– মোশারফ হোসেন মুন্না।
দেশ বিদেশের তারকাদের ফ্যাশন, লাইফস্টাইলের প্রতি ভক্তদের থাকে তীব্র নজরদারি। তিনি যদি হন রকস্টার, তবে তরুণ ভক্তদের আগ্রহ যেন বেড়ে যায় তড়িৎ গতিতে। বলছি কষ্ট পেতে ভালোবাসি, ফেরারী মন, এখন অনেক রাত, এই রুপালী গিটার ফেলে একদিন চলে যাবো দূরে- এর মতো হাজারো সুরের ভালো লাগা গানের শিল্পী যার ঠোঁটের নিচে থুতনিতে ছোট্ট দাড়ি। হাতে ঘড়ি অথবা ব্রেসলেট। অন্যহাতে গিটার। মাথায় ক্যাপ। প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী, স্টাইল আইকন, গিটারের জাদুকর তিনি আমাদের প্রিয় আইয়ুব বাচ্চু। অকালে বিদায় নিয়েও যুগের পর যুগ ভক্তদের কাছে অমর হয়ে থাকবেন। চির অমর থাকবে তার ফ্যাশন আর ছিমছাম স্টাইলও। সব সময় মাথায় বিভিন্ন ক্যাপ পরে কনসার্ট করতেন তিনি। পরতেন গোল হ্যাটও। ক্যাপ আর হ্যাট না পরলে বেশিরভাগ সময়েই মাথায় কাপড় বাঁধতেন। ক্লিন সেভ কিন্তু ঠোঁটের নিচে থুতনিতে ছোট্ট দাড়ি ছিল তার ফ্যাশনের অংশ। জীবনের শেষ কনসার্টেও এমন স্টাইলে মঞ্চ মাতিয়ে ভক্তদের গান শোনান।
‘এই রুপালি গিটার ফেলে
একদিন চলে যাবো দূরে, বহু দূরে
সেদিন চোখে অশ্রু তুমি রেখো
গোপন করে।
যে সুরে গান বেঁধে একদিন এভাবে চলে যাওয়ার কথা বলেছিলেন গত এক বছর আগেই আইয়ুব বাচ্চু, সেই গিটার, সেই সুর রেখে সত্যিই পৃথিবী থেকে আরো বহুদূরের পথে পাড়ি দিলেন লাখো তরুণের প্রিয় এই শিল্পী।
ষাটের দশকে কিউবার বিপ্লবী নেতা চে’গুয়েভারা ক্যাপ পরে তরুণদের মধ্যে ক্যাপকে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। যেটি পরে আস্তে আস্তে সারাবিশ্বের তরুণদের একটা বিশেষ স্টাইল হয়ে দাঁড়ায়। আইয়ুব বাচ্চুকে দেখা যেতো উল্টো স্টাইলে ক্যাপ পরতে। আমাদের দেশে এভাবে ক্যাপ পরা আইয়ুব বাচ্চুর স্টাইল হিসেবেই তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এক সময়। তার পছন্দ ছিল চে’গুয়েভারার টি শার্টও!
আইয়ুব বাচ্চু মিডিয়াতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের তথ্য দিয়েছেন এই সম্পর্কে। সেখান থেকেই জানা যায়, প্রথমে তিনি ব্যক্তিগত কারণে ক্যাপ পরা শুরু করলেও এক সময় এটি তার শখ আর স্টাইল হয়ে দাঁড়ায়। তবে তিনি শুধু একটি নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডেরই ক্যাপ পরতেন। সে ব্র্যান্ডের নাম হচ্ছে ‘ক্যাঙ্গোল’। বিশ্বের প্রায় সব বড় শহরেই এই ব্র্যান্ডের শাখা রয়েছে। তিনি সংগ্রহ করেন ক্যাঙ্গোলের প্রায় সব ধরনেরই ক্যাপ।
মাথায় ক্যাপ পরা প্রথমে তার ভালো লাগা, তারপর ভালোবাসা এবং সবশেষে স্টাইলে দাঁড়ায়। আসলে কোনো জিনিসকে স্টাইলে পরিণত করতে গেলে প্রথমে তার প্রতি ভালোবাসাটা ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আসা চাই। চাই সঠিক পোশাকবোধ, যাতে যে বস্তুটাকে স্টাইলে পরিণত করতে। তার সঙ্গে যেন ব্যক্তিত্ব ও পোশাক-আশাকের সামঞ্জস্য বজায় থাকে। শুধু তাই নয়, তার কথা বলা, চলাফেরা, টি-শার্ট, পায়ে বুট, সু সব কিছুই তরুণরা অনুসরণ করতে শুরু করেন। অনেকে তাকে স্টাইল আইকন মেনে হুবহু তাকে অনুসরণ করেও চলেন। তিনি চির তরুণ, তারুণ্যের আইয়ুব বাচ্চু হয়ে থাকবেন আজীবন।
আইয়ুব বাচ্চু টি-শার্টের প্রতি ছিলেন ভীষণ দুর্বল। অভ্যাসটা ছোটবেলা থেকেই। শৈশবে ঈদ কিংবা পালা-পার্বণে টি-শার্ট থাকত পছন্দের শীর্ষে। মা-বাবার কাছে প্রথম আবদারই থাকত টি-শার্ট কেনা নিয়ে। সেই থেকে এখনো এই পোশাকটির প্রতি ভালোলাগা অটল। তিনি ভোরের কাগজ ফ্যাশনের ২০১৭ এর টি শার্ট নিয়ে প্রকাশিত এক সংখ্যায় বলেছিলেন, অন্য কোনো কাপড় পরে আমার স্বস্তি আসে না। টি শার্ট যেন তার শরীরের সাথে অবিচ্ছেদ্য এবং আরামদায়ক। রাউন্ড নেক টি-শার্টে নিজেকে বেশ তরুণও লাগে। আলাপকালে জানা যায়, নিজ বাসায় আলমারিজুড়ে শুধু টি-শার্টই কয়েক হাজারের কম হবে না। মজার ব্যাপার হলো, অধিকাংশ টি-শার্টের রং-ই কালো।
আইয়ুব বাচ্চুর সবচেয়ে পছন্দের রং কালো। জানিয়েছিলেন, কালো রঙের পোশাকে তাকে ভালো মানায়। কয় দিন পরপরই পছন্দের পোশাক কিনতে ঢুঁ মারতেন দেশ-বিদেশের বিভিন্ন শোরুমে। শুধু টি-শার্ট নয়, হ্যাট, জিন্স প্যান্ট ও কনভার্স সব কিছুতেই আছে তার নিজস্ব পছন্দ। তবে টুপিতে কালো ছাড়াও প্রিয় ছিল গ্রে আর সাদা রঙের নানা চেক বা স্ট্রাইপও। গানের কারণে নিউইয়র্ক গেলে ‘কেঙ্গল”র হ্যাট কিনতেন সবার আগে। কনসার্ট ছাড়া ঘরেও টি-শার্ট পরতেন এই রকস্টার।
বাইরে আড্ডা বা কনসার্টে তার প্রিয় পোশাকের সাথে সবসময় থাকতো ক্যাপ, গলায় সিলভার রঙের শিকল মোটা চেইন এবং হাতে রুবি পাথরের এবং মেটালের দুটি আংটি। পছন্দ করতেন ফেসবুকে প্রচুর নিজের সেলফি তুলে দিতে। অন্ধকার ঘরের আলো-আঁধারি কর্ণার বা চলতি পথে সাধারন মানুষের জীবন যাত্রা বা বৃষ্টির সময়ে চলন্ত রাস্তার ছবি তোলাই ছিল তার একান্ত সময় কাটানোর অনুসঙ্গ। এসব সবকিছুই তিনি উপভোগ করতেন রোদচশমার ভিতর দিয়ে। তার পছন্দের চশমার ফ্রেমও অধিকাংশ থাকতো গোলাকার এবং চিকন কালো ফ্রেমের। সবকিছুতেই কেন কালোর প্রাধান্য ? কারণ, প্রিয় এই গিটারের জাদুকর কালোতে খুঁজে পেতেন জগতের আলো!
এই দেশে অনেক জনপ্রিয় ও নন্দিত ব্যান্ড তারকাই রয়েছেন। কিন্তু গিটার বাজানোর জন্য উপমহাদেশে বিখ্যাত একজনই, তিনি আইয়ুব বাচ্চু। গিটারের সঙ্গে করেছেন প্রেম, গিটারের সঙ্গে বেঁধেছিলেন প্রাণ। নামিদামি সব ব্রাণ্ডের গিটার সংগ্রহ করার নেশা ছিল তার। হরেক রকম গিটার তার সংগ্রহেও ছিল।
গিটারের প্রতি আইয়ুব বাচ্চুর অনুরাগ প্রচণ্ড মাত্রার। যার প্রমাণ পাওয়া যায় গিটার নিয়ে তার নানা সময়ে নানা পরিকল্পনা, বাজানোর শৈলী দেখে। এক সময় গিটার কেনার টাকা ছিল না তার। তবে তার সংগ্রহে রয়েছে আজও ভিন্ন ধরনের গিটার। এর মধ্যে দেশ বিদেশের নামি দামি ৪০টি গিটার আছে। গিটারে তিনি প্রখ্যাত শিল্পী জিমি হেন্ড্রিক্স ও জো স্যাট্রিয়ানির বাজনা দ্বারা অনুপ্রাণিত। এমনটা সম্ভব হয়েছে গিটারের প্রতি ভালোবাসার কারণেই জানিয়েছিলেন একদিন আইয়ুব বাচ্চু নিজেই।
গিটারের প্রতি আইয়ুব বাচ্চুর ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ সব সময়ই। এমনি ভালোবাসার কারণে সুযোগ পেলেই আইয়ুব বাচ্চু সংগ্রহ করেছেন বিশ্বের নামী-দামি সব গিটার। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আইভানেজ, জ্যাকসন, জেম সেভেন সেভেন, কারভিন কাস্টমাইজড, লেসপল ইএসপি ও মিউজিকম্যানের বিভিন্ন মডেলের গিটার।
আইয়ুব বাচ্চু জানিয়েছিলেন, ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় বাবার কাছ থেকে কালো রঙের একটি অ্যাকুস্টিক গিটার পেয়েছিলেন। সেই শুরু। ওই সময় একদিকে বিশ্বের অন্যতম সেরা গিটারবাদক জিমি হ্যান্ড্রিকস, রিচি ব্ল্যাকমোর, কার্লোস স্যানটানার গিটার শুনতেন। অন্যদিকে দেশে পপশিল্পী আজম খানের গিটারবাদক নয়ন মুন্সীর গিটার বাজানো তাকে খুবই মুগ্ধ করে। এক সময় ওদের মতো গিটারে পারদর্শী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। স্বপ্নপূরণের জন্য তখন রউফ চৌধুরী, বন্ধু নওশাদ আর সাজুর সহায়তায় গিটার বাজাতে শুরু করেন।
আইয়ুব বাচ্চু প্রায় ৪০ বছর ধরে কয়েক প্রজন্মের দর্শকদের জন্য গান বেঁধেছেন; জায়গা পেয়েছেন তাদের হৃদয়ে। তারুণ্যভরা তার গানের সুরে মুগ্ধ হয়েছে হাজারো তরুণ হৃদয়। পৃথিবীতে বেঁচে থাকাকালে এ মানুষটি প্রত্যক্ষও করেছে তার প্রতি হাজারো মানুষের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু তার হঠাৎ প্রস্থানের পর একথাও নস্যি হয়ে গেল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা জায়গায় তরুণ, বৃদ্ধ থেকে শুরু করে একেবারে খেটে খাওয়া মানুষ পর্যন্ত সবাই যেভাবে মূল্যায়ন করছে, প্রকাশ করছে ব্যক্তিগত অনুভূতি, তাতে আইয়ুব বাচ্চু নামের এ সঙ্গীতশিল্পী আরো অগণিত সময়ের জন্য টিকে থাকার ইঙ্গিত দিয়ে গেলেন।
তবে দুঃখের কথা, জীবনের শেষদিকে এসে আক্ষেপে-অভিমানে গিটারগুলো বিক্রি করে দিতে চেয়েছিলেন। কারণ হিসেবে নিজেই ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছিলেন, আমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল আমার গিটারগুলো নিয়ে গিটার বাজিয়েদের সঙ্গে নিয়ে দেশব্যাপী একটি গিটার প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করার। যেখানে এই গিটারগুলো বাজিয়ে বিজয়ীরা জিতে নেবে আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় একেকটি গিটার!
কিন্তু বেশ কিছুদিন চেষ্টা করার পরও যখন কোনো পৃষ্ঠপোষকই পেলাম না গিটারগুলো তরুণদের হাতে তুলে দিতে তাদের মেধার মূল্যায়ন স্বরূপ, তারা প্রাণ উজাড় করে গিটার বাজাবে আর আমরা আনন্দের সঙ্গে শুনব, দেখব এবং উৎসাহ দেব; যাতে করে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যেন এটা একটা নতুন দৃষ্টান্ত হয়। কিন্তু হয়ে ওঠেনি আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন! কারণ হয়তো বা আমার স্বপ্নটা একটু বেশিই বড়ই ছিল গিটার নিয়ে! সেই বলে যাওয়া কথা গুলো আজও আমার কানে বাজে কারণ কথা গুলো তিনি বলেছিলেন মারা যাবার কয়েক মাস আগে। আমরা তার জন্য দোয়া করি, উপরওয়ালা যেন তাকে ভালো রাখেন। সবার সুস্থ সুন্দর জীবন কামনায় সঙ্গীতাঙ্গন।