– মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না।
‘অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান
যেনো ভুলে যেওনা
একই বন্ধনে বাধাঁ দুজনে
এ বাধঁন খুলে যেওনা
অশ্রু দিয়ে লেখা এ গান’
সত্যি ভুলে যাওয়ার মত না। ভুলে গেলেও মনে করিয়ে দেবে তার রেখে যাওয়া গান।
কন্ঠের যাদুকরি শক্তিতে ভরিয়ে দিয়েছে ভক্তের মন। দীর্ঘ পাচঁ দশকের মত সময় ধরে সঙ্গীতের মুর্ছনা ছড়িয়ে যাচ্ছেন। পেয়েছেন হাজার কোটি ভক্তের ভালোবাসা। স্থান করে নিয়েছে তাদের অন্তরের মনি কোঠায়। বসন্তের কোকিল যখন মিষ্টি সুরে গান গায় শুনতে খুব মধুর লাগে। আর তেমনি এক মিষ্টি কন্ঠের অধিকারিনী এই কন্ঠশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন। একজন খ্যাতনামা বাংলাদেশী সঙ্গীতশিল্পী। দেশাত্মবোধক গান থেকে শুরু করে প্রায় পাচঁ দশক ধরে বাংলা গানের বিভিন্ন ধারার নানান (উচ্চাঙ্গ ধ্রুপদ, লোকসঙ্গীত থেকে আধুনিক বাংলা গানসহ চলচ্চিত্র) মিশ্র আঙ্গিকের সুরে অবাধ যাতায়াতে সঙ্গীতশিল্পী সাবিনা ইয়াসমিন-এর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী । সব ক’টা জানালা খুলে দাও না, মাঝি নাও ছাইড়া দে, সুন্দর সুবর্ণ -এ ধরনের অসংখ্য কালজয়ী গানের শিল্পী তিনি। ছায়াছবিতে ১২ হাজারের মতো গান সহ ১৬ হাজারের মতো গান করেছেন তিনি। সেই মহীয়সী কন্ঠ শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৪ঠা সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরায়। আজ তার শুভ জন্মদিন। জন্মদিনের মতো এমন বিশেষ দিনে কথা হয় সঙ্গীতাঙ্গন এর সাথে।
সঙ্গীতাঙ্গন :- আস- সালামুআলাইকুম। কেমন আছেন? ঈদ মোবারক।
সাবিনা :- আলহামদুলিল্লাহ সবার দোয়ায় ভালো আছি। ঈদ মোবারক।
সঙ্গীতাঙ্গন :- আজ তো আপনার জন্মদিন? শুভেচ্ছা নিবেন, শুভ জন্মদিন।
সাবিনা :- ধন্যবাদ অনেক অনেক ধন্যবাদ আজকের এই বিশেষ দিনের বিশেষ সময়ে।
সঙ্গীতাঙ্গন :- জন্মদিন এটা একটা বিশেষ দিন আনন্দের দিন আপনার অনুভূতিটা সে ক্ষেত্রে কেমন ?
সাবিনাঃ জন্মদিনটাই একটা স্পেশাল দিন। অনুভূতিটা আসলে আলাদা করে তেমন নেই। আনন্দ করা হই চৈ করা এটা খুব ভালো লাগে এই আর কি।
সঙ্গীতাঙ্গন :- এবারের জন্মদিনটা কিভাবে উপভোগ করছেন ?
সাবিনা :- আসলে প্রতি বছর জন্ম দিনে আমি বিদেশে থাকি। এই সময়টাতে অনেক শো হয় আমাকে ডাকা হয়, যাই। যেহেতু ঘড়োয়া ভাবেই আমি গান করি তাই যেতেই হয়। তাই বেশির ভাগ জন্মদিন বিদেশেই করা হয়। এবার যদিও দেরী হয়ে গেছে তার উপর আবার ঈদ। তাই এবার ২৭ তারিখ যাবো দেশের বাইরে। এই জন্মদিনে আমার বোন আসছে মেয়েরা আসছে তাদের নিয়েই থাকবো আর কি। নিজেরা নিজেরাই আনন্দ করবো। তেমন আর কিছু নেই।
সঙ্গীতাঙ্গন :- কোন চ্যানেলে আপনাকে নিয়ে–?
সাবিনা :- নানা না চ্যানেলে কোন কিছু হবে না এ ব্যাপারে। তবে গতকাল বিটিভিতে এক ঘন্টার একটা শো ছিল যেখানে আমি গান করেছি ঈদ উপলক্ষ্যে। তার বেশি কিছু না।
সঙ্গীতাঙ্গন :- দেশের বাইরে জন্মদিন কিভাবে সেলিব্রেট করেন ?
সাবিনাঃ সেখানে বাঙ্গালীরা অনেক বড় অনুষ্ঠান করে। তারা খুব ধুমদাম করে আনন্দ করে হৈচৈ করে। বাঙ্গালীদের সাথে কথা হয়। প্রায় অনেকের সাথে দেখা হয়। একসাথে খাওয়া দাওয়া করা। গান করা এই আর কি। অনেক মজা হয়। সবাই আনন্দ করি। কিন্তু আমি ব্যক্তিগত ভাবে কিছুই করিনা।
সঙ্গীতাঙ্গন :- ঈদ কিভাবে উৎযাপন করলেন ?
সাবিনা :- ঈদ আসলে আমি সব সময় অনেক আনন্দের সাথেই কাটাই। কোরবানির ঈদে অনেক জামেলা হয়। যেহেতু কোরবানির ঈদ ছিল তাই কোরবানি দিলাম মাংস গরীব দুঃখীদের বিতরণ করলাম। আত্বীয় স্বজনদের পাঠালাম এই করেই ঈদের দিনটা কাটালাম।
সঙ্গীতাঙ্গন :- ঈদের এই বিশেষ দিনে আপনার কোটি ভক্তের জন্য কিছু বলবেন ?
সাবিনা :- সত্যি বলতে কি আমার ভক্তের অনুপ্রেরণা ও ভালোবাসায় আমার পথ চলা। আমার এ পর্যন্ত আসার পেছনে ভক্তের ভালোবাসাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব। তারা আমার গান শুনে বলেই তো আমি গান করি। এ পর্যন্ত প্রায় পাচঁ দশকে ১৬ হাজার গান করেছি তা শুধু ভক্তের ভালোবাসায়। আমাকে যেমন তারা মন থেকে ভালোবাসে তেমনি আমিও আমার ভক্তদের অন্তর দিয়ে ভালোবাসি। তাদের সুন্দর সুস্থ্য জীবন কামনা করি। ঈদের শুভেচ্ছা জানাই আমার কোটি ভক্তদের “ঈদ মোবারক”। সবাই সুন্দর থাকুক ভালো থাকুক এই প্রত্যাশাই করি। সবার কাছে দোয়া চাই সবাই যেনো আমার জন্য দোয়া করেন।
সঙ্গীতাঙ্গন :- আমাদের কে সময় দেবার জন্য অনেক ধন্যবাদ। জন্ম দিনের শুভেচ্ছা শুভ জন্মদিন।
সাবিনা :- আপনাদেরও জানাই শুভেচ্ছা। আমার জন্য সবাই দোয়া করবেন ঈদ মোবারক।
সাবিনা ইয়াসমিন তাঁর ৫ বোনের মাঝে ৪ বোনই গান করেছেন। তারা হলেন ফরিদা ইয়াসমিন, ফওজিয়া খান, নীলুফার ইয়াসমিন এবং সাবিনা ইয়াসমিন। তাঁর বড় বোন ফরিদা ইয়াসমিন যখন দুর্গাপ্রসাদ রায়ের কাছে গান শেখে তখন ছোট্ট সাবিনাও উপস্থিত থাকতেন। পরবর্তীতে ওস্তাদ পি সি গোমেজের কাছে একটানা ১৩ বছর তালিম নিয়েছেন। মাত্র ৭ বছর বয়সে স্টেজ প্রোগ্রামে অংশ নেন বলে জানান তিনি। ছোটদের সংগঠন খেলাঘরের সদস্য হিসেবে রেডিওতে টেলিভিশনে গান করেছেন নিয়মিত। ১৯৬৭ সালে ‘আগুন নিয়ে খেলা’ এবং ‘মধুর জোছনা দীপালি’ গানটির মাধ্যমে তিনি প্লেব্যাক গায়িকা হিসেবে আত্ন প্রকাশ করেন। তবে ‘নতুন সুর’ ছবিতে প্রথম গান করেন তিনি শিশু শিল্পী হিসেবে।
সাবিনা ইয়াসমিন; যিনি পাচঁ দশকেরও বেশি সময় ধরে গানের ভূবনে বিচরন করছেন – বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র রুনা লায়লা ছাড়া তার সমকক্ষ হয়ে আর কেউ বোধ হয় এত লম্বা সময় ধরে আধিপত্য বজায় রেখে চলতে পারেন নাই। গত কয়েক দশকে তিনি সর্বমোট কত হাজার গান গেয়েছেন তার সঠিক হিসেব ১৬ হাজারের মত হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। মরমী শিল্পী সেই আব্দুল আলীম থেকে শুরু করে একালের কোন উঠতি গায়কের সাথেও অবিরাম গেয়ে চলেছেন একের পর এক গান। সুযোগ পেয়েছেন উপমহাদেশের বরেণ্য সুরকার আর,ডি,বর্মণের সুরে সাথে গান গাওয়ার, বিখ্যাত কিশোর কুমারের ও মান্না দের সাথেও ডুয়েট গান গেয়েছেন। ১৯৮৫ সালে গানের জন্য ভারত থেকে ‘ডক্টরেট” ও লাভ করেছেন। সাধারণত চলচ্চিত্রের গানেই তিনি বেশী কন্ঠ দিয়েছেন। চলচ্চিত্রে প্রায় ১২ হাজারের মতো গান করছেন তিনি। দশবার জিতেছেন জাতীয় পুরস্কার। সাবিনা ইয়াসমিন এর সাম্প্রতিকতম এ্যালবামটির নাম ‘তেরো’ -১৩, এটি কবীর সুমন এর সাথে এক সঙ্গে গাওয়া। সাবিনা ইয়াসমিন সঙ্গীতে অবদানের জন্য পুরষ্কৃত হয়েছেন অনেক বার। যেমন – ১৯৮৪ সালে একুশে পদক, ১৯৯৬ সালে স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার মোট ১০টি, বাচসাস পুরস্কার মোট ৬টি, বিএফজেএ পুরস্কার ১৯৯১ সালে। উত্তম কুমার পুরস্কার ১৯৯১ সালে, এইচ এম ভি ডাবল প্লাটিনাম ডিস্ক, বিশ্ব উন্নয়ন সংসদ থেকে সংগীতে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি লাভ করেছেন ১৯৮৪ সালে, ১৯৭৪ ও ১৯৭৫ সালে জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৭৫ সালে চলচ্চিত্র পূবাণী চলচ্চিত্র পুরস্কার, ১৯৯০ সালে শেরে বাংলা স্মৃতি পদক, ১৯৯২ সালে অ্যাস্ট্রোলজি পুরস্কার, ১৯৯২ সালে জিয়া স্মৃতি পদক এবং নিউইয়র্ক, লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে পান ‘বেস্ট সিঙ্গার’ পুরস্কার। গান গাওয়ার জন্য সাবিনা ইয়াসমিন বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন যেমন, ইংল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, হংকং, আমেরিকা, বাহরাইন ইত্যাদি।
এছাড়া ভারত, পাকিস্তানে তিনি অনেকবার ভ্রমণ করেছেন। এছাড়াও তিনি বিভিন্ন ভাষায় গান গেয়েছেন। সাবিনা ইয়াসমিন গাজী মাজহারুল আনোয়ারের ‘উল্কা’ নামের সিনেমাতে অভিনয় করেছেন। তিনি ২০১০ সালে চ্যানেল আই সেরা কন্ঠ নির্বাচনে একজন বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাবিনা ইয়াসমিনের ক্যারিয়ারে খান আতাউর রহমানের অবদান অনেক।
বিখ্যাত এই শিল্পীর জন্মদিনে তার জন্য রইলো শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন শুভ জন্মদিন।