলেও অনেকে এখনো কাসিদার সঙ্গে যুক্ত আছেন। কেউ সুরের মাধ্যমে, কেউ কণ্ঠ দিয়ে, কেউ সালারে কাফেলা হিসেবে, কেউ প্রতিযোগিতার আয়োজক বা বিচারকের দায়িত্ব পালন করে কাসিদাকে বাঁচিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
একজন কাসিদাশিল্পী সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কাসিদার রূপও যেন পাল্টে গেছে। ২০১৫ সালের ৩০ জুন প্রথম আলোয় প্রকাশিত মনিরুল আলমের এক লেখায় পাওয়া যায় কাসিদাশিল্পী আমজাদ হোসেনকে।
মনিরুল লিখেছেন, তখন রাত তিনটা বাজে। অনেক দূর থেকে শব্দটা আসছে। টিন বাজানোর শব্দ। যাঁরা এই শব্দের সঙ্গে পরিচিত, তাঁদের আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। রোজার মাসে সাহ্রির সময় পুরান ঢাকাবাসীর কাছে এই শব্দের অর্থ জানা। যাঁরা রোজা রাখেন, তাঁদের এখন সাহ্রি খাওয়ার জন্য ঘুম থেকে উঠতে হবে। ‘মুমিন মুসলমান, সেহেরি খান। রোজদার, দিলদার, ওঠো; রাত তিন বাজগিয়া’ -যিনি বলছেন, সেই আমজাদ হোসেনের এক হাতে একটা টিন, অন্য হাতে একটা লাঠি! ছন্দের তালে তালে টিনটি বাজিয়ে চলছেন আর একটু পরপর সুর করে বলে যাচ্ছেন ওপরের কথাগুলো। পুরান ঢাকার পাতলা খান, লক্ষ্মীবাজার এলাকায় সাহ্রির সময় এখন এই দৃশ্য চোখে পড়বে।
কেন হারিয়ে যাচ্ছে ?
কাসিদা গাওয়ার প্রচলন কমে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে, এখন মানুষ মুঠোফোনেই সাহ্রির অ্যালার্ট সেবা পাচ্ছে। টিভিতে, রেডিওতে ইফতার-সাহ্রিতে নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে।
কাসিদা কেন হারিয়ে যাচ্ছে -জানতে চেয়েছিলাম পুরান ঢাকার ফরাশগঞ্জের বিখ্যাত সর্দার বংশের সন্তান ও ঢাকা গবেষক মোহাম্মদ আজিম বখশের কাছে। প্রথম আলোকে তিনি বললেন, এটা খুবই দুঃখজনক যে আমরা আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিসর্জন দিচ্ছি। আমরা শিকড়কে ভুলে থাকছি। তিনি বলেন, লালবাগের কিছু এলাকায় কাসিদা এখনো চলে। শিল্পপতি আনোয়ার হোসেনের পরিবারের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কাসিদা নামে একটি বইও রচনা করা হয়েছে।
পুরান ঢাকার প্রতিটি মহল্লার বিশিষ্টজনদের উচিত স্বল্প পরিসরে হলেও কাসিদা টিকিয়ে রাখা। কাসিদা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা, যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে তাদের পূর্বপুরুষের ইতিহাস।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles