Sunday, April 21, 2024

দেবার তুলনায় প্রাপ্তি কম তোমার…

– মোশারফ হোসেন মুন্না।

অজানা কোনো এক অন্যভূবনে
হয়তো গন্তব্য হয়েছে তোমার,
অভিমান ভুলে গলা খুলে ‘গান
হয়ে আছে অমর অম্লান।
গেয়ে গেলে গভীর ভালবেসে
চেতনার সুরে সংগ্রামী গান।
তোমায় ঘিরে থাকা স্মৃতিগুলো আজ
বাড়িয়ে দিচ্ছে তোমার সান।
জমাট বেঁধে যায়, তোমার স্মৃতি
সে স্মৃতি আর বাড়ে না,
দেখতে দেখতে পেরিয়েছে অনেক সময়
আজম খান তুমি আসো না।
অতল হৃদয় নিয়ে এসেছিলে তুমি
যতোই শ্রদ্ধা জানাই বলে মন,
তুমি যেনো সেই আগের মতই গাইছো
সখিনা জরিনার গান।
যেই দেশেতে জন্ম তোমার হলো
যুদ্ধে ছিলে বর বীর,
সেই দেশেতে আজও পারেনি
গড়তে তোমার নীড়।
যেই দেশেতে গুণীজনের হয়না কদর
পায়না তাদের সম্মান,
সেই দেশেতে গুণী জন্ম নিবে কি করে
হতে হয় শুধু অপমান।

প্রথা না মানার সময় ছিল ষাট এবং সত্তুরের দশক। শুরু হয়েছিল পশ্চিমে, কিন্তু জের পড়েছিল বাংলাতেও। প্রথা না মানা এরকমই একদল দ্রোহী তরুণ বিদ্রোহ করেছিল রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে। পপ গানের উন্মাতাল অর্গল খুলে দিয়েছিলেন তাঁরা। নেতৃত্বে ছিলেন আজম খান। দ্রোহী ছিলেন আজম খান সামাজিক প্রথা ভেঙেছেন, কিন্তু সাধারণ মানুষের সাথে যোগাযোগটা ছিল সবসময়ই অক্ষুন্ন। ব্যক্তি সত্তার ঊর্ধ্বে উঠে একজন শিল্পী কীভাবে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে যান, আজম খান তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আজম খানকে তাই শুধু একজন শিল্পী হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক নয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব ও পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষোভ-আনন্দ, প্রেম-বেদনা, জীবন-মৃত্যুর অনুভব-সবকিছু অবলীলায় তাঁর সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে প্রকাশ করেছেন। গত শতকের ষাট ও সত্তরের দশকের যুবসমাজ একটি মানবিক রাষ্ট্র নির্মাণের যে স্বপ্ন দেখেছিল, যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিল, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সম্ভাবনার নতুন দিকের সন্ধান এ জাতি পেয়েছিল, তার ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ যুবসমাজ যখন ক্ষোভে ফেটে পড়ল, তখন আজম খান যেন মুক্তিযুদ্ধের অস্ত্রের শব্দ ও তীব্রতা তাঁর যন্ত্র ও কণ্ঠে ধারণ করে যুবসমাজের স্বপ্নভঙ্গের ক্ষোভকে সঙ্গীতে রূপান্তর করলেন।
আজম খান তখন ক্রমশ কিংবদন্তী আজম খান হয়ে উঠছেন। সঙ্গীতে, নাটকে, কবিতায় যুদ্ধোত্তর বাঙলাদেশে তখন রেনেসাঁ যুগ। নতুনের অনিবার্য আহবান-নতুন পথের নতুন ঠিকানার। মুক্তিযোদ্ধা আজম খান স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে সাংস্কৃতিক জগতে একজন বিস্ময়কর ব্যক্তি। বিশ শতকের বাঙলা গানের ইতিহাস যাঁরা লিখছেন, আজম খানের কথা তারা কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এমন গান তিনি আমাদের সেকালে শুনিয়ে ছিলেন, সে গান এদেশে আগে কেউ শোনেনি। গানগুলোর কথা, সুর, ব্যবহৃত বাদ্যযন্ত্র, পরিবেশনের রীতি সবই আলাদা। এ কারণেই আজম খান একজন শিল্পী বা একটি নামই মাত্র নয়। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে, বাংলা গানের সামাজিক রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে আজম খান একটি ঘটনা একটি অধ্যায়। যা কোনভাবেই উপেক্ষা করা বা ভুলে যাওয়া যাবে না। আজ তিনি নেই। তাঁর কর্ম তাঁর চেতনা থাকবে নতুনত্বের পথে আলোর মশাল হয়ে।
বাংলা পপ গানের কিংবদন্তী আজম খান। মানুষটিকে তরুণ সমাজ চেনে ‘পপ সম্রাট’ হিসেবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন গেরিলা যোদ্ধা, তিনি ২ নম্বর সেক্টরে খালেদ মোশাররফের অধীনে যুদ্ধ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শেষে আজম খান কুমিল্লা অঞ্চলে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশ নেওয়া শুরু করেন। প্রথম সরাসরি যুদ্ধ করেন কুমিল্লার সালদায়। যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য তাকে সেকশন কমান্ডার করে ঢাকা ও আশেপাশে গেরিলা আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাঠানো হয়। আজম খান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা, যাত্রাবাড়ি-গুলশান-ডেমরা এলাকার গেরিলা অপারেশানে নের্তৃত্ব দেন।
স্বাধীনতার পর আজম খান ও তাঁর ব্যান্ড দল।
মুক্তিযোদ্ধা আজম খানে’র উল্লেখযোগ্য অপারেশন হচ্ছে, অপারেশন তিতাস তাঁর নেতৃত্বে গ্যাস সরবরাহ পাইপ লাইন ধ্বংস করে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেন গেরিলারা। তাঁর নের্তৃত্বে ঢাকার অদূরে মাদারটেকের কাছে ত্রিমোহনীতে ও কালিগঞ্জের সম্মুখ সমরে পাকসেনাদের হটিয়ে দেয় মুক্তিযোদ্ধারা। আরবান গেরিলাদের যে দলগুলো বিজয়ের অনেক আগেই ঢাকা প্রবেশ করেছিল তার মধ্যে অগ্রগন্য ছিল তাঁর দল। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ২০ নভেম্বর ঢাকায় প্রবেশ করেন। যুদ্ধের মধ্যেও গানকে ছাড়েননি তিনি। জাহানারা ইমামের একাত্তরের দিনগুলিতেও সে কথা লেখা আছে।
অন্যদিকে সাধারণ হয়েও একজন অসাধারণ মানুষ। মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে যে ঘাটতি ছিল সেই বেদনা ও ক্ষোভ তিনি প্রকাশ করেছিলেন গানে গানে। এক্ষেত্রে দেশ ও মানুষের কাছে তাঁর যে দায়বদ্ধতা, তা তিনি আপোষহীনভাবে পালন করেছেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত্ হননি। নির্মোহ, সরল-সহজ মানুষটি কারও কাছে কিছু চাননি, অথচ দেশ থেকে তার অনেক কিছু পাওয়ার ছিল। এ জন্য তার কোনো ক্ষোভ ছিল না, অভিমান ছিল না। দীর্ঘ সময় ধরে যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছেন তাঁরা সবাই স্বীকার করেন, আজম খান ছিলেন ত্যাগী, ভদ্র, বিনয়ী এবং সহজ মানুষ। তিনি দিয়ে গেছেন অনেক, তার বিনিময়ে কিছু চাননি, কিছু পাননি। অত্যন্ত সরল-সহজ জীবন-যাপন করেছেন, কখনই বিত্তবৈভবের পিছে ছুটে যাননি। আজকে যখন অনেকে অতি সহজে তারকা বনে যাচ্ছেন, গাড়ি-বাড়ির মালিক হচ্ছেন, কর্পোরেট পুঁজির দাসত্বে পরিণত হচ্ছেন, তখন আজম খানের মতো একজন ত্যাগী শিল্পীর অভাব অনুভব করি। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়েও চিরকাল থেকে গেছেন আড়ালে। রাষ্ট্র গতবছর তাকে একুশে পদক (মরনোত্তর) প্রদান করেন। সব সময়ই মনে করতেন, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার চেয়ে বঞ্চিত থাকা সুখের। এখানেই অন্য সব শিল্পী থেকে আজম খানের পার্থক্য। তাই তাঁর বিদায়ে কেঁদেছে সাধারণ মানুষ। আজম খান অমর অবিনশ্বর। বাংলাদেশ যতদিন থাকবে, ততদিন সবার হৃদয়ে থাকবেন আজম খান।
আজম খান ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, সহজ-সরল, ভদ্র। তথাকথিত শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর কোনো তুলনা হয় না। অনেক বড় শিল্পী এমন ‘অহম’ কখনোই দেখাতেন না তিনি। সহজেই মিশে যেতেন যে কারো সঙ্গে। ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই অসামান্য ভালো মানুষ।
গান আর মানুষের প্রতি অফুরন্ত ভালবাসা ছাড়া এই ভালো মানুষটার আর কিছু ছিল বলেতো মনে হয় না। কোন অভিমানে যে চলে গেলেন আমাদের ছেড়ে, কে জানে ?
একজন মুখোশ ছাড়া মানুষ, সারল্যের প্রতীক হিসেবে, আমরণ হৃদয় জুড়ে থাকবেন আজম খানের নামটি। সেই কামনায় সঙ্গীতাঙ্গন।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles