Monday, April 15, 2024

বঙ্গবন্ধুকে দেয়া কথা রাখার জন্যই দেশে ফিরে আসি – ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান…

– কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।

পৃথিবীর আকাশে যেমন অজস্র তারা তাদের নিজস্ব আলোয় আলোকিত করছে পৃথিবীকে তেমনই এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের আকাশেও অনেক তারার আবির্ভাব হয়েছে, যারা সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁদের নিজ নিজ গণ্ডিতে আলোকিত করে যাচ্ছে অনবরত। সেই আকাশের এক তারা সরোদবাদক ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান। দেশ বিদেশে যার সরোদের ঝংকারে মূর্ছিত হয়ে আছে সঙ্গীতাঙ্গন। সঙ্গীত এমন একটি বিষয় যার সাথে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রশিল্পের আবশ্যক হয়। তেমনই একটি মন্ত্রমুগ্ধকর যন্ত্রশিল্প ‘সরোদ’। সরোদযন্ত্রশিল্প তার মহনীয় সুরে গানকে সমৃদ্ধ করে। সরোদবাদক ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান, সরোদযন্ত্রশিল্পের নানান দিক নিয়ে কথা বলেন সঙ্গীতাঙ্গনের সাথে।

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সরোদবাদকদের অবস্থান সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যক্ত করেন এইভাবে যে, এ দেশের শিল্প অঙ্গনে শুধু মাত্র যন্ত্রশিল্পী হয়ে কিছু করা যায় না। সেই সাথে পাশাপাশি কিছু করা উচিত। তা না হলে ভয়ংকর রকমের আর্থিক অভাব অনটন দেখা দেয়। ফলে জীবিকার তাগিদে অনেক সময় এই সঙ্গীতাঙ্গন অনেকেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। আমাদের পরিবারে আমরা যারা গানবাজনা করি, আমরা সবাই এর পাশাপাশি কিছুনা কিছু করছি। আমরা কেউই এর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল না। আমি এক সময় চাকুরী করতাম। সেখানে আমার পজিশন ছিল জেনারেল ম্যানেজার। যে কারণে সঙ্গীতাঙ্গনে আমি আমার পজিশন সব সময় বজায় রেখেছি এইভাবে যে, এত টাকা দিলে যাব নইলে যাবনা। তবে কেউ যদি শুধুমাত্র বাজনা শুনতে চায় সেই সময় বিনা পয়সাতেই বাজনা শুনিয়ে দিয়ে আসব। আমার দুই মেয়েও গানবাজনা করছে একজন আফসানা খান সেতারবাদক আরেকজন রুখসানা খান সরোদবাদক। ওরা দুজনেই এডভোকেট। আমাদের দেশে আমাদের মত গুটি কয়েক শিল্পী মনে হয় খুব একটা খারাপ নেই! যারা গান বাজনার পাশাপাশি কিছু না কিছু করছি। আমরা এখন যারা একটা পজিশনে চলে এসেছি তারা কেউ না কেউ দেশ বিদেশেও যাচ্ছি। আমার কথা বলি, আমি মাঝখানে অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়াতে ছিলাম বেশ কিছুদিন। এর মাঝে দেশে এসে আবার চলে যাই ইন্ডিয়াতে।
এভাবেই চলছে।

বাংলাদেশে সরোদশিল্পী এখন কতজন আছেন সেই প্রসঙ্গে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান বলেন, দু.চারজন তো বাজাচ্ছে। তাছাড়া আমার কিছু স্টুডেন্ট আছে। প্রথমত এই যন্ত্রশিল্প অনেক এক্সপেন্সিভ! একটি ভালো যন্ত্র কিনতে গেলে প্রায় লাখ টাকার কাছাকাছি লাগে। তবে পনের হাজার টাকা বা বিশ হাজার টাকা দিয়েও কিনতে পারেন। এখন আপনি কোনটা কিনবেন তা আপনার ওপর নির্ভর করে। তবে সত্যি কথা হল, যে জায়গায় আপনি মাত্র তিন হাজার টাকা দিয়ে একটি গিটার কিনতে পারেন অথবা চার হাজার টাকা দিয়ে একটি ভায়োলিন কিনতে পারেন, আপনি কেন খামোখা লাখ টাকা খরচ করে এই সরোদযন্ত্র কিনতে যাবেন ? যদিও খুব কষ্ট করে যন্ত্রটি কিনলেন এবং শিখলেন কিন্তু শেখার পর কোনো কাজ পাবেন কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। এই অনিশ্চয়তার কারণেও ইচ্ছে থাকা সত্বেও অনেকেই এই যন্ত্রশিল্পে আসতে চাইছেনা। দ্বিতীয়ত শুদ্ধভাবে সরোদ শেখানোর মত তেমন কোনো লোকও নেই। দু’চার জন যারা আছেন তাঁরা কমার্শিয়াল। তাঁরা সব সময় কমার্শিয়াল কাজ নিয়েই ব্যস্ত থাকেন। গানের সাথে যারা বাজায় তাঁরা তো সময়ই পায়না। তাই এই যন্ত্রশিল্পে না আসার আরেকটি কারণ ভালো শিক্ষকের অভাব। তৃতীয়ত আরেকটি কথা, বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের যে অবস্থা! চলাই মুস্কিল। একটা লোক এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যে শিখতে আসবে তা সম্ভব নয়। ধরেন সে থাকে ধানমণ্ডিতে আর আমি থাকি রামপুরায়। আমার কাছে শিখতে আসার জন্য তাঁর তিন চার ঘন্টা রাস্তাতেই চলে যাবে। কে এতটা সময় নষ্ট করবে ? আর আমারও তো বাড়ি বাড়ি গিয়ে শেখানো সম্ভব না। তারপরেও আমার কাছে ১০/১২ জন এসে শিখছে নিজেদের ইচ্ছা বা আগ্রহ আছে বলে, এত কস্ট করে শিখছে। এই কারণে আমি বলবো বাংলাদেশের সরোদ যন্ত্রশিল্পী দিন দিন কমে যাচ্ছে এবং সংকটের মধ্যে আছে এই যন্ত্রশিল্প।

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান সরোদবাদক হিসেবে দেশের বাইরেই বেশীরভাগ সময় অতিবাহিত করেন এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর এই যন্ত্রশিল্পের ঝংকারে শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখেন। বছরের বেশীরভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশের বাইরে অনুষ্ঠানগুলি কিভাবে যে হয়ে যায় তা আমি নিজেও জানিনা। যাই হোক প্রত্যেক বছরেই তিন চারবার করে আমার দেশের বাইরে থাকতে হয়। এই জুনেই আবার চলে যাব ইউরোপে। ইউরোপ থেকে দেশে এসে আবার নভেম্বরে চলে যাব আমেরিকাতে। কোনো না কোনোভাবে ট্যুরগুলো হয়ে যাচ্ছে।
যে কোনো কিছু শিখতে গেলে তার জন্য প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয়। এই সরোদ যন্ত্রশিল্পের কোনো প্রতিষ্ঠান আছে কিনা দেশে অথবা দেশের বাইরে সেই ব্যাপারে তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমাদেরই একটি প্রতিষ্ঠান আছে। সেটার নাম ‘ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সঙ্গীত নিকেতন’। আমরা আমাদের নিজেদের মত করে এই প্রতিষ্ঠানটি চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো রকম সাহায্য সহযোগিতা ছাড়া। প্রথম প্রথম সরকারের কাছ থেকে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশ হাজার টাকা করে অনুদান পেতাম কিন্তু পরবর্তীতে সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপরেও আমরা নিরলসভাবে এই সঙ্গীতের পেছনে কাজ করে যাচ্ছি। তবে দেখা যায় কোনো কোনো ফালতু প্রতিষ্ঠান সরকার থেকে সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে। হয়তোবা তোষামোদ করে কিন্তু আমাদের পরিবার থেকে কেউ কাউকে তোষামোদ করবে! প্রশ্নই আসেনা। যেদিন থেকে টাকা দেয়া বন্ধ করে দিল সেদিন থেকে একদিনও জানতে চাইনি, কেন বন্ধ করেছে ? আমি যাইনি,
কেন যাব ? কি প্রয়োজন আছে আমার ? আমার যাওয়ার দরকার নেই। এই দেশে যদি এই যন্ত্র বেঁচে না থাকে তো না থাকবে। আমার কি আসে যায়! দুঃখ লাগে কষ্ট লাগে এই ভেবে যে দুদিন পর পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে এই শিল্পী ধার করে আনবে, আমি আপনাকে বলে দিলাম।
দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আছে এই যন্ত্রশিল্পের। যেমন আমেরিকা, সুইজারল্যান্ডের জেনেভা-তে, অস্ট্রেলিয়া এই সমস্ত দেশে কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। অস্ট্রেলিয়াতে আমার এক চাচা আছেন তিনি শেখান। তার বেশ কয়েকজন স্টুডেন্ট আছে। তাছাড়া ওখানে আমার চাচাতোভাই আছেন তবে সে শেখায় না, নিজে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান-বাজনা করে।

যে কোনো কিছু শিক্ষালাভ করার পেছনে পরিবার বা পরিবারের বাইরে কারো না কারো অবদান থাকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান তাঁর সরোদশিল্পী হওয়ার পেছনের গল্পটি এমনভাবে উপস্থাপন করেন তা হল,আমার সাত বছর বয়সে আমার দাদা এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেব আমার হাতে ছোট্ট একটি সরোদযন্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। কারণ আমাদের পরিবারে একটি সিস্টেম ছিল যে, আমার দাদা আমাদের চাচাতো ভাইদের মধ্যে কারো সাত বছর বয়স হলেই যে কোনো ইন্সট্রুমেন্ট ধরিয়ে দিত, সেটা সেতার, সরোদ অথবা বায়া তবলা যে কোনো কিছু হতে পারে। এমনকি কোলকাতায় আমার দুজন চাচাতো ভাই আছে তাদের একজনকে সেতার আরেকজনকে সরোদ ধরিয়ে দিয়েছেন আমার দাদা। আমাকে সরোদ ধরিয়ে দিলেন। যার ফলে এই সরোদযন্ত্র দিয়ে আলটিমেটলি আমার সঙ্গীতযন্ত্রের হাতেখড়ি শুরু হয়ে গেল। আমরা প্রত্যেকেই গান জানি। কারণ গানটা ছিল আমাদের কম্পলসারি সাব্জেক্ট। প্রথমে গানই শেখানো হয়েছে আমাদের। পরে তার পাশাপাশি যন্ত্রশিল্পের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। ফলে ফাইনালই আমরা ঠিক করলাম আমরা যন্ত্রশিল্পীই হব। সেই থেকেই শুরু যন্ত্রের সাথে আমাদের সখ্যতা।

ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে ১৯৯৪ সালে একুশে পদকে ভূষিত হয়েছেন। সেই সময়ের অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, আমি সবচাইতে কম বয়সে ঐ সময় একুশে পদকে ভূষিত হই। বর্তমানে আমার বয়স ষাট। এত অল্প বয়সে একুশে পদকটি পাওয়ায় আমাকে আমার কাজের প্রতি অনেক বেশী উৎসাহিত করেছিল। আমার আরও ভাল কাজ করতে হবে, সম্মানটাকে ধরে রাখতে হবে এই রকম একটি অনুভূতি আমার মনের মধ্যে কাজ করতেছিল। তাই আমার মনে হয় যাদেরকে এই পদকগুলি দেয়া হয়, তাদেরকে অল্প বয়সে দেয়া উচিত এবং জীবিত অবস্থায় দেয়া উচিত। কারণ তখন একটা লোক পদকটি পেয়ে তাঁর কাজের প্রতি আরও বেশী উৎসাহিত হবে। তাঁর মধ্যে তখন এই অনুভূতিটা জাগ্রত হবে, না আমাকে আরও ভাল কাজ করতে হবে। অনেক সময় দেখা যায় মরণোত্তর পদক বা পুরস্কার দেয়া হয়। আমার মনে হয়, কোনো একজন মানুষ মারা যাবার পর তাঁকে পদক দেয়া বেকার! আমি সারাজীবন কাজ করে গেলাম কিন্তু কিছুই পেলাম না! আমি মারা যাবার পর মরণোত্তর পদক দেয়া হল আর আমার পরিবার তা নিয়ে চলে আসলো তাতে কি লাভ হল ? আমি তো কিছুই জানলাম না। তাই বলি বেঁচে থাকতে এবং অল্প বয়সে পদক দেয়া উচিত। আপনি চিন্তা করতে পারবেন না, আমার অল্প বয়সে পাওয়া পদকটি আমার কাজের ক্ষেত্রে আমাকে কতটা পুশব্যাক করেছে। প্রতিটি ভাল কাজের জন্য পুরস্কার দেয়া উচিত। তাতে করে কাজের গতি বাড়ে।

বাংলাদেশে তেমন কোনো সরোদবাদক তৈরি হয়েছে কিনা সেই প্রসঙ্গে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন বলেন, সেই রকম তৈরি হওয়ার স্কপ কোথায়! এখন দেখেন সরকার খেলার পেছনে প্রচুর টাকাপয়সা খরচ করছে অথচ আমাদের সঙ্গীতের পেছনে সরকার দুটি পয়সাও খরচ করছেনা! সোজা কথা বলতে কি, গান বলেন নাচ বলেন এমনকি যন্ত্রসঙ্গীত বলেন, যারাই আসছে তাঁরা নিজেদের চেষ্টাতেই আসছে। যারা নাম করছে তাঁরা নিজেদের চেষ্টাতেই নাম করছে। অথচ দেখেন, একজন গভঃডেলিগেশন দেশে আসলে তখন কিন্তু শিল্পীদের খোঁজ করে। শিল্পী ছাড়া তখন কিছু হয়না। নাচগান যাই হোক ওদেরকে তখন খোঁজ করে বের করে। এখন কথা হচ্ছে যে, যে ছেলেটা ভাল বাজায় এবং ইন্টারমিডিয়েট পাশ কিন্তু তাঁর রেডিও টেলিভিশনে চাকরী হবেনা কারণ তাঁর রেডিও টেলিভিশনে বিমিউজ এমমিউজের সার্টিফিকেট দেখাতে হয়। তার সেই সার্টিফিকেট নাই। যাদের বিমিউজ এমমিউজের সার্টিফিকেট আছে কিন্তু ভালো বাজাতে পারেনা তবে ঐ সার্টিফিকেটের জন্য চাকরী হয়ে যায়। তারা কখনই শিল্পী হতে পারেনা, বিমিউজ আর এমমিউজ হয়েই তাদের থাকতে হবে। রেডিও টেলিভিশনে যদি এতই ভালো শিল্পী আছে তাহলে কেন বাইরে থেকে ডাবল পয়সা দিয়ে শিল্পী এনে রেকর্ডিং করায়! যদি যোগ্যতা অনুযায়ী শিল্পীদের চাকরী দিত তাহলেতো ডাবল পয়সা দিয়ে শিল্পী বাইরে থেকে আনতে হতোনা। এদেশে যোগ্যতার মূল্যায়ন হয়না বরং কাগজে কলমের সার্টিফিকেটের মূল্যায়ন হয়। গানবাজনা করার জন্য যোগ্যতা লাগে, শুধু সার্টিফিকেটে কিছু হয়না। অথচ দেখেন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যোগ্যতা অনুযায়ী সবাই সবার কাজ করছে। সেজন্য ছেলেমেয়েরা প্রচুর কাজ করছে। আমাদের দেশে সেইরকম যোগ্য লোকের কোনো কাজ নেই। তাই যখন ওসব দেখি দুঃখ লাগে।
প্রতিটি মানুষেরই তাঁর নিজ নিজ কাজ নিয়ে কিছু পরিকল্পনা থাকে মনে। সেইরকম পরিকল্পনা আছে সরোদবাদক ওস্তাদ শাহাদাত হোসেনের মনেও। সেই পরিকল্পনার কথা তিনি এভাবেই জানালেন, আমার পরিকল্পনা হচ্ছে আমি যদি সরকারের কাছ থেকে একটা ব্যাকআপ পেতাম তাহলে আমার ছাত্রছাত্রীদের জন্য স্কলারশিপের ব্যবস্হা করতাম। কারণ অনেকেই আর্থিক অনটনের জন্য শত ইচ্ছা থাকা সত্বেও শেষ করতে পারেনা। স্কলারশিপের জন্য হাজার হাজার টাকা দরকার হয়না। আজকে বেঙ্গল ফাউন্ডেশন যা করছে তা হল ছেলেমেয়েদের স্কলারশিপ দিয়ে শেখাচ্ছে। কারণ তাঁদের প্রচুর টাকা আছে। তেমনি এক একটি ছেলেকে যদি অন্তত দুই হাজার টাকা করে দিতে পারতাম তাহলে তার যাতায়াত খরচটা হয়ে যেত ফলে ছেলেটি বাধ্য হয়েই শিখতে আসতো। সরকার যদি যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের চাকরীর ব্যবস্হা করতো বিমিউজ এমমিউজের সার্টিফিকেট না খুঁজে তাহলে খুব ভাল হত।
তবে আমি আমার সাধ্য মত চেষ্টা করে যাচ্ছি কয়েকজন ভালো সরোদযন্ত্রশিল্পী তৈরি করে যেতে। আমার বাসায় পনের ষোল জন ছেলে শেখে। তারমধ্যে পাঁচজন ছেলের আর্থিক অবস্থা তেমন একটা ভালোনা। তাই ওদের কাছ থেকে আমি কোনো টাকাপয়সা নেই না। কারণ আমার অদম্য ইচ্ছা আমি বাংলাদেশে অন্তত পাঁচজন সরোদযন্ত্রশিল্পী তৈরি করে যেতে চাই যারা পরবর্তীতে এই সরোদ যন্ত্রশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখবে। তাই তো আমি যতই অসুস্থ হইনা কেন, ওরা আমার বাসায় আসলে আমি সব ভুলে গিয়ে ওদের শেখাতে বসি।
ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান তাঁর কিছু ব্যক্তিগত অভিমানের কথা শেয়ার করেন এভাবে যা কখনোই তিনি কারো সাথে শেয়ার করেননি। তিনি বলেন, শোনেন! আমি কিন্তু ‘৮৫ সালে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম আমেরিকাতে কিছুটা অভিমান করেই। সেখানে মোটামুটি সেটলড্ হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু আমার বাবা চাননি আমি ওখানে স্থায়ীভাবে বসবাস করি। এক ছেলে হিসেবে যা হয় আরকি! বাবা আমাকে লাস্টে টেলিফোনে কল করে বললেন, ‘তোর কি মনে আছে একটা লোককে কথা দিয়েছিলি যে, তুই দেশ ছেড়ে কখনই যাবিনা ? আমি বললাম, হ্যাঁ, মনে আছে। বাবা বললেন, যদি তা মনে থাকে তবে দেশে ফিরে আয়’। তারপর আমি দেশে ফিরে আসি তা না হলে আর দেশে ফিরে আসতাম না! কার কথায় এবং কেন ফিরে আসি সেই সত্যি কথাটাই আজ আমি আপনাকে বলছি। আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। ১৯৭৪ সালে আমি বঙ্গভবনে যাই একটি অনুষ্ঠানে। তখন বঙ্গবন্ধু বেঁচে ছিলেন। সেখানে আমার বাবাকে আর আমাকে স্পেশালভাবে ডাকা হয়েছিল সরোদ বাজানোর জন্য। সেদিন যখন আমি বাবার সাথে বাজাই, আমার বাজনা শুনে বঙ্গবন্ধু আমাকে এ্যাওয়ার্ড দিয়েছিলেন। এ্যাওয়ার্ডটি হল উনি নিজের একাউন্ট থেকে আমাকে পাঁচ হাজার টাকার একটি চেক দিয়েছিলেন। সেই ছবিটি আমার কাছে আজো আছে। তখন বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে আমার ডায়রিতে কিছু কথা লিখে দিয়েছিলেন, সেই ছবিটাও আছে এবং তাঁর সাথে আমার দুই তিনটা ছবিও আছে আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে। উনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। ঐ দিন রাত্রে আমি জানলাম এবং আশ্চর্য হলাম জেনে যে, অল ইন্ডিয়া রেডিও কনফারেন্স কখন হয় তা তিনি জানতেন। ঐ সব অনুষ্ঠানে উনি গিয়েছিলেনও।
তখন তাহের উদ্দিন ঠাকুর ছিলেন বাংলাদেশের ইনফরমেশন মিনিস্টার। বঙ্গবন্ধু তখন তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে ডেকে বললেন, তাহের দেখ তো অক্টোবর নভেম্বর মাসে অল ইন্ডিয়া রেডিও কনফারেন্স হয়। তুমি এখনই ইন্ডিয়ান ইনফরমেশন মিনিস্টারকে ফোন লাগাও এবং ফোন লাগিয়ে জানাও ওদের অল ইন্ডিয়া কনফারেন্স কবে ? এবার আমার এখান থেকে দুজন শিল্পী যাবে। সেই দুজন শিল্পী হলাম,আমি আর আমার বাবা। আমি তো শুনে অবাক হয়ে গেলাম! ঐ রাত্রেই কিন্তু আমাদের অল ইন্ডিয়া রেডিও কনফারেন্সে যাওয়ার জন্য ঠিক হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুই প্রথম আমাকে দেশের বাইরে মানে বিদেশে পাঠান। তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওটি এভাবে সেট করা ছিল-কোলকাতা, মাদ্রাজ, দিল্লি, বোম্বে, হায়দারাবাদ, কাশ্মির এইভাবে একটা চেইনের মত যেমন, একটা শেষ হলে আরেকটা এইভাবে। সেই রাত্রেই বঙ্গবন্ধু আমার হাত ধরে বলেছিলেন, “তুই আমারে কথা দে, তুই কখনোই দেশ ছেড়ে যাবিনা!”
আমিও কথা দিয়েছিলাম তাঁকে যে, “কথা দিলাম, আমি কখনোই দেশ ছেড়ে যাবনা”। বিশ্বাস করেন, উপরে আল্লাহ্‌ আর নিচে মাটি! আমি যদি মিথ্যে কথা বলি তাহলে আল্লাহ্‌ আমাকে শাস্তি দিবেন। একমাত্র বঙ্গবন্ধুকে দেয়া কথা রাখার জন্যই আমি আবার দেশে ফিরে আসি। এখন মাঝে মাঝে কষ্ট হয় এইভেবে যে, একজন লোকের প্রতি এতটা শ্রদ্ধা নিয়ে আসলাম কিন্তু কিছুই তো পেলামনা এ জীবনে! হ্যাঁ, পেয়েছি একটা একুশে পদক পেয়েছি। তাছাড়া যন্ত্রসঙ্গীতের জন্য কোনোরকম সাহায্য সহযোগিতা আজও পেলামনা সরকারের কাছ থেকে। আগে তো সরকারীভাবে বিদেশে ট্যুরে কারা কারা যাচ্ছে তাঁদের নাম জানা যেত, এখন তো সেটাও জানা যায়না! তাই এখনো নিজের উদ্যোগে কাজ করে যাচ্ছি, নিজের প্রতিষ্ঠান চালিয়ে যাচ্ছি। নিজের চেষ্টায় ও যোগাযোগের কারণে দেশের বাইরে গিয়েও কাজ করছি এই সরোদযন্ত্র নিয়ে। বলতে পারেন, অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছি, এই সরোদ যন্ত্রশিল্পটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনার নিজের কিছু করার ইচ্ছে পরবর্তী সরোদযন্ত্রশিল্পীদের জন্য বা সরোদবাদকদের জন্য এবং আপনি পরবর্তী প্রজন্ম তৈরি করে দিতে চাচ্ছেন। অবশ্যই এটা আপনার একটি ভালো উদ্যোগ। হয়তো আপনার এই কাজের মাধ্যমেই সরোদযন্ত্র শিল্প বেঁচে থাকবে বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরে। দোয়া করি, সরোদযন্ত্র শিল্প সমস্ত বাঁধা বিপত্তি কাঁটিয়ে উঠবে। আপনিও আপনার পরিকল্পনা সফল করে দেশ বিদেশে আপনার ভক্ত শ্রোতাদেরকে আরও মুখরিত করে রাখবেন আপনার বাজানো সরোদের সুরের ঝংকারে। এই কামনা করছি সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে। শুভকামনা রইল।
ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান – আপনার জন্য এবং সঙ্গীতাঙ্গন এর জন্যও রইল আমার অনেক অনেক শুভকামনা।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles