শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি তাদের, সঙ্গীত জগত থেকে ২০১৯ সালে হারিয়ে গেছেন যারা। সংগীতের জন্য যারা সারা জীবন শ্রম দিয়েছেন। সঙ্গীতকে ভালোবেসেছেন। যাদের দ্বারা বাংলা সংস্কৃতি বাংলা গান বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অন্যান্য দেশে পরিচিতি লাভ করেছেন তাদেরকে স্মরণ করছি শ্রদ্ধাভরে। আমাদের দৃষ্টিতে যদিও তারা মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু বাংলা গানের সাথে তারা বেঁচে আছেন বেঁচে থাকবেন সারা জীবন। আসুন আমরা জেনে নেই সংগীতাঙ্গনে আমরা কাদেরকে হারিয়েছি।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল:-
বাংলা সংগীত জগতে জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধার এক নাম আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। তার গান বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে, তেমনি বাংলা চলচ্চিত্রকে করেছে সমৃদ্ধ। সংগীতের প্রায় সকল শাখায় অবদান রাখা বীর মুক্তিযোদ্ধা এই শিল্পী আজ আমাদের মধ্যে নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জন্ম ১৯৫৭ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায়। ১৯৭১ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে বালক বুলবুল কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাইফেল হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকিস্তানী শত্রুদের ঘায়েল করতে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ স্মৃতি বিস্মৃতি নিয়ে বহু জনপ্রিয় গান লিখেছেন এবং সুর করেছেন। এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা, আয় রে মা আয় রে, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম, সব কটা জানালা খুলে দাও না, মাঝি নাও ছাইড়া দে, ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে, সেই রেল লাইনের ধারে, মাগো আর তোমাকে ঘুম পাড়ানি মাসি হতে দেবনা- এমন বহু কালজয়ী গানের স্রষ্টা নিভৃতচারী এই শিল্পী।
বাংলা সঙ্গীতের চিরসবুজ গান- আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি, আমার বাবার মুখে, যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে, পড়েনা চোখের পলক, অনেক সাধনার পর, আমার গরুর গাড়িতে, পৃথিবীর যত সুখ, আট আনার জীবন সহ অসংখ্য কালজয়ী বিখ্যাত গানের গীতিকার, সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল।
৭০ দশক থেকেই চলচ্চিত্র এবং অডিওতে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছেন এই গুণী সঙ্গীত পরিচালক। বিখ্যাত গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা ‘সবকটা জানালা খোলে দাওনা’, শ্রদ্ধেয় রফিকউজ্জামান এর লেখা ‘সেই রেললাইন ধারে’, সহ অসংখ্য দেশাত্মবোধক গান তিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি ১৯৭১ সালের একজন মুক্তিযোদ্ধা।
চলচ্চিত্রেও তার গান ছড়িয়েছে মুগ্ধতা। তার হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘প্রেমের তাজমহল’সহ অনেক জনপ্রিয় গান।
১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বিজলি বাদল’ ছবিতে সংগীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রে কাজ করা শুরু করেন বুলবুল। এর পর তিনি গানের অ্যালবাম ও অসংখ্য চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। তিন শতাধিক চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন গুণী এ মানুষটি। তিনি স্বাধীনভাবে গানের অ্যালবাম তৈরি করেছেন এবং অসংখ্য চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালনা করেছেন।
সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদী, এন্ড্রু কিশোর, সামিনা চৌধুরী, খালিদ হাসান মিলু, আগুন, কনকচাঁপাসহ দেশের প্রায় সব জনপ্রিয় শিল্পীদের দিয়ে কাজ করিয়েছেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়।
বাংলা সংগীত জগতের কিংবদন্তী গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৩ বছর। অকালে সংগীতজগতের গোলাপ ফুলটি ঝরে গেল। ২০১৯ সালে আমরা তাকে হারিয়েছি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল এর মত মানুষ কখনো মরে না। মরেও বেঁচে আছেন সংগীতের মাঝে বাংলা গানের মাঝে, বাংলাদেশের মানুষের মাঝে। আমরা তাকে কখনো ভুলবো না।
শিল্পী সুবীর নন্দী:-
একুশে পদকপ্রাপ্ত বরেণ্য সংগীতশিল্পী সুবীর নন্দী, গত ৭ই মে ভোরের আলো ফোটার সময় যখন তার মৃত্যু সংবাদ গায়কের পরিবার-শুভাকাঙ্ক্ষী-সহকর্মী-ভক্তদের কানে এসেছিল, তখন নিশ্চয়ই তাদের মন কেঁদে উঠেছিল। হয়তোবা কেউ কেউ শুনতে বসে গিয়েছিলেন সুবীর নন্দীর কণ্ঠের প্রিয় কোনো গান।
সুবীর নন্দী আধুনিক বাংলা গানের এক কিংবদন্তী শিল্পী, সুরের রাজকুমার। দীর্ঘ চার দশকের ক্যারিয়ারে তিনি গেয়েছেন প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশি গান। আধুনিক বাংলা গানের জাগরণ পর্ব বলা হয় গত শতকের ষাটের দশককে।
স্বাভাবিকভাবেই তখন আমাদের দেশে ছিল ভারতীয় বাংলা আধুনিক গানের শিল্পীদের বিস্তর প্রভাব। ঠিক সেই সময়ে আবির্ভাব ঘটে সুবীর নন্দীর মতো কয়েকজন গুণী শিল্পীর যারা যাবতীয় প্রভাব থেকে মুক্ত থেকে নিজেদের সংগীত প্রতিভা ও সাধনাকে কাজে লাগিয়ে সূচনা করেছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা গানের নতুন এক অধ্যায়ের।
সুবীর নন্দী জন্মেছিলেন ১৯৫৩ সালের ১৯ নভেম্বর হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার নন্দীপাড়ায়। তার বাবা ডাক্তার সুধাংশু নন্দী ছিলেন সংগীতপ্রেমী আর মা পুতুল রানীও বাড়িতে ঘরোয়াভাবে গান গাইতেন। তাই ছোটবেলা থেকেই সুবীর নন্দী পারিবারিকভাবেই গানবাজনার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। বাবার চাকরি সূত্রে নন্দীর শৈশব কেটেছে চা বাগান এলাকাতে। পড়েছেন সেই চা-বাগান এলাকারই খ্রিষ্টান মিশনারীর একটা স্কুলে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পার করার পর পড়াশোনার জন্য চলে যান হবিগঞ্জ শহরে। সেখানে ভর্তি হন হবিগঞ্জ সরকারি হাইস্কুলে, তারপর পড়েছেন হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজে।
সুরের ভুবনে তার পথচলা শুরু হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। তখন তিনি মাত্র তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র। মায়ের কাছে প্রথম গান শেখা শুরু হলেও শাস্ত্রীয় সংগীতে তার গুরু ওস্তাদ বাবর আলী খান। তবে তিনি লোকগানে তালিম নিয়েছেন বিদিত লাল দাসের কাছে। কিশোর বয়সেই তিনি সিলেট বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হয়ে যান, সেখানে প্রথম গান গেয়েছিলেন ১৯৬৭ সালে। প্রথমে শুধুমাত্র সিলেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ১৯৭২ সাল থেকে তার ঢাকায় আসা-যাওয়া শুরু হয়। প্রথমদিকে নজরুলগীতি নিয়ে মনোযোগী হলেও অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ঝুঁকে পড়েন বাংলা আধুনিক গানের দিকে।
বাংলাদেশ বেতারে তার গাওয়া প্রথম গান ছিল ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে দেয়’। গানটির সুরকার মীর কাশেম তাকে বেতারে গান গাওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিলেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বিশেষ করে যখন ১৯৭৬ সালে রাজা হোসেন-সুজয় শ্যামের সুরে আব্দুস সামাদের ‘সূর্যগ্রহণ’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করার সুযোগ পেলেন। সেই সিনেমায় গাওয়া লোকগান ‘দোষী হইলাম আমি দয়াল রে’ গানটি তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিল।
কয়েকটা সিনেমায় গান করার কিছুদিনের মধ্যেই তার গানকেন্দ্রিক ব্যস্ততা কয়েকগুন বেড়ে গেল। একের পর এক নতুন গান রেডিওতে বাজছে, সেগুলোর প্রায় সবই আবার শ্রোতাপ্রিয়ও হচ্ছে। তবে সে সময় সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়েছিল ‘হাজার মনের কাছে প্রশ্ন করে’ আর ‘বন্ধু হতে চেয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ গান দুইটি। এরপর ১৯৮১ সালে ডিসকো রেকর্ডিংয়ের ব্যানারে প্রথম একক এ্যালবামে সুবীর নন্দীর গান বাজারে আসে। একক কিংবা দ্বৈত, সব ধরনের গানেই নন্দী বাবু ছিলেন সাবলীল। সাবিনা ইয়াসমীনের সাথে তার জুটি ছিল এক কথায় অনবদ্য। সাবিনা ইয়াসমীনের সাথে প্রথম প্লেব্যাক ছিল ‘অশিক্ষিত’ সিনেমায়, একেবারে ক্যারিয়ারের শুরুতে। সেই সিনেমায় সত্য সাহার সুরে ও গাজী মাজহারুল আনোয়ারের লেখা ‘মাস্টার সাব, আমি নাম-দস্তখত শিখতে চাই’ গানটি সিনেমপ্রেমী সবার মুখেমুখে প্রচলিত ছিল। রুনা লায়লার সাথেও তিনি অনেকগুলো গান করেছেন। বিশেষ করে তখনকার সময়ের প্রতিটি সাহিত্য নির্ভর সিনেমাতে সুবীর নন্দীর গান থাকবেই। দেবদাস, শুভদা, চন্দ্রনাথ, বিরাজ বৌ- সিনেমাতে তার দরদমাখা কণ্ঠের জাদুতে সবাই মুদ্ধ হয়েছে।
সংগীত যে একটা গভীর সাধনার ব্যাপার সেটা সুবীর নন্দীর মতো শিল্পীদের দেখলে বোঝা যায়। গানের পাশাপাশি তিনি ব্যাংকেও চাকরী করতেন, কিন্তু গানের সাধনায় তিনি কখনো কমতি রাখননি। প্রথমদিকে গান করার সময় জর্দা দিয়ে অনবরত পান খাওয়ার অভ্যাসের কারণে কিছু শব্দের উচ্চারণ নিয়ে সমস্যায় পড়তেন। একদিন প্রখ্যাত সুরকার সত্য সাহার সামনে বসে তিনি গান গাইছিলেন। কিন্তু একটা শব্দের উচ্চারণ ঠিকঠাক কোনোভাবেই হচ্ছিল না। সত্য সাহা তাকে বললেন, “হবে কীভাবে ? সারা দিন মুখে পান দিয়ে রাখলে উচ্চারণ বের হবে ?” তারপর থেকে নাকি আর কখনো তার মুখে পান দেখা যায়নি।
তার শৈশব-কৈশোর কেটেছে আধুনিক বাংলা গানের জোয়ারের মধ্যে। তাই স্বাভাবিকভাবেই উপমহাদেশের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ মল্লিক, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, জগজিৎ সিং-দের ভক্ত ছিলেন তিনি। এদের গান শিল্পী হওয়ার ক্ষেত্রে সুবীর নন্দীকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে, প্রভাবিত করেছে। তার জনপ্রিয় কিছু গানের মাঝে আছে- আমার এ দুটি চোখ, হাজার মনের কাছে প্রশ্ন করে, বন্ধু হতে চেয়ে তোমার, বৃষ্টির কাছ থেকে, একটা ছিল সোনার কন্যা, চাঁদের কলঙ্ক আছে, ও আমার উড়াল পঙ্খী রে, দিন যায় কথা থাকে, হাজার মনের কাছে, কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো, সেই দুটি চোখে, কেন ভালোবাসা হারিয়ে যায়, তোমারই পরশে জীবন, বন্ধু তোর বরাত নিয়া, মাস্টার সাব, আমি নাম-দস্তখত শিখতে চাই ইত্যাদি।
উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ও সম্মাননার মাঝে আছে- একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ৫বার। এছাড়াও আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। চ্যানেল আই থেকে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেছেন।
গত ১৪ এপ্রিল পরিবারের সাথে শ্রীমঙ্গল থেকে ঢাকায় ফেরার পথে ট্রেনে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাত ১১ টার দিকে তাকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ডায়াবেটিসে ভুগছিলেন। তাছাড়াও তার হার্টে বাইপাস অপারেশন করা হয়েছিল। আবার কিডনিতেও সমস্যা ছিল। টানা ১৬ দিন সেখানে চিকিৎসাধীন থাকার পর গত ৩০ এপ্রিল উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়।
সিঙ্গাপুর নেওয়ার কয়েকদিন পর সুবীর নন্দীর শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলেও তারপর থেকে ক্রমেই অবস্থার অবনতি হতে থাকে। সেখানে চিকিৎসা চলাকালেও তিনি পরপর তিনবার হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। শেষমেষ গত ৭মে মঙ্গলবার ভোর সাড়ে চারটার দিকে তিনি দৈহিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। দৈহিকভাবে তার মৃত্যু হলেও আত্মিকভাবে তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন সঙ্গীতপ্রেমীদের মাঝে।
শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ:-
একুশে পদকজয়ী শাহনাজ রহমতুল্লাহর জন্ম ১৯৫২ সালের ২ জানুয়ারি। তার বাবা এম ফজলুল হক এবং মা আসিয়া হক। মায়ের হাতেই ছোটবেলায় শাহনাজের গানের হাতেখড়ি। মাত্র ১১ বছর বয়সে রেডিও এবং চলচ্চিত্রের গানে তার যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৩ সালে। পাকিস্তানে থাকার সুবাদে করাচি টিভিসহ উর্দু ছবিতেও গান করেছেন। গান শিখেছেন গজল সম্রাট মেহেদী হাসানের কাছে। পাকিস্তান আমলে রেডিওতে তার নাম বলা হতো শাহনাজ বেগম।
১৯৬৪ সালে টিভিতে প্রথম গান করেন। সে হিসাবে সংগীত শিল্পী হিসাবে তার পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হয় ২০১৪ সালে। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের ক্যারিয়ারে- এক নদী রক্ত পেরিয়ে, জয় বাংলা বাংলার জয়, একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়, একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল, প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’সহ অসংখ্য কালজয়ী গান গেয়েছেন তিনি। তার মৃত্যুতে নেমেছে শোকের ছাঁয়া। বিবিসি এক জরিপে সর্বকালের সেরা কুড়িটি বাংলা গানের তালিকায় তার গাওয়া চারটি গান রয়েছে। বছর সাতেক আগে হঠাৎ গান ছেড়ে ধর্ম-কর্মে মনোযোগী হন কিংবদন্তি সংগীতশিল্পী শাহনাজ রহমতুল্লাহ। বাইরে আসতেন না খুব একটা। নামাজ-কোরআনের সঙ্গেই কেটেছে তার জীবনের শেষ দিনগুলো। শাহনাজ রহমতুল্লাহর মেয়ে সিনথিয়া থাকেন লন্ডনে। আর একমাত্র ছেলে ফয়সাল যুক্তরাষ্ট্রের এক ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ করে এখন কানাডা প্রবাসী। তিনি রাজধানীর বারিধারা বাসায় থাকতেন। তার বড় ভাই প্রয়াত সুরকার আনোয়ার পারভেজ ও ছোট ভাই চিত্রনায়ক জাফর ইকবাল। গত ২৩শে মার্চ শনিবারে রাতে তিনি হার্ট অ্যাটাকে বারিধারার নিজের বাসায় মৃত্যুবরণ করেন। চারদিকে নেমে আসে শোকের ছাঁয়া। সঙ্গীতাঙ্গনে চলে আসে হারানোর কষ্ট। সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন শাহনাজ রহমতুল্লাহ। সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে তার জন্য দোয়া ও মাগফেরাত কামনা করছি।
শিল্পী খালিদ হোসেন:
খালিদ হোসেন ছিলেন একজন বাঙালি নজরুলগীতি শিল্পী এবং নজরুল গবেষক। তিনি নজরুলের ইসলামী গান গাওয়ার জন্য সুপ্রসিদ্ধ। তার ছয়টি নজরুলগীতির এ্যলবাম এবং ১২টি ইসলামী গানের এ্যলবাম প্রকাশিত হয়েছে। সঙ্গীতের অবদানের জন্য ২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন।
খালিদ হোসেন ১৯৩৫ সালের ৪ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি পরিবারের সাথে কুষ্টিয়ার কোর্টপাড়ায় চলে আসেন। ১৯৬৪ সাল থেকে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। খালিদ হোসেন সঙ্গীত প্রশিক্ষক ও নিরীক্ষক হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের সকল মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড ও বাংলাদেশ পাঠ্যপুস্তক বোর্ড দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটে নজরুলগীতির আদি সুরভিত্তিক নজরুল স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদের সদস্য। খালিদ হোসেনের ছয়টি নজরুলগীতির এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তার সর্বশেষ নজরুলগীতির এ্যলবাম হল শাওনো রাতে যদি। এছাড়া তার ১২টি ইসলামী গানের এ্যলবামও প্রকাশিত হয়েছে। তার একমাত্র আধুনিক গানের এ্যলবাম চম্পা নদীর তীরে।
নজরুলগীতিতে অনবদ্য অবদানের জন্য ২০০০ সালে বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে একুশে পদক পান। এছাড়াও তিনি নজরুল একাডেমি পদক, শিল্পকলা একাডেমি পদক, কলকাতা থেকে চুরুলিয়া পদকসহ বহু সম্মাননা লাভ করেছেন।
খালিদ হোসেন ২০১৯ সালের ২২শে মে ঢাকার জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) মৃত্যুবরণ করেন। ২৩শে মে বৃহস্পতিবার বাদ এশা তারাবি নামাজের পর রাত ১০টায় কুষ্টিয়ার কেন্দ্রীয় পৌর-গৌরস্থানে ৩য় জানাযা শেষে মায়ের কবরের পাশে দাফন করা হয় তাকে। সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে খালিদ হোসেন এর জন্য দোয়া রইল। আল্লাহ যেন তাকে বেহেস্ত নসিব করেন।
সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করি, তাদের জন্য মন থেকে দোয়া করবেন আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাতবাসী করেন। বাংলা গানকে ভালবাসুন বাংলা গানের সাথে থাকুন বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে ভালবাসুন। সঙ্গীতাঙ্গন এর সাথে থাকুন। সংগীতের নানা খবর জানুন। সবার সুস্থ সুন্দর জীবন কামনা করি।