– রহমান ফাহমিদা।
সঙ্গীত শিল্পী শাওন চৌধুরী অনেক বছর ধরেই সঙ্গীত জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন এপার বাংলা আর ওপার বাংলায়, তা অনেকেরই অজানা। তিনি প্রচার বিমুখ হওয়ার কারনে অনেক দর্শক শ্রোতা তাঁর সঙ্গীতের মুগ্ধতা অনুভব করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই শিল্পীর সাথে দর্শক শ্রোতাদের পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য সঙ্গীত বিষয়ক ম্যাগাজিন পত্রিকা সঙ্গীতাঙ্গন একটি পদক্ষেপ নেন। সেই সূত্র ধরে লেখক রহমান ফাহমিদা শিল্পী শাওন চৌধুরীর সাথে সাক্ষাতকালে তাঁর অনেক জানা অজানা তথ্য তুলে ধরেছেন এই আলাপচারিতায়।
সঙ্গীতাঙ্গন – ভাইয়া, আমার জানামতে আপনি সঙ্গীত ছাড়াও বিভিন্ন ক্ষেত্রে আপনার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তবে আজকে আমি আপনার সাথে সঙ্গীত বিষয়ে কথা বলবো। প্রথমেই জানতে চাই, আপনি যে গানের জগতে এসেছেন বা গানের প্রতি আপনার যে দুর্বলতা তা কি পারিবারিকভাবে কারো কাছ থেকে পেয়েছেন বা পারিবারিকভাবে আপনার এমন কেউ কি আছেন এই সঙ্গীত জগতে ?
শাওন চৌধুরী – না, সঙ্গীত জগতে পারিবারিকভাবে তেমন বড় কেউ নেই বা ছিলনা। তবে সঙ্গীতের প্রতি ভালোলাগাটা শুরু হয়েছে একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে। মুক্তি যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল আট বছর। ঐ যুদ্ধের সময় পাকিস্তানী আর্মিরা প্রথমেই আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় আমাদের বাড়িসহ পুরো এলাকাই আগুনে পুরে ছাই হয়ে যায়। আমরা তখন ভারতে চলে গেলাম এবং শরণার্থী হয়ে ভারতের শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিলাম। ঐ ক্যাম্পে থাকাকালীন সময় আমরা সবাই ভাবতাম কবে দেশ স্বাধীন হবে, কবে দেশে ফিরব ইত্যাদি। তাই দেশের খবর জানার জন্য রোজ রেডিও শুনতাম তখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গানগুলো শুনতাম। রেডিও খুললেই সেই গানগুলো শুনা যেত। যেমন – কারা ঐ লৌহ কপাট, ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়, একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি ইত্যাদি নানান ধরনের গান। তখন থেকে ঐ গানগুলি আমার মনের ভেতর নাড়া দিয়েছিল। সেখান থেকেই আমি গানের প্রতি বেশী অনুপ্রাণিত হই।
আপা, মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে আমি একটি অবিশ্বাস্য ঘটনা বলি। আমরা যখন ভারতে অবস্থান করছি সেই সময় আমার বয়স আট বছর কিন্তু আমার স্বাস্থ্য বেশ ভালো হওয়ার কারণে আমাকে বার বছরের মত লাগে। একদিন সকালবেলা আমাদের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে দেখি এক জায়গায় ভারতের মুক্তি যোদ্ধাদের রিক্রুমেন্ট হচ্ছিল, আমিও মুক্তি যোদ্ধা হওয়ার জন্য সবার সাথে সেখানে লাইনে দাড়িয়ে গেলাম। প্রথমে যেখানে খাতায় এন্ট্রি করে সেখানে এক শিখ ভদ্রলোক (সেনাবাহিনীর), বেত হাতের মধ্যে, কলারের মধ্যে লাল ফিতা দেওয়া তখন বুঝিনি এখন বুঝতে পারছি উনি একজন কর্নেল ছিলেন। উনি তখন বেত দিয়ে দেখিয়ে এক একজনকে ওকে করছেন। আমার কাছে এসে বলছে, তুম বহতই ছোটা হো, ঘরমে যাও। আমাকে আর নিল না। মনে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম এবং সেদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কিছু খাইনি। আর মা যখন জানতে চেয়েছেন সকাল থেকে কোথায় ছিলাম তখন বলেছি আশেপাশের জায়গা, নদী নালা ঘুরে দেখেছি। কারণ মাকে না বলে মুক্তিযুদ্ধে যেতে চেয়েছিলাম সেই কথা বলে মাকে কষ্ট দিতে চাইনি। ঐ সময় থেকে যুদ্ধের গানগুলো আমার ভালো লাগতে শুরু করে। তাই যুদ্ধের পর ভাবলাম গান শিখি এবং তখন থেকেই গান শেখা শুরু করলাম। আস্তে আস্তে গান শিখতে শিখতে সিঁড়ি বেয়ে এই পর্যন্ত আসা।
সঙ্গীতাঙ্গন – এত ছোট বেলায় আপনার মধ্যে দেশের জন্য যুদ্ধে যাবার যে প্রবণতা দেখতে পেলাম তা সত্যি অসাধারণ! ভাইয়া, আবার সঙ্গীত প্রসঙ্গে আসি। আপনার সঙ্গীতের হাতেখড়ি কখন থেকে এবং আপনি কার কাছ থেকে এই হাতে খড়ি নিয়েছেন?
শাওন চৌধুরী – দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমরা আমাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ চলে আসি। ১৯৭৩ সালে যখন আমরা কিশোরগঞ্জে ছিলাম তখন ওখানে আমাদের প্রতিবেশী একজন ছিলেন। তাঁর নাম ছিল আদিত্য মোহন দাস। তিনি ভালো আধুনিক গান করতেন। মূলত তাঁকেই অনুরোধ করেছিলাম আমাকে গান শেখানোর জন্য। উনি আমাকে হারমোনিয়াম দিয়ে তালিম দিতে শুরু করলেন। কাজেই উনি অত বিখ্যাত ব্যক্তি না হলেও গান শিক্ষার দিক থেকে উনি আমার প্রথম গুরুজি। ওনার কাছে শিখেছি বেশ কয়েক বছর। এর পরে আমি ময়মনসিংহের একজন ওস্তাদ ছিলেন, উনি এখন বেঁচে নেই। উনি ভারত থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিখে এসেছিলেন। তাঁর নাম ছিল ওস্তাদ বাদল চন্দ। ভারতের কিশোর কুমার তাঁর সতীর্থ ছিলেন। ওনারা একই গুরুর শিষ্য ছিলেন। ময়মনসিংহে একটি মিউজিক স্কুল ছিল। সেই স্কুলের নাম ছিল ময়মনসিংহ সঙ্গীত বিদ্যালয়। সেখানে আমি ভর্তি হয়েছিলাম।
সেখানে ওস্তাদ বাদল চন্দের কাছে আমি দু’প্রকার সঙ্গীতের তালিম নেই। এক হল, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আরেকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত। এরপরে আমি ১৯৮৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হই। তখন পড়াশুনার ব্যস্ততার কারণে ঐভাবে আর গুরুর কাছে গান শেখা হয়নি! তবে নিজে নিজে সাধনা করেছি এবং পাশাপাশি বিভিন্ন প্রোগ্রামে পারফর্ম করেছি। তখন ইউনিভার্সিটির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ও সেন্ট্রালের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পারফর্ম করতাম। তারপর ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করার পর কিছুদিন ধানমণ্ডির বুলবুল ললিত কলা একাডেমীতে(বাফা) রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওপর গান শিখেছিলাম। ওখানে বছরখানেক গান শেখার পর চলে আসি। এরপরে আমি রেডিও টেলিভিশনে এনলিষ্টেড হওয়ার পর আমি পারফর্মেন্সের দিকে ঝুঁকে পড়ি। কিছুদিন পারফর্মেন্স করার পর আমার প্রথম একটি নিজস্ব এ্যালবাম বের হয়।
সঙ্গীতাঙ্গন – কত সালে এ্যালবামটি বের হয় ভাইয়া ? সেটা কি ধরনের এ্যালবাম ছিল ?
শাওন চৌধুরী – ২০০২ সালে এ্যালবামটি বের হয় এবং তা ছিল আধুনিক গানের মৌলিক এ্যালবাম। এ্যালবামটি মোটামুটি ভালো প্রচারণা পেয়েছিল। কেননা, এই এ্যালবামটির মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানটি প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেইসময় টেলিভিশন, রেডিও এবং প্রিন্টমিডিয়ার সাংবাদিকগণ চৌদ্দটি জাতীয় পত্রিকায় তাঁরা আমার এই এ্যালবামটির ভালো নিউজ কভারেজ দিয়েছিল। আর আমি তখন তা থেকে ইন্সপায়ার হয়ে আমার দ্বিতীয় এ্যালবামের দিকে মনোযোগী হলাম। দ্বিতীয় এ্যালবামটিও আমার মৌলিক আধুনিক গানের ছিল। এরপর আমি ফিল্মের গানে প্লেব্যাক করার রিকোয়েস্ট পেলাম এবং কিছু ফিল্মে প্লেব্যাকও করলাম।
সঙ্গীতাঙ্গন – আধুনিক এবং রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়া অন্য কোনো গানের ক্ষেত্রে কি আপনার কোনও দুর্বলতা ছিল ?
শাওন চৌধুরী – গজলের প্রতি আমার খুব দুর্বলতা ছিল। আমি সবসময় মেহেদি হাসান সাহেবের গজল, জগজিৎ সিংজির গজল, গোলাম আলী সাহেবের গজল এবং লতাজির গান শুনতাম খুব। আমার তখন মনে হল, আমি গজল শিখব। ছোট বেলায় ক্লাসিকাল শিখেছিলাম এখন গজল শিখব। তারপর আমি খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম কার কাছে শিখব এবং কে সুদ্ধভাবে গজল শিখাতে পারবেন! বিভিন্ন সোর্স থেকে জানতে পারলাম ওস্তাদ নিয়াজ মোহাম্মদ চৌধুরী নিজে গজল শিখেছেন সুদ্ধভাবে সো উনিই আমাকে গজল শেখাতে পারবেন। তাই টেলিফোনে তাঁর সাথে যোগাযোগ করে তাঁর আজিমপুরের বাসায় গেলাম। ওখানে গিয়ে তাঁকে বললাম, ওস্তাদজি ,আমি আপনার কাছ থেকে গজল শিখতে চাই। উনি তখন বললেন, শিখতে চাও ভালো কথা! কিন্তু তুমি কি কখনো গজল গেয়েছো ? আমি বললাম গেয়েছি বিভিন্ন স্টেজ প্রোগ্রামে। গজল কখনো শিখিনি তবে ছোটবেলায় ক্লাসিকাল শিখেছিলাম। তখন সে আমাকে বললেন, তোমার ভালো লাগে এমন যে কোনো একটা গজল গেয়ে শোনাও। আমি তখন মেহেদি হাসান সাহেবের একটি গজল গেয়ে শোনালাম। উনি তখন শুনে বললেন, মোটামুটি ঠিক আছে তবে কিছু শব্দ ভুল আছে, উর্দু শব্দ তোমার জানা নেই হয়তো! তারপর তোমার কিছু জায়গায় নোটের ভুল আছে। অভার অল তোমার এটা ঠিক আছে। তুমি শিখতে পারবে। এরপর থেকে আমি ওনার কাছ থেকে গজলের তালিম নেয়া শুরু করি। ওনার কাছে আমি প্রায় আট বছর গজলের তালিম নিয়েছি। এর ফাঁকে ফাঁকে আমাকে তিনি ক্লাসিকাল মিউজিকও শিখিয়েছেন। কিছু রাগও তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। এছাড়া তিনি আমাকে শিখিয়েছেন, আধুনিক গানে পারফর্মেন্স করার সময় কিভাবে সূক্ষ্ম কাজগুলি করতে হয়, কিভাবে একটু মুন্সিয়ানা আনতে হয় এবং কিভাবে গানকে হৃদয়গ্রাহী করা যায়। ওনার কাছ থেকে তালিম নেয়ার পর আমি দেখলাম পারফর্মেন্স করার ক্ষেত্রে এবং পরবর্তী বিভিন্ন এ্যালবাম বের করার ক্ষেত্রে আমার আগের কণ্ঠের সাথে এখনকার কণ্ঠের অনেক পার্থক্য! আগের এ্যালবামের গায়কী এবং পরবর্তী এ্যালবামের গায়কীতে অনেক ব্যবধান! আমার কাছে সেটা খুব ভালো লাগলো। এভাবে গান করতে করতে আমার ১৩টি এ্যালবাম রিলিজ হয়েছে। ১০টি বাংলাদেশ থেকে এবং ৩টি ভারতের কোলকাতা থেকে রিলিজ হয়েছে।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনার এ্যালবামগুলো কি ক্যাসেট আকারে বের হয়েছে না সিডিতে বের হয়েছে ?
শাওন চৌধুরী – আমার এ্যালবামগুলো সিডি, ডিভিডিতে বের হয়েছে তবে ক্যাসেট আকারে করা হয়নি।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনি তো বিভিন্ন ধরণের গান করেছেন, কখনো কি নজরুল সঙ্গীতের ওপর কোন গান করেছেন ?
শাওন চৌধুরী – মাঝে মাঝে রিকোয়েস্ট পেলে আমি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ভিন্ন ঘরণার গান গাই তবে সত্যি কথা বলতে কি আমি কখনো তেমনভাবে নজরুল সঙ্গীত শিখিনি। আমার ওস্তাদজি আমাকে দুটো নজরুল সঙ্গীত শিখিয়ে ছিল। এই নজরুল সঙ্গীত নিয়ে একটি ঘটনা আছে। আমি যেহেতু ক্লাসিকাল শিখেছি তাই আমাকে হঠাৎ করে মাছরাঙা টিভি থেকে কল করে বল্লেন, একটা নজরুল সঙ্গীত আপনাকে দিয়ে গাওয়াতে চাচ্ছি একটি টেলিফিল্মের জন্য। আমি তখন বল্লাম, ভাই আমি নজরুল সঙ্গীতের শিল্পীও নই এমনকি আমি সেভাবে নজরুল সঙ্গীত শিখিনি। তখন তাঁরা বল্লেন, আসলে টেলিফিল্মের জন্য যে গানটি যাবে তা ট্রিপিক্যাল স্টাইলে গাইলে ফিল্মের জন্য উপযোগী হবে না! অনেক মর্ডাণ ফর্মেটে গাইতে হবে মুল ঠাট ঠিক রেখে এবং ফিল্মি গলায় গাইতে হবে। এইজন্য আপনাকে আমরা ঠিক করেছি। আমি বল্লাম, যেহেতু আমি গাইনি কখনো এবং আপনারা রিকোয়েস্ট করছেন তবে আমি একটা শর্তে রাজী হচ্ছি তাহলো গান রেকর্ডিং এর পর আমি যদি মনে করি গানটি ঠিক আছে তাহলে ফিল্মে যাবে আদারওয়াইজ আমি বাদ দিয়ে দিব। পরে তাঁরা বল্ল, ঠিক আছে। আমার শর্তে তাঁরা রাজী হওয়ার পর আমি কয়েকদিন নিজের থেকে গানটি তুল্লাম তারপর রেকর্ডিং করলাম। রেকর্ডিং হওয়ার পর আমি যখন ওকে করলাম, তারপর ফিল্মে গানটি গেল। কাজী নজরুল ইসলামের জন্ম বার্ষিকীতে মাছরাঙা টেলিভিশনে ‘রাক্ষসী’ নামে নির্মিত টেলিফিল্মে গানটি গিয়েছে। সবাই গানটির খুব প্রশংসা করেছেন।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনি তো এপার বাংলা আর ওপার বাংলার বিভিন্ন জনপ্রিয় শিল্পীদের সাথে গান করেছেন, কার কার সাথে গান করেছেন এবং রিসেন্টলি কি ওপার বাংলায় কোনো কাজ করেছেন ?
শাওন চৌধুরী – আমি বাংলাদেশের কিংবদন্তী শিল্পী রুনা লায়লা আপা ও সাবিনা ইয়াসমিন আপার সাথে গান করেছি। তাছাড়া জনপ্রিয় শিল্পী ফাহমিদা নবী, রিজিয়া পারভিন, বেবী নাজনিন তাঁদের সাথে গান করেছি। আর ওপার বাংলায় গান করেছি হৈমন্তি শুক্লা দিদি, অনুরাধা পাডোয়ালজি, আশা ভোসলেজি, লতাজি এবং কুমার সানু দাদার সাথে। লতাজি আমাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, শাওন আচ্ছা গাতা হ্যাঁয়। এটা আমার জন্য অনেক বড় প্রাপ্তি! বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে সঙ্গীত বিষয়ে অনেক পুরস্কার পেয়েছি।
হ্যাঁ, আমি সম্প্রতি ভারতে গানের কাজ করেছি। তা হল,ভারতের ক্রিকেট আইপিএল এর ওপরে ওরা দুটো গান করেছে একটা হল হিন্দি ভাষায় এবং অন্যটি বাংলা ভাষায়। আমি বাংলা গানটি গেয়েছি জিৎ গাঙ্গুলির সুরে। অলরেডি গানটি প্রচার হয়ে গেছে ভারতের তাঁরা টিভিতে এবং এস টিভিতে। এটা আমার সর্বশেষ রেকর্ডকৃত গান।
সঙ্গীতাঙ্গন -আপনি কোন্ প্লাটফর্মে সবচেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন গান করতে ?
শাওন চৌধুরী – আমি দুটো প্লাটফর্মে সবচেয়ে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি তা হল আধুনিক ও গজল গান করতে। আমি যখন কোনো অনুষ্ঠানে যাই তখন আমি বেসিক্যালি দুটো এপিসোড করে নেই। প্রথম এপিসোডে আধুনিক গান এবং দ্বিতীয় এপিসোডে গজল।
সঙ্গীতাঙ্গন – আগে একটি এ্যালবাম বের করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হত কিন্তু আজকাল ইউটিউবে একটি করে গান করে এবং গানটির ভিডিও করার ওপর জোর দেয়া হয় বেশী। তাতে কি আপনার মনে হয়, গানটির স্বকীয়তা বজায় থাকে ? অতীতের ক্যাসেট ও সিডির গান এবং বর্তমান সময়ের ইউটিউবের গানকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন ?
শাওন চৌধুরী – আমার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সঙ্গীত তো শ্রুতির বিষয়! এটা দৃষ্টির বিষয় নয়। এটা অডিবিলিটির বিষয়, ভিজ্যুয়েল বিষয় নয়। ভিজ্যুয়েল বিষয়টি সিনেমায় প্রযোজ্য। নায়ক নায়িকা গানটি লিপ্সিং করবে। আর যে গানটি গাইবে তাঁর নাম লেখা থাকবে। যারা গানটি দেখতে চায় তারা তা বারবার দেখবে। কিন্তু গান যারা শুনতে চায় তারা ভিডিও দেখবেনা। কারণ গান হল শোনার বিষয়। গান শোনার যে স্টেশন ছিল তা হল ক্যাসেট আর সিডি। আমরা এক সময় হেমন্ত, মান্নাদের গান শুনে হাসতাম কাঁদতাম এমনকি গানকে ফিল করতাম তবে শিল্পীদের দেখার ইচ্ছে হতোনা। আর এখনতো মডেলদের দিয়ে গানগুলো ভিডিও করা হয়। গানের চেয়ে ভিডিও দেখাতে বেশী উৎসাহিত বোধ করে সবাই। আজকাল তো সেই রকম গান হয়না তেমন। আমি সবার প্রতি ভালোবাসা রেখেই বলছি, কণ্ঠ হল গড গিফটেড। আমার ওস্তাদজি বলতেন, বেটা, গাইতে হলে প্রথমে দরকার হচ্ছে কণ্ঠ। যার কণ্ঠ নেই তাকে দিয়ে তো কোনোদিন গান হবে না। এটা টাকা দিয়েও তুমি কিনতে পারবেনা! সুতরাং যার কণ্ঠ আছে সে একটু তালিম নিলেই তার কণ্ঠ ধারালো হবে। বর্তমানে হচ্ছে কি আপা, সবাই নামধাম করার জন্য বিভিন্ন সফটওয়ারের মাধ্যমে গলাকে ডিস্টিউন থেকে টিউনে এনে গান করে এবং মডেলদের দিয়ে ভিডিও করে গান ছারে। হয়তো জীবদ্দশায় কিছুদিন সে পরিচিতি পাবে তবে শিল্পী হিসেবে আমি মনে করিনা সে টিকে থাকবে!
সব কিছু কমার্শিয়াল হয়ে যাচ্ছে, সেই কারণে শিল্পীরা সাধনা করেনা এবং নিজেকে গানের জন্য সেইভাবে তৈরি করেনা। লাইভ প্রোগ্রামে এসে ডিস্টিউনে গান গাচ্ছে, কি লজ্জার ব্যাপার! রুনা আপা, সাবিনা আপার মত শিল্পী আর হবেনা।
সঙ্গীতাঙ্গন – ভাইয়া, এবার অন্য প্রসঙ্গে আসি। আপনার পরিবারে কে কে আছেন ?
শাওন চৌধুরী – আমার পিতামাতা দু’জনেই মারা গেছেন। এখন আমরা চার ভাইবোন। দু’ভাই ও দু’বোন। সবাই বিবাহিত। আমার নিজের পরিবারে আমার স্ত্রী ও আমার এক মেয়ে আছেন। আমার মেয়ে স্কুলে পড়ছে এবং পাশাপাশি ক্লাসিকাল গানের ওপর তালিম নিচ্ছে। আমার স্ত্রী বিসিএস অফিসার। উনি হলেন প্রশাসনিক ক্যাডারে যুগ্ম সচিব হিসাবে চাকুরীরত।
সঙ্গীতাঙ্গন – ভাইয়া, আমার জানা মতে আপনিও বিসিএস টেক্সাশন ক্যাডার অফিসে সিনিয়র যুগ্ম কর কমিশনার হিসাবে নিয়োজিত এবং সেই সাথে গান নিয়েও ব্যস্ত সময় কাটান, আপনার এই ব্যস্ততা বা আপনার গানকে ভাবী কিভাবে দেখছেন ?
শাওন চৌধুরী – আমার সহধর্মীনি আমাকে সবসময় সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন এবং তিনি চান যে, আমি যেন শিল্পী হিসেবে আরও ভাল করি। আমার প্রতিটি সাফল্যে তিনি গৌরব বোধ করেন। তবে সেতো আমলা মানুষ, দীর্ঘদিন ধরে আমলাতন্ত্রের মধ্যে আছেন সুতরাং তাঁদের আমলাতান্ত্রিক প্রকাশভঙ্গী সবার মত হয় না কিন্তু সে আমাকে সাপোর্ট করে যাচ্ছেন গান করার জন্য এবং সবসময় ইন্সপায়ার করেন আমি যেন ভালো করি।
সঙ্গীতাঙ্গন – আপনি অনেক ছোটবেলা থেকে গান শিখছেন এবং তখন তো আপনার বাবা মা বেঁচে ছিলেন তখন তাঁরা আপনার গানের ব্যাপারে কি উৎসাহ দিতেন ?
শাওন চৌধুরী – আমার বাবা চাননি গান করি। বাবা চাননি এইজন্নে যে, আমি শুধু মাত্র শিল্পী হয়ে জীবনযাপন করব, এটা তিনি চাননি। কারণ শিল্পী হয়ে আমি অভাব অনটনে দারিদ্রতার মাঝে দিন কাটাবো, তাই তিনি চাননি।
তিনি শুধু বলতেন লেখাপড়া কর ভালো রেজাল্ট কর এবং জীবনে প্রতিষ্ঠিত হও। তবে তিনি গান করা অপচ্ছন্দ করতেন না। আমি যখন বিসিএস পাশ করে অফিসার হয়ে গেলাম তখন আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, বাবা আমার গান গাওয়া কি তুমি পচ্ছন্দ কর, না করোনা ? তখন বাবা বল্লেন, বাবা তুমি এখন বিসিএস অফিসার হয়েছো, এখন সারাদিন গান গাও আমার কোনো আপত্তি নেই। আমার মা টেলিভিশনে আমার গান দেখে খুব আনন্দিত হতেন। আমাকে বলতেন, বাবা আমার মনটা খুব ভালো লাগছে। আমি বলতাম কেন ভালো লাগছে মা ?সে বলতেন, আমি তোমার গান দেখেছি আজ। এখন তাঁদের মিস করি।
সঙ্গীতাঙ্গন – ভাইয়া, সর্বশেষ প্রশ্ন আপনার কাছে। আপনার গান নিয়ে কি কোন নিজস্ব পরিকল্পনা আছে ?
শাওন চৌধুরী – আমি সঙ্গীত জগতে আজীবনই থাকব, আমৃতই থাকবো। কারণ গান আমার রক্তের মধ্যে মিশে গেছে। আমার একটি ছোট পরিকল্পনা আছে তেমন বড় নয়। ভাবছি চাকুরী জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার পর আমি নিজেই স্টুডিও করব, যে স্টুডিওতে যারা মেধাবী শিল্পী তাঁদেরকে আমি ছাড় দিব। কোনো কমার্শিয়াল কিছু থাকবেনা। আমার নিজস্ব প্রোডাকশনগুলো সেখানে রাখবো। আমি সেখানে বসবো। আমার নিজের গান রেকর্ডিং এর ব্যাপার আছে। তাছাড়া আমি বাচ্চাদের জন্য একটি মিউজিক স্কুল করবো সেই পরিকল্পনা আছে। শুধু মাত্র বাচ্চাদের শিখাবো সেখানে বড়দের শিখাবোনা। সেখানে কোনো বেতন বা ফি নির্ধারণ থাকবেনা। বাচ্চাদের অভিভাবকগন এটা চালানোর মত যে যার যার মত করে হেল্প করবে কোন জাতীয় ফি বা বেতন থাকবেনা। বাট আমি সিরিয়াসলি ওদের শেখানোর চেষ্টা করবো। আমি যতটুকু জানি বা শিখেছি তা ওদের মাঝে বিলিয়ে দিব। এটাই আমার স্বপ্ন।
সঙ্গীতাঙ্গন – ভাইয়া আপনার পরিকল্পনাগুলো শুনে খুব ভালো লাগছে। আপনার সাথে কথা বলে আপনার সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আজকে শুধু গান নিয়ে কথা হল আশা করছি পরবর্তীতে আপনার কোনো এক অবসরে অন্যান্য বিষয় নিয়ে আবার কথা হবে এই আশা নিয়ে এবং সঙ্গীতাঙ্গনের পক্ষ থেকে আপনার জন্য অনেক অনেক শুভকামনা জানিয়ে শেষ করছি। আপনার সাথে আলাপ করে ভালো লাগল। ভালো থাকবেন সব সময়।
শাওন চৌধুরী – আমারও খুব ভালো লেগেছে আপনার সাথে কথা বলে আপা। আপনার জন্য ও সঙ্গীতাঙ্গন এর জন্য শুভকামনা রইল।