– কবি ও সাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
করোনা ভাইরাস, এমন এক ভাইরাস! যা কিনা সমগ্র পৃথিবীকে স্থবির করে দিয়েছে। চীন থেকে এর উৎপত্তি হলেও বিশ্বের প্রতিটি দেশে এই ভাইরাস এখন মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। ইউরোপ, আমেরিকাসহ সকল মহাদেশে এই ভাইরাস সংক্রামকরূপে আবির্ভূত হয়েছে। মৃত্যুর হারও বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশ পর্যাপ্ত সময় পেয়েছিল এই ভাইরাসকে ঠেকানোর জন্য, পদক্ষেপ নেয়ার। যখন নিল তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে! সময় কারো জন্য বসে থাকেনা। ফলে বাংলাদেশীদের মধ্যে বিভিন্নভাবে এক এক করে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। বলা হচ্ছে এপ্রিলের মাঝামাঝি এই ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করবে। তারপরেও মানুষের মধ্যে সচেতনতার বৃদ্ধি ঘটেনি বরং সরকার তাঁদেরকে কিছুদিন ঘরে থাকার জন্য ছুটি দিয়েছে, তাঁরা সেই ছুটিকে উৎসবমুখর পরিবেশে উপভোগ করছে। অথচ এই করোনা ভাইরাস সংক্রামক হয় জনসমাবেশে থাকলে। করোনা ভাইরাস এবং সরকার যে ছুটি দিয়েছে সেই সম্পর্কে তাঁর কি অভিব্যক্তি! এই সকল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয় জনপ্রিয় গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জীর সাথে।
করোনা ভাইরাস নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন- করোনা ভাইরাস নিয়ে আমাদের আরও প্রস্তুতি নেয়া দরকার। আরও সচেতনতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্হা বাড়ানোর জন্য সরকারকে আরও বেশী উদ্যোগ নিতে হবে। এর সাথে সাথে আমাদের সামাজিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে। বিপন্ন মানুষের পাশে সবার দাঁড়াতে হবে। সমস্ত জাতির ওপর যেহেতু দুর্গতি নেমে এসেছে তাই সরকারের সাথে সাথে সবার সচেতন হতে হবে। সরকারের দেয়া দশ দিনের ছুটি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন- সরকারি ছুটি কোনক্রমেই ঈদের ছুটি হিসেবে ভোগ করার জন্য দেয়া হয়নি। এই ছুটি দেয়া হয়েছে নিজ নিজ বাসায় থেকে কোয়ারেন্টাইন মেইন্টেইন করার জন্য, ছুটি উপভোগ করার জন্য না। রোগ সংক্রামককে ব্যাহত করার জন্য এই ছুটি দেয়া হয়েছে। এই ছুটির সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যেয়ে, রোগ বিস্তার করার জন্য দেয়া হয়নি। বরং বাসায় থেকে সবার সাথে দূরত্ব বজায় রেখে থাকার জন্য দেয়া হয়েছে। সরকার থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সরকারি কর্মচারীরা নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করবেন এবং প্রয়োজবোধে কর্মস্থলে তাঁদের দায়িত্ব পালন করবেন। তাই আমরা আশা করবো সবাই নিজ নিজ বাসায় অবস্থান করবেন এবং প্রয়োজনবোধে কর্মস্থলের দায়িত্ব পালন করবেন। দৃষ্টি রাখতে হবে এই ছুটি যেন কোনক্রমেই সংক্রামক বিস্তারের জন্য কোনো ভূমিকা না রাখে। তাহলে ছুটি দেয়াটাই পুরোপুরিভাবে অর্থহীন হবে।
সরকারি কর্মচারীদের ক্ষেত্রে না হয় এই ব্যবস্হা বুঝা গেল! অন্য সবার ক্ষেত্রে কি করা উচিত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন- ছুটিটা দেয়া হয়েছে এই কারণে যেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রামক না ঘটে! আমাদের সবাইকে বাসায় থেকে এই বিষয়টি বিবেচনায় রাখতে হবে। এই ছুটিটা আনন্দ উৎসব করার জন্য না আর এই ছুটিটা বছরের কোনো পার্বণের ছুটিও নয়! এই ছুটি বিশ্বমানবতার বিপর্যয়ের একটা ছুটি। বিশ্বমানবতার ভয়াবহতাকে মুক্ত করার জন্যই এই ছুটিটা দিয়েছে। সুতরাং ছুটির উদ্দেশ্যটা যেন আমরা সবাই মনে রাখি। তাই ছুটিটাকে আনন্দ উৎসবে যেন না রাখি। কারণ যত বেশী লোকসমাগম হবে তত বেশী সংক্রামক বৃদ্ধি পাবে। সেই দিকে সকলের দৃষ্টি রাখতে হবে যেন বেশী লোকসমাগম না হয়।
যারা গ্রাম ছেড়ে, বাবা মা এবং পরিবার ছেড়ে শুধু মাত্র চাকরির উদ্দেশ্যে শহরে এসেছে, তাঁদের অনেকেইতো বাবা মা অথবা পরিবারের টানে এই ছুটিতে বাস, লঞ্চ ও ট্রেনে করে বাড়ি যাচ্ছে বা গেছে। তাঁরা হয়তো অনেকেই জানেও না, করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার ব্যাপারে! তাঁদের জন্য করনীয় কি হতে পারে ? এই ব্যাপারে তিনি বলেন- জাতীয় চেতনার মান তো একদিনে বাড়বেনা! কিন্তু এসব বিষয়ে তো প্রতিমুহূর্তে সতর্কতার ব্যবস্হা নেয়া হচ্ছে, মিডিয়াতে সতর্কতা প্রচার করা হচ্ছে। পত্রিকাগুলোতে সাবধানতা অবলম্বন করার জন্য বলা হচ্ছে। নিশ্চয়ই তাঁরা নিজের ও পরিবারের জীবনের দিকে তাকিয়ে সচেতন হবেন। কেউ কেউ হয়তো বাড়িতে যাবেনা আবার কারো কারো ইমারজেন্সি যেতে হতেও পারে। তবে খেয়াল রাখতে হবে এই ছুটিটা যেন মিসইউজ না হয় এবং রোগ বিস্তারের সহায়ক ভূমিকা যেন না পালন করা হয়। আসলে জনে জনে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য নিজেকে আগে সচেতন হতে হবে। আরেক জন সচেতনতা বৃদ্ধি করে দিবে তাতো হয়না! নিজেকেই সবকিছু উপলব্ধি করতে হবে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য। এই ব্যপারে জানতে
চাওয়া হলে, তিনি বলেন- সচেতনতা সম্বন্ধে আমাদের যে জ্ঞান এবং মূল্যবোধ! সেটা এখন পরিবর্তন হচ্ছে। যেমন, আগে মনে করা হত যে, কারো অসুখ হলে সাথে সাথে দেখতে যাওয়া, এটা ছিল আমাদের মূল্যবোধ। আর এখন করোনা ভাইরাসের কারণে আমাদের মূল্যবোধ হচ্ছে, কারো অসুখ হলে দেখতে যেতে পারবোনা। আগে বাসায়, হাসপাতালে আত্মীয়স্বজনের অসুখ হলে দেখতে যেতাম কিন্তু এখন কাছে গিয়ে দেখা যাবেনা বরং দূর থেকে সহায়তা করতে হবে। করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের এক নতুন মূল্যবোধের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন করে বাঁচার পথ দেখিয়ে দিয়েছে। আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের চাল-চলন, সমাজ ব্যবস্হা সবকিছু নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবনার একটি শক্তি যোগাচ্ছে। আগে বিশ্বের উন্নত দেশগুলো দরিদ্র দেশগুলোর দায়দায়িত্ব নিয়ে নিজেদেরকে অনেক উন্নত ভাবত! এখন বিশ্বের উন্নত দেশগুলোই সংকটে পড়ে গেছে। কেউ স্বর্গে বাস করবে আর কেউ নিম্নে থাকবে এই ধারণা একাকার করে দিয়েছে করোনা ভাইরাস।সবাইকে সমানভাবে বাঁচতে হবে। সবাইকে নিয়ে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে। করোনা ভাইরাস বিশ্বের সবইকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে।
প্রকৃতিকে যেভাবে ধ্বংস করে দিচ্ছিল মানব সমাজ! অনেকেই মনে করেন সেই প্রকৃতিকে বাঁচানোর জন্যই করোনা আবির্ভূত হয়েছে। তার কাছে এই ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে, তিনি বলেন- আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি, প্রকৃতির সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছি, উত্তপ্ত করেছি উন্নতির জন্য। করোনা বার্তা নিয়ে এসেছে প্রকৃতির হয়ে, তাই উন্নতি মুখ থুবড়ে পড়েছে। এইসব উন্নতি, উন্নতি না! তা করোনা ভাইরাস প্রমাণ করে দিয়েছে।
পৃথিবীতে যেভাবে ধর্মীয় এবং সামাজিকভাবে অন্যায় অবিচারের মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল! সেজন্য কেউ কেউ মনে করেন, মানুষের এই অহমিকাকে দমন করার জন্যেই করোনা ভাইরাসের আগমন! এই ব্যাপারে আপনার অভিমত জানতে চাচ্ছি। তখন তিনি বলেন- আমাদের বিশ্ব ব্যবস্থা, আর্থিক ব্যবস্থা, সমাজ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সবকিছু নিয়েই আমাদের নতুন করে ভাবার জন্য করোনা ভাইরাস বার্তা নিয়ে এসেছে। আমাদের আরও মানবিক হতে হবে, প্রকৃতি নির্ভর হতে হবে। আমরা আর তথাকথিত উন্নয়নের নামে, প্রকৃতি ধ্বংস করার উন্নয়নে আবৃষ্ট হতে পারবোনা। আমাদের ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো যেমন বন্ধ হয়ে গেছে তেমনি পশ্চিমা দেশগুলোর ধর্মীয় উপাসনালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এখন নিজ নিজ বাসায় সবাই একা একা নামাজ আদায় করছেন। এটা ধর্মীয় দিক থেকে বিরাট বিপর্যয়! আমাদের এখান থেকেই শিক্ষা নিতে হবে। তা না হলে সামনে আরও বড় ধরণের বিপদ হতে পারে। করোনা ভাইরাসের এই বিপদ থেকে যেন আমরা সবাই শিক্ষা পাই।
জনপ্রিয় গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জীর সাথে আলাপচারিতায় বোঝা গেল যে, সবাইকে করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে সচেতন হতে হবে, নিজ নিজ জায়গা থেকে। এই আলাপচারিতার ইতি টানব জনপ্রিয় এই গীতিকবির সম্প্রতি লেখা করোনা ভাইরাস নিয়ে একটি কবিতা দিয়ে। তার আগে শ্রদ্ধেয় গীতিকবি শহীদুল্লাহ ফরায়জী ভাইকে সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে জানাই অনেক অনেক শুভকামনা।
কবিতা…
এমন মৃত্যু দিয়ো আমায়
নামাজে জানাজা
হয় যেন আদায়…
লাশ থাকে অবহেলায়
হয়না জানাজা
মৃত্যু হলে করোনায়।
বেঁচে থাকা যায়
কেবলমাত্র সচেতনতায়
আর স্রষ্টার করুণায়
মৃত্যু হউক যথা তথায়
নেবো বিদায়
স্রষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতায়।