– রহমান ফাহমিদা, সহকারী-সম্পাদক।
একজন নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ সঙ্গীত শিল্পী এবং একাধারে স্নেহপরায়ণ মানুষ, বিপদের বন্ধু ও সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনার মানুষ ছিলেন সঙ্গীত শিল্পী শশী জাফর। তিনি ছিলেন উপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রবন্ধকার সাহিত্যিক ইব্রাহীম খলিল ও রিজিয়া খলিল-এর সাত ছেলেমেয়ের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। দীর্ঘদিন থেকেই সঙ্গীত জগতে তাঁর পদচারণা ছিল। তবে তিনি একসময় জনপ্রিয়তা লাভ করলেও সঙ্গীত অঙ্গনে থেকেও প্রচারের অন্তরালেই ছিলেন এতদিন এবং অন্তরালে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে, না ফেরার দেশে পাড়ি দিয়েছেন গত ৩০শে জুন। আজকে সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলী জানিয়ে, নিভৃতচারী প্রচারবিমুখ এই সঙ্গীত শিল্পীকে এবং তাঁর কাজকে অন্তরাল থেকে সকলের সম্মুখে প্রচার করার জন্য এই ক্ষুদ্র প্রয়াস।
সঙ্গীত শিল্পী শশী জাফর নিজের ভালো লাগা ও ভালোবাসা থেকেই গান করতেন। সঙ্গীতেই ছিল তাঁর প্রেম এবং সঙ্গীত-ই ছিল তাঁর দিবানিশির স্বপ্ন। সঙ্গীতকে ছেড়ে কখনোই সে বেঁচে থাকার চিন্তা করেননি! যখন সঙ্গীত জগতে সবাই কভার সং করার জন্য ব্যস্ত এবং মৌলিক গানের সঙ্কট দেখা যাচ্ছে তখন প্রতিভাবান শিল্পী শশী জাফর একের পর এক তাঁর মৌলিক গান সঙ্গীত জগতকে উপহার দিয়ে গেয়েছেন। এমনকি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টায় ভিন্নধারার বেশকিছু এ্যালবাম প্রকাশ করে মৌলিক গানের প্রতিভাবান শিল্পী শশী জাফর শ্রোতাভক্তদের কাছ থেকে প্রশংসিত হয়েছেন। শিল্পী শশী জাফর অনেক ছোটবেলা থেকেই গান করেন। স্কুল, কলেজে এবং বিভিন্ন ষ্টেজে অংশগ্রহণ করে প্রশংসিত হয়েছেন। তবে ১৯৯৭ সালে জনপ্রিয় সুরকার ও সঙ্গীতপরিচালক মিল্টন খন্দকারে কথায় ও সুরে তাঁর প্রথম এ্যালবাম প্রকাশ পায় ‘হয়তো ভুলে গেছো’ -শিরোনামে, ক্যাসেটের মাধ্যমে। যা প্রচুর জনপ্রিয়তা লাভ
করে। এরপর আর তাঁকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তাঁর বেশকিছু এ্যালবাম প্রকাশ পেয়েছে তারমধ্যে, একক ৯টি, ডুয়েট ৬টি এবং বেশকিছু মিক্স এ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। দেশের অনেক জনপ্রিয় শিল্পীর সংগে বিভিন্ন এ্যালবামে গেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে এন্ড্রু কিশোর, সুবীর নন্দী, শাকিলা জাফরসহ বিভিন্ন শিল্পী আছেন। এ্যালবামের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। তিনি বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতারের ‘ক’ শ্রেনীর তালিকাভুক্ত শিল্পী ছিলেন। এছাড়াও তিনি ফাগুন অডিওভিশন থেকে প্রচারিত ‘পাঁচফোঁড়ন’ অনুষ্ঠানেও গান পরিবেশন করেন এবং প্রশংসিত হন। সম্ভবতঃ ২০১৬ সালে বেশকিছু গান নিয়ে তাঁর সর্বশেষ একক এ্যালবাম ছিল ‘মেন্টাল’। এই এ্যালবামের গানগুলির মধ্যে ছিল, মায়া, এই শোন শোন, তুমি দিও শান্তির ভোর, চেহারাকে রং সাজিয়ে, ভালবাসতে যদি না পার, বড় লোকের বেটি লো, এবং লালনগীতি ‘আশা পূর্ণ হল না’। মায়া গানের ভিডিওটি দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল কিন্ত কোন্ কারণে ভিডিওটি প্রচার হচ্ছে না, তা বোধগম্য নয়। এছাড়া ২০১৬ সালে সুরঞ্জলী ব্যানারে পরপর তিনটি গান, রবীন্দ্র সঙ্গীত ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণে’, নজরুল গীতি
‘নুরজাহান’ এবং লালন গীতি ‘আশা পূর্ণ হোল না’ -এই তিনটি গান ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়। ২০১৬ সালে শশী জাফর ও রিফাত রিতু’র একটি ডুয়েট গান ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয় ‘এই শোন শোন’ শিরোনামে। এছাড়া শশী জাফর “নারী” নামক একটি চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক করেছেন। চলচ্চিত্রটির পরিচালক আলি আজাদের কথায় গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অমিত চ্যাটার্জী। কলকাতায় চলচ্চিত্রের এই গানটির শুটিং হয়েছে।
শিল্পী শশী জাফর তাঁর সঙ্গীত ক্যারিয়ারে সব সময়ই মৌলিক গান করার চেষ্টা করেছেন। প্রতিভাবান এই শিল্পী বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জনপ্রিয় শিল্পীদের সাথে গান করেছেন এবং নতুন নতুন গান উপহার দিয়েছেন তাঁর ভক্তশ্রোতাদেরকে। শশী জাফরের ‘ভালোবাসার সমীকরণ’ নামে একটি মিক্স এ্যালবাম প্রকাশিত হয় ‘মাই সাউন্ড’ ব্যানার থেকে। এই এ্যালবামে শশী জাফর ছাড়া আরও গান গেয়েছেন, কুমার বিশ্বজিৎ, এসআই টুটুল, তৌসিফ ও আবিদ। এ্যালবামের সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অমিত চ্যাটার্জী। এছাড়া কিছুদিন আগে ‘হৃদয় শূন্য শূন্য লাগে’ শিরোনামের একটি নতুন গানে জনপ্রিয় শিল্পী দিনাত জাহান মুন্নির সঙ্গে কণ্ঠ দেন শশী জাফর। এই গানটি লিখেছেন জনপ্রিয় গীতিকার কবির বকুল, সুর করেছেন প্রতিক হাসান এবং গানের কম্পোজিশনে ছিলেন প্রীতম হাসান। ২০১৯ সালে গানটি রেকর্ডিং হয়। যতদুর জানা যায়, যে কোনো কারণে গানটি রিলিজ হয়নি তবে এখনো প্রচারের অপেক্ষায় আছে। ২০১৯ সালে শশী জাফরের আরেকটি গান ইউটিউবে রিলিজ হয়, গানটির শিরোনাম ‘চোখের জল’ এই গানটির কথা লিখেছেন সাকিব মুন্না, সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অমিত চ্যাটার্জী, ‘রন্স মিউজিক’ ব্যানারে প্রকাশিত হয় গানটি। এসএইচবি ব্যানার থেকে ২০১৯-এ শশী জাফরের রোমান্টিক গান ‘তোমাকে চাই’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। গানটির কথা লিখেছেন এইচএম রিপন এবং সুর করেছেন জনপ্রিয় সুরকার দেবেন্দ্র নাথ চ্যাটার্জী এবং সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অমিত চ্যাটার্জী।
শিল্পী শশী জাফরের আগের এ্যালবামগুলোর মধ্যে রয়েছে, সঙ্গীতার ব্যানারে ‘প্রেম ডুবুরী’, সুরঞ্জলীর ব্যানারে মমতাজের সাথে ডুয়েট ‘বন্ধু আমার গোলাপি’ (২০১৮), এন্ড্রু কিশোর, মমতাজ ও নাজু আখন্দের সঙ্গে মিক্সড ‘চল পালাই’ (ভিডিও সিডি), মিল্টন খন্দকারের কথায় ও সুরে মার্স -এর প্রযোজনায় ‘হয়তো ভুলে গেছো’ (১৯৯৭) সঙ্গীতার ব্যানারে ‘কেন এত কষ্ট দিলে’ প্রভৃতি। শিল্পী শশী জাফরের জনপ্রিয় গানগুলি হল- হয়তো ভুলে গেছো, নিশীথে নির্জনে, ডুবুরী বানাইলা, ভেঙ্গে দিয়ে এই মন, বন্ধু আমার গোলাপি, গোলাপি নেশা, ভালোবাসার চাদর, প্রহরী, ডার্লিং প্রভৃতি।
তাছাড়া কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদার কথায় পরপর তিন বছর তিনটি গান তাঁর ভক্ত শ্রোতাদের উপহার দেন শিল্পী শশী জাফর। গানগুলি হল যথাক্রমে – গোলাপি নেশা -শিরোনামে এই গানটি ২০১৮ সালে সিডি চয়েস মিউজিক ব্যানার থেকে ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়। গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অমিত চ্যাটার্জী। ডুয়েট এই গানে শিল্পী শশী জাফরের সাথে সহশিল্পী ছিলেন শিল্পী স্বরলিপি। ২০১৯ সালে ১৬ই ডিসেম্বর ‘প্রহরী’ -শিরোনামে একটি দেশের গান রন্স মিউজিক ব্যানার থেকে ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়। শিল্পী শশী জাফরের সাথে এই গানে কণ্ঠ দেন, অমিত চ্যাটার্জী ও আবিদ। গানটির সুর ও সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন অমিত চ্যাটার্জী। ১৯২০ সালে রহমান ফাহমিদার কথায় এবং অমিত চ্যাটার্জীর সুর ও সঙ্গীত পরিচালনায় শিল্পী শশী জাফরের একটি ডুয়েট রোমান্টিক গান প্রকাশিত হয় ইউটিউব চ্যানেলে মিত মিউজিক ব্যানার থেকে। গানটির শিরোনাম ছিল ‘ভালোবাসার চাদর’। শিল্পী শশী জাফরের সাথে এই ডুয়েট গানে সহশিল্পী ছিলেন লাবণী। রহমান ফাহমিদার লেখা এই ডুয়েট গানটিই শিল্পী শশী জাফরের প্রকাশিত শেষ গান! যদিও রহমান ফাহমিদার লেখা আরও কিছু গান তাঁর রেকর্ডিং করার কথা ছিল এবং সেই সাথে আরও অনেকের গান করার কথা ছিল। অনেকগুলো অসমাপ্ত কাজ হাতে রেখেই তিনি পরপারে চলে গেলেন।
সঙ্গীত জগতে এত এত কাজ করেও তাঁর মত শিল্পী জনপ্রিয়তার উর্দ্ধ শিখরে পৌঁছতে পারেননি। তাঁর কারণ যতটুকু জানা যায়, শশী জাফর যখনই কোনো মই পেয়েছে উপরে উঠার ঠিক তখনই কোনো না কোনো অদৃশ্য হাত সেই মই টেনে ধরেছে! যা কিনা শশী জাফরের পক্ষে মেনে নেয়া খুবই কষ্টকর ছিল। অপরদিকে আরও জানা যায় যে, সে যেহেতু ছিল বন্ধুবৎসল এবং স্নেহপরায়ণ সেহেতু অনেকেই তাঁর কাছ থেকে বহু উপকার পেয়েও তাঁর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে কার্পণ্য করেনি। সেই কষ্টেই উনি প্রচারের অন্তরালে থাকতেন। তবে তাঁর গানের কিছু নিজস্ব শ্রোতা ও ভক্ত আছেন, যারা তাঁর গানকে মনেপ্রাণে ধরে রাখবেন। ‘মৌলিক বার্তা পরিবার এ্যাওয়ার্ড, ২০১৬’ মৌলিক বার্তা পত্রিকা থেকে তাঁকে দেয়া হয়। এটাই ছিল সম্ভবত সঙ্গীত জগত থেকে তাঁর শেষ অর্জন।
সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে শিল্পী শশী জাফর-এর জন্য রইল, শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা। তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন, এই কামনা করি। সেই সাথে সকলের কাছ থেকে এই কামনা করি, আমরা যেন বেঁচে থাকতেই সকল মানুষের কাজের মূল্যায়ন করতে পারি।