কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
পৃথিবীতে মানুষ আসে একা এবং পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়ও একা কিন্তু চলে যাবার সময় প্রতিটি মানুষই তাঁর জীবনের সুখ দুঃখের স্মৃতিগুলো রেখে যায় তাঁর আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের কাছে। সবাই হয়তো ভুলে যায় একসময়, শুধু ভুলতে পারেনা তাঁদের সন্তানরা। যারা তাঁদের শরীরে বহন করে চলেছে বাবা মায়ের রক্ত। তাই সন্তানরা আজীবন বয়ে বেড়ায় তাঁদের স্মৃতি বিজড়িত ক্ষণ বা মুহূর্তগুলো। আর যে চলে গেছে সে যদি হয় একজন অসাধারণ মানুষ, তাঁর কর্মক্ষেত্রে অথবা তাঁর সৃষ্টিতে, তাহলে তো কথাই নেই! তখন হয়তো তাঁর সন্তানদের সাথে সাথে অন্যরাও মনে রাখবে। তেমনই একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ-এর পুত্র সঙ্গীত গবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন খান। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। গত ২৪ নভেম্বর সকালে ঘুমের ভেতর ইহলোক ত্যাগ করে চলে যান না ফেরার দেশে। শ্রদ্ধেয় গবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন খান-এর এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ের নাম-রিনাত ফৌজিয়া খান এবং ছেলেদের নাম-তারিফ হায়াত খান ও তানিম হায়াত খান। বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ফৌজিয়া ইয়াসমিন তাঁর স্ত্রী। শ্রদ্ধেয় মোবারক হোসেন খান-এর মেয়ে রিনাত ফৌজিয়া খান একজন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট সেতার বাদক। তিনি তাঁর বাবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কখনো কখনো হেসে উঠেছেন ঠিকই কিন্তু সেই হাসির মধ্যে ছিল প্রিয়জন হারানোর অব্যক্ত বেদনা। তিনি স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে তাঁর বাবার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। সেই স্মৃতিচারণ ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরা হল-
আপনার বাবার সাথে আপনার কিছু স্মৃতিচারণ খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
আপনিতো সামনাসামনি কখনো দেখেননি! যদি দেখতেন তাহলে বুঝতেন। তবে যারা সবসময় আমাদের বাসায় যাওয়া আসা করতেন তাঁরা দেখেছেন, আমি আমার বাবার অসম্ভব আদরের একটি মেয়ে ছিলাম।
আপনিই কি বড় ?
হ্যাঁ, আমার পরে দুটো ভাই হয়েছে। আব্বা, আমাকে সবসময়ই মা বলে ডাকতেন। মা ছাড়া কোনো কথাই ছিলনা, মা বলতে সে অজ্ঞান ছিল। আমাকে নিয়ে তাঁর লেখা,’রিমির কথা বলা’ বইটি কি পড়েছেন ?
দুঃখিত! আমার পড়া হয়নি।
তাহলে তো আপনাকে পুরো ঘটনাই বলতে হবে। আমার ডাক নাম রিমি। আমি যখন ছোটবেলায় কথা বলা শুরু করলাম এবং একটা জিনিসকে আরেকটা বলতাম যেমন-ডিগবাজীকে গিজগিজ বলতাম। সাধারণতঃ বাচ্চারা যেমন উচ্চারণে ভুল করে এবং এক জিনসকে আরেকটা বলে আরকি! আর আমার আধো আধো কথা, সেগুলি ছিল আব্বার কাছে এক একটা বিস্ময়! আব্বা আমার প্রত্যেকটি কথা তাঁর নোটবুকে লিখে রাখতেন, যেমন কাকে কি বললাম এবং কোন্ ঘটনার সময় কি বল্লাম। এর পরবর্তী সময় এইগুলো নিয়ে তিনি রীতিমত গল্প আকারে একটি বই লিখলেন। বইটির নাম দিলেন,’রিমির কথা বলা’। এই বইটি নিয়ে ডঃ আলী আহসান সাহেব বিটিভিতে এক সাক্ষাৎকারে দারুণ বক্তব্য দিয়েছিলেন। সে বলেছিলেন যে, বাংলা সাহিত্যে এই ধরণের বই কখনোই লিখা হয়নি, এটা এক ও অনন্য। নিজের বাচ্চা মেয়েটা যে কথা বলতে শিখছে, এটা নিয়েও যে গল্পের বই হতে পারে! তা ভাবতেই অবাক লাগছে। এই বইতে খুব মজার মজার ঘটনা ছিল। তার মধ্যে একটি ছিল এমন যে, আমার খুব ছোটবেলায় আব্বা বিছানায় বসে গল্পের বই পড়ছে আর আমি পাশে বসে খেলছি। হঠাৎ করে আমি আব্বাকে হাত দিয়ে সরিয়ে জায়গা করে নিচ্ছি। আব্বা আমাকে বলছেন, আমাকে সরাচ্ছিস কেন মা ? তখন আমি বলছি গিজ গিজ খাবো। তখন আমি ডিগবাজীকে গিজগিজ বলতাম। আব্বা বইতে লিখেছেন এইভাবে-আব্বা মনে মনে ভাবছেন যে, গিজগিজ কি হতে পারে সেটা তো বুঝতে পারছিনা। এক হচ্ছে মেয়েটা মনসুর (এক ধরনের মিষ্টি) খেতে পচ্ছন্দ করে হয়তো মনসুর খেতে চাইছে কারণ মনসুর খেলে মুখের মধ্যে গিজগিজ করে। আব্বা আমাকে বল্ল, আচ্ছা মা আমি তোমাকে মনসুর কিনে এনে দিচ্ছি, আমি জামাটা পড়ে নেই! এই বলে আব্বা বিছানা থেকে নেমে জামা পড়ল তখন আমি বিছানায় ডিগবাজী খেলাম, হা হা হা। আমি তখন নতুন নতুন ডিগবাজী খেতে শিখেছি। তখন আম্মা এসে হাজির। আম্মা আব্বাকে বলছেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ ? আব্বা বললেন, ওর জন্য খাবার কিনে আনতে। আম্মা বল্লেন, তুমি কি বুঝতে পারছোনা! ও ডিগবাজী খাবে তাই তোমাকে ঠেলে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে। ঐ দ্যাখো তোমার মেয়ে খাটের ওপর ডিগবাজী খাচ্ছে। এই রকম অনেক মজার মজার ঘটনা বইতে লিখা আছে। বইয়ের প্রচ্ছদটি আমার এক বছর বয়সের একটা ছবি নিয়ে রিটাচ্ করে ছবিটি এঁকে দিয়েছিলেন, নামকরা আর্টিস্ট সৈয়দ ইকবাল। বইটি আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি ঐ সময় প্রকাশিত হয়েছে।
আপনি যখন বড় হলেন তখন আপনার সাথে আপনার বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল ? যেমন ধরেন, অনেকের বাবা আছেন না! একটু রাশভারী হয়।
আমার আব্বা মানুষ হিসেবে আসলেই একজন রাশভারী মানুষ ছিলেন। উনার অফিসের সবাই ওনাকে রিতিমত ভয় পেত, এরকম অবস্থা! কিন্তু বাসায় উনি একদম অন্যরকম মানুষ ছিলেন। আর আমার সাথে সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আমাদের তিন ভাইবোনের সবার সাথেই আব্বার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তবে আমার সাথে একটু বেশী। আমাকে তো উনি ছোটবেলায় কোল থেকেই নামাতেন না। আর বড় হয়ে আমি আমার সব কথা আব্বার সাথে শেয়ার করতাম। তিনি সবকিছু শুনে সবসময় আমাকে পরামর্শ দিতেন। বই পড়ার ব্যাপারে তাঁর আগ্রহ ছিল অনেক বেশী। আমাদের বলতেন যত বই লাগে আমাকে বলবে, আমি কিনে দিব কারণ বইয়ের কোনো বিকল্প নাই। আব্বা আমাদের সাথে খেলাধুলাও করতেন। আমাদের খুব বেড়াতে নিয়ে যেতেন। বেড়াতে যাওয়া মানে হল, শিল্পকলায় যত ধরনের চিত্রপ্রদর্শনী হত, সবগুলতে আমাকে আর আমার পিঠাপিঠি ভাই রুপককে নিয়ে যেতেন। তানিম আমাদের চেয়ে অনেক ছোট ছিল। যাই হোক! আমাকে আর আমার ভাই রুপককে তাঁর দুইহাতে দুজনকে ধরে তিনি সব জায়গায় নিয়ে যেতেন। শিল্পকলা একাডেমিতে আন্তর্জাতিক চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হয়েছিল, সেখানে পাবলো পিকাসোর মত বড় বড় চিত্রশিল্পীদের ছবি ছিল সেখানেও আমাদের দুইভাইবোনকে নিয়ে গিয়েছেন। আমাদের বয়স তখন ৫/৬ এরকম হবে। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতাম কিন্তু কিছুই বুঝতাম না। তবুও আব্বা তখন নিয়ে যেতেন তাঁর সাথে করে।
উনি হয়তো চিত্রকর্ম খুব পছন্দ করতেন!
না, তা নয়। আমি বড় হয়ে বুঝেছি, চিত্রকর্ম, সেতার এবং উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের অনুষ্ঠানে আমাদের নিয়ে গেছেন এইজন্য যে, আমাদের টেস্ট বা রুচির বিকাশের জন্য। আমি যখন বড় হয়েছি এবং সন্তানের মা হয়েছি তখন বুঝতে পেরেছি এই বিষয়টা। ছোটবেলায় তখন তো বুঝতামনা, ভাবতাম! আব্বা এগুলো কি করছে, আমাদের দুই ভাইবোনকে নিয়ে। পরে একটু একটু করে বুঝতে শিখেছি, আব্বার চিন্তা ভাবনা ওটাই ছিল যে, ছেলেমেয়েদের একটা ভালো পরিবেশ দিতে হবে। ওদের রুচিটাও তৈরি করে দিতে হবে সেইভাবে। যেহেতু আমাদের পরিবারটি সঙ্গীতের পরিবার এবং অন্য পরিবার থেকে আলাদা, তাই হয়তো আমাদের দুই ভাইবোনকে সব জায়গায় নিয়ে যেতেন। সাধারণতঃ আমরা জানি মায়েরা বাচ্চাদের রূপকথার গল্প শোনায় কিন্তু আমার আব্বা যখন ঘরে থাকতেন তখন আমাদের নানান রকম দেশী বিদেশী রূপকথার গল্প শোনাতেন। সেটা একটা দারুন বিষয় ছিল আমাদের জন্য আব্বা দেশী বিদেশী রূপকথার বই কিনে আনতেন পড়ার জন্য আবার মাঝে মাঝে তিনি নিজেই পড়ে শোনাতেন। তাঁর নিজেরও অনেক রূপকথার গল্প জানা ছিল। আমি আর আমার ভাই রুপক আব্বার সাথে তাঁর দুইপাশে বিছানায় শুয়ে গল্প শুনতাম। দেশী গল্পের বই শেষ হয়ে গেলে তিনি বিদেশী মানে জার্মানির বিখ্যাত ছোটদের গল্পের বই ‘হ্যান্সেল এন্ড গেটেল’ ইংরেজি বইটি কিনে এনে আমাদের বাংলা করে পড়ে শুনালেন। গল্পটি ছিল দুই ভাইবোন পানি আনতে গিয়ে হারিয়ে যায়। তারপর তিনি ঐ বইটির প্রতি আগ্রহ হয়ে বইটি বাংলায় অনুবাদ করে তাঁর বইটির নাম দিলেন ‘রিমি ও রুপক’। ঐ গল্পের বোনটির নাম দিলেন আমার নাম ‘রিমি’ আর ভাইটির নাম দিলেন ‘রুপক’। গল্পটি অনুবাদের পর পত্রপত্রিকায় ছাপা হল। আব্বা আমাদের পত্রিকা এনে দেখালেন, আমরা তো খুব খুশী গল্পটাতে আমাদের নাম দেখে। তারপর এটা বই আকারে প্রকাশ পায়। আব্বাকে নিয়ে অনেক ঘটনা আছে তবে এই ঘটনা না বললেই নয়! আব্বা কখনই রক্ত দেখতে পারতেন না। উনি প্রায়ই বলতেন রক্ত দেখলে তাঁর মাথা ঘুরে যায়। আমার দাদুর খুব ইচ্ছে ছিল যে, উনি আব্বাকে ডাক্তারি পড়াবেন। আব্বা দাদুকে বললেন, অসম্ভব! আমার রক্ত দেখলে মাথা ঘুরে যায়, আমি ডাক্তারি পড়ব কিভাবে ? আমি অন্য কোনো লাইনে পড়বো। উনি হিস্ট্রিতে এম এ পাস করেছিলেন। দাদু কিন্তু তাঁকে সাইন্সে পড়িয়েছিলেন কিন্তু আব্বা চেঞ্জ করে আর্টস-এ চলে যান। মাঝে মাঝে আম্মা আমাদের সাথে খেলতেন। একদিন খেলছি ঘরের মধ্যে এমন সময় আম্মা বল্লেন, ছোটবেলায় আমরা ব্যাঙ সেজে লাফাতাম। কেমন করে জানতে চাইলে আম্মা মুখেই বললেন কেমন করে ব্যাঙ সাজতেন। আমি ঐ কথা শুনে ব্যাঙের মত হতে গিয়ে পা উঁচু করে হাতের মধ্যে ভর করে দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাঙের মত লাফ দিতে গিয়ে সামনের দিকে মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছি। আর মুখের মধ্যে নাকটি তো আগে পড়ে। মেঝেতে নাকটি পড়ে নাক ফেটে রক্ত পড়তে লাগলো। আম্মা তাড়াতাড়ি রক্ত বন্ধ করার জন্য পানি আর বরফ আনতে গেল। এদিকে আব্বা রক্ত দেখে ভয় পেয়ে, ওখানেই বসে পড়ে আমার এক হাত ধরে আরেকটি হাত নিজের মাথায় নিয়ে, মা গো আমার কি হবে গো বলে কাঁদতে লাগলেন। আম্মা এসে আব্বাকে বল্লেন, তুমি কাঁদছো কেন বসে বসে ? কোথায় মেয়েকে বরফ দিয়ে মেয়ের রক্ত বন্ধ করবে, তা না করে কাঁদছো! তারপর আম্মা বরফ দিয়ে আমার রক্ত পড়া বন্ধ করেছেন। অনেক পরিবারে ছেলেমেয়েকে আলাদা করে দেখে কিন্তু আব্বা কখনোই আমাদের ভাইবোনকে আলাদা করে দেখেন নাই। একইভাবে আমাদের দুই ভাইবোনকে সমানভাবে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। আব্বা রোজ সন্ধ্যায় আমাকে পড়াতে বসাতেন। আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাই তখন আমার দুই ক্লাস নিচে পড়তেন। তখন আব্বা আম্মা আমাদের দুজনকে পড়ানোর জন্য ভাগ করে নিলেন। আম্মা রুপককে পড়াবেন আর আব্বা আমাকে পড়াবেন। সন্ধ্যা হয়ে গেলে ওনারা দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে দুই ঘরে গিয়ে পড়াতেন এবং আব্বা সবাইকে বলে দিয়েছিলেন যে, সন্ধ্যা হলে আমি আমার মেয়েকে পড়াই এই সময় কেউ আমার বাসায় আসবেন না। পড়া লেখার ব্যাপারে তিনি খুব সিরিয়াস ছিলেন।
আপনার বাচ্চা কয়জন ?
আমার এক ছেলে ওর নাম তাহসিন খান। আমার ছেলে অনেক বড়, ৩২ বছর বয়স। সে এখন নটডেম ইউনিভার্সিটির আইনের এ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসর এবং বিভাগীয় চেয়ারম্যান।
উনার সাথে আপনার আব্বার কিরকম সম্পর্ক ছিল ?
আরে বাব্বা! এটা তো আমি বলে শেষ করতে পারবোনা। আমাদের বাসায় আমরা তিনজন-আমি, আম্মা আর আমার ছেলে। আমার আব্বা আমার ছেলেকে এমনভাবে মানুষ করেছেন যে, আব্বা চলে যাওয়ার পর আমি আর আম্মা শক্ত থেকেছি, কাঁদছিনা কারণ কাঁদলে অন্যরা ভেঙ্গে পড়বে কিন্তু আমার এই ছেলেটা, এত বড় একটা ছেলে! সে কিনা যখন তখন হাউমাউ করে কাঁদছে। আব্বা বাচ্চাদেরকে খুব ভালোভাবে দেখে রাখতে পারতেন। ছোটবেলাতে আমাদের যেমন সুবিধা হয়েছে তেমনই আমার ছেলের বেলায়ও তাই। আমার আম্মা একটি বেসরকারী কলেজে চাকরী করতেন। আমাদের ছেলেবেলায় আমাদের মানুষ করার জন্য চাকরীটা ছেড়ে দিয়েছিলেন। আম্মা আমাদের জন্য অনেক সেক্রিফাইস করেছেন। চাকরী ছেড়ে দিলেও যখন গান রেকর্ডিং-এর জন্য যেতেন তখন আব্বাই আমাদের সামলাতেন। আমরা যখন বড় হয়ে গেলাম তখন আম্মা আবার ঐ চাকরীটা নিয়ে নিয়েছিলেন, বেসরকারী কলেজতো তাই অসুবিধা হয় নাই। ওটা ছিল মতিঝিল টিএনটি কলেজ। কলেজটি ছিল নাইট কলেজ। সন্ধ্যার পর আম্মার ক্লাস থাকত। আমার অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে বিয়ে হয়েছে এবং সেকেন্ড ইয়ারেই আমার ছেলেটি হয়। আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় পড়তে বসতাম। আম্মা তখন বলেছেন, একদম মনোযোগ অন্যদিকে না। মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করবে, ভাল রেজাল্ট করতে হবে। তোমার আব্বা আর আমি তোমার ছেলেকে দেখে রাখব। আমরা আছি কোনো সমস্যা নাই। আব্বা আমার ছেলেটার সবকিছুই করতো, আম্মার অনুপস্থিতিতে। তারপর ছেলেটা যখন একটু বড় হল তখন আব্বা আমার ছেলেটাকে নিয়ে রোজ বেড়াতে যেত। ওখানে নিয়ে ওকে খাওয়াত। অফিসার্স ক্লাবে টেনিস খেলা হত। টেনিস খেলা শেষ হলে সেকেন্ড হ্যান্ড বলগুলি তারা বিক্রি করে দিত। একটি ডিব্বায় তিনটি বল থাকতো। আব্বা ঐ বল আমার ছেলের জন্য কিনে নিয়ে আসত। আমার ছেলে যখন ধানমন্ডি স্কুলে পড়ত, ছোটবেলা থেকেই আব্বা ওকে আনা নেওয়া করত। কখনো এমন হয়েছে যে, স্কুলে কোনো কারণে তাড়াতাড়ি ছুটি হবে তখন আব্বা দারোয়ানের পাশে চেয়ারে বসে থাকত। কেউ দেখে চিনে ফেললে বলতো, স্যার আপনি এখানে কেন ? টিচার্স রুমে গিয়ে বসেন। আব্বা বলতো, ভাব্বেন না এবং কাউকে বলবেন না। স্কুল ছুটি হলে আমি আমার নাতিকে নিয়ে চলে যাব। আমার ছেলের সাথে আমার আব্বার অনেক স্মৃতি যা বলে শেষ করা যাবেনা।
হয়তো এইজন্যেই তিনি এত ভেঙ্গে পড়েছেন!
এক্কেবারে! আব্বা চলে যাওয়ার পর থেকে দিনে কয়েকবার খুব জোরে জোরে কাঁদত। আমিও এত জোরে জোরে কাঁদি নাই। আমি তখন ভাই বলেন, বোন বলেন ছেলেমেয়ে বলেন, সব আমি একা। আমি এক হাতে সমস্ত কিছু সামলিয়েছি, বিশ্বাস করেন! তখন আমি শুধু আল্লাহকে বলেছি আমাকে শক্তি দেও, আমি যেন ভেঙ্গে না পড়ি! শিল্পকলা থেকে আমার ফোন নম্বর সমস্ত মিডিয়াকে দিয়ে দিয়েছে। প্রত্যেকটি নিউজপেপার, প্রত্যেকটি চ্যানেল থেকে আমাকে কল করেছে, আমি কান্নাকাটি না করে সবাইকে সঠিক তথ্যটি দিয়েছি। আমার ছেলেটি কিন্তু নিজেকে সামলাতে পারে নাই।
চলে যাওয়ার শেষের দিকে আপনার আব্বার শারীরিক অবস্থা কেমন ছিল ?
শেষের দিকে তিনি চলে যাবেন যখন ব্যাপারটা আমার কাছে জানা থাকলেও অজানা! আমি জানি আমার আব্বার ৮৫ বছর বয়স, আমি জানি যে আব্বার অসুখটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে গেছে, কোনো আশা নাই! সে চলে যাচ্ছেন, বেশি দিন থাকবেনা। যদিও ডাক্তার বলেছেন, এই ধরনের রুগী অনেক সময় পাঁচ বছরও টিকে থাকেন আবার হুট করে চলেও যান। সে চলে যাচ্ছেন, বেশী দিন থাকবেন না, এটা জানি। দিনে দিনে আলোটা নিভে আসছে আমারই চোখের সামনে জানি। তারপরেও চলে যাওয়া দেখা খুব কষ্টকর! শেষের দিকে আমি আর আম্মাই তাঁকে খাওয়াতাম। আম্মা সবচেয়ে বেশী পরিশ্রম করেছেন। শেষের দিকে খাওয়ানো যেতনা। বাথরুমে নিয়ে যাওয়ার উপায় ছিলনা।
আম্মা গা মুছে দিতেন, মাথা ধুঁয়ে দিতেন। দুপুরে নরম খাবার খাইয়ে দিতেন। বিকেলে আমি কলেজ থেকে এসে খাইয়ে দিতাম। আম্মা আবার রাত্রে খাইয়ে দিতেন। শেষের দিকে উনি তাঁর অসুখের কারণে কাউকে চিনতেও পারতেন না। শেষ পর্যন্ত আমাদের তিনজন ছাড়া কাউকেই তিনি চিনতে পারতেন না। অনেক সময় আমি আর আম্মা কথা বললে উনি রাগ করতেন কারণ উনি খেতে চান না আর আমরা জোর করে খাওয়াই। তাই অনেক সময় আম্মাকে আর আমাকে রাগ দেখাতেন, হাত দিয়ে আমাদের সরিয়ে দিতেন কিন্তু আমার ছেলেকে দেখে তেমন কিছু করতেন না। ওনার দৃষ্টিশক্তিও বিক্ষিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে কারো দিকে মনোনিবেশ করে দেখতে পারতেন না। তাঁর চোখ দেখলেই বুঝা যেত আকাশে বাতাসে কোথায় যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেন। আমি যখন আব্বা বলে ডাকতাম তখন তাকাতেন। সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও বুঝতে পারতেন না কিন্তু আমার ছেলে দরজার কাছে গেলেই তাকে দেখতে পেত। হাত ইশারা করে ডাকত। ও কাছে গেলে ওকে হাতে ঘষে ঘষে আদর করে দিত। এটা ছিল তাঁর আদর। হাতে কাঁধে ঘষে ঘষে আদর করেছে তারপর ইশারা করে বলেছে তুমি যাও। এই কথা বলে আমার ছেলে কত যে কান্না করেছে।
খুবই কষ্টকর! আপনার আব্বার কাজ নিয়ে আপনাদের কি কোনো চিন্তাভাবনা আছে কি ?
আব্বা এমন ঘুছানো মানুষ ছিলেন যে, তা বলার মত না। আব্বা সমস্ত ঘুছিয়ে রেখে গিয়েছেন বলা যায়। একদম সম্পদের মত সব ঘুছিয়ে রেখে গেছেন। ওনার জীবন কাহিনী নিয়ে দুই খন্ডের বই করে গেছেন। একটির নাম জীবন স্মৃতি আরেকটির নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছিনা। সেখানে উনি তাঁর সারাজীবনের গল্প বলে রেখেছেন। আর যা যা ছিল যেমন বিদেশী অনুবাদ, ঈশপের গল্প সংকলন করা, তিনি তা করে গেছেন। এরপর সঙ্গীতের যেই বইগুলো ছিল, ঐ গুলোর জন্যই তো তিনি ২১শে পদক, স্বাধীনতা দিবসের পদক পেয়েছেন। ঐ গুলো সব সঙ্গীতের ওপরে লেখা বই। প্রথম লেখাগুলো ছিল ইতিহাস ভিত্তিক। সঙ্গীত জগতে আমাদের পরিবারের একটি জায়গা আছে। বলা যেতে পারে সঙ্গীতের ঐতিহাসিক স্থান। এই জীবনীগুলো তিনিই লেখা আরম্ভ করলেন প্রথমে যার কারণে হিস্ট্রিটা থেকে গেল। মানে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ কিভাবে শুরু করেছিলেন। তাঁরা আসলেন, জয় করলেন এই কথাগুলো আসলে আব্বা গুচ্ছিয়ে না লিখলে কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ জানতেন না। আব্বা কিন্তু রিতিমত এই ইতিহাসই প্রতিষ্ঠা করে গেছেন। এটারই ধারাবাহিকতায় যার কারণে এখন স্কুলে ক্লাস ওয়ান থেকে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত সঙ্গীতকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে এবং উনাদের জীবনীগুলো এখন স্কুলে পড়ানো হচ্ছে। এটা শুরু করার পেছনেতো আব্বার অবদান স্বীকার করতেই হবে। এগুলো উনি মোটামুটি সব করে গেছেন। অপ্রকাশিত বেশী কিছু নাই। বইয়ের ব্যাপারেও উনি সবকিছু করে গিয়েছেন। আমি চেস্টা করছি কিছু কিছু পাবলিশার আছেন এখন ওনার বই, এখন মানে কি, আব্বা বেঁচে থাকতেই, আব্বা নাই তা না! আব্বার লেখা বই চাচ্ছিলেন সামনে ২১শে বই মেলায় আনার জন্য কিন্তু আব্বা তো পুরোপুরি বিছানায় পড়া ছিলেন। আমি ওনার ফাইল থেকে বের করে খুঁজে খুঁজে আবার সংকলন লিখে মোটামুটি গুছিয়ে গাছিয়ে এক পাবলিশারকে চারটি সংকলন করে দিয়েছি। ও হয়তো আশা করেছিল আব্বা আরও কিছুদিন থাকবেন এবং আব্বা থাকতে থাকতেই পাবলিশ করবেন কিন্তু ঐ প্রকাশকের কপাল খারাপ! আব্বা হুট করেই চলে গেলেন। আব্বা তাঁর লেখা ও গবেষণা
নিয়েই মুলত ছিলেন।
আপনার আম্মা ভালো আছেন ?
আলহামদুলিল্লাহ্! ভালো আছেন। অনেক ভালো। আম্মা ভালো ছিলেন বলেইতো রক্ষা। আল্লাহ্র কাছে এটাই দোয়া করতাম। কারণ আব্বার এই শেষ সময় তিনিই দেখাশুনা করতেন সব। তাই আল্লাহ্র কাছে এই দোয়া করতাম, তুমি আম্মাকে ভালো রেখো।
ঐ সময়টা আপনার ভাইয়েরা কাছে ছিলেননা এবং তাঁদের দেশে আসতে দেরী হচ্ছিল তাই হয়তো আল্লাহ্র তরফ থেকেই আপনাদের শক্তি যুগিয়েছেন। তা না হলে তো আপনারা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়তেন! সব কিছু ভালোভাবে হতোনা। যাই হোক, আল্লাহ্ সকলের সহায়! আপনার আব্বার জন্য এই দোয়াই করি, আল্লাহ যেন তাঁকে জান্নাতবাসী করেন, আমীন। সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে আপনার পরিবারের সকলের জন্য শুভকামনা রইল। আপনাদেরও সবার জন্য শুভকামনা।
This post will help the internet viewers for setting
up new webpage or even a blog from start to end.