– রহমান ফাহমিদা, সহকারী-সম্পাদক।
পৃথিবীর আকাশে যেমন অজস্র তারা তাদের নিজস্ব আলোয় আলোকিত করছে পৃথিবীকে তেমনই এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের আকাশেও অনেক তারার আবির্ভাব হয়েছে, যারা সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁদের নিজ নিজ গণ্ডিতে আলোকিত করে যাচ্ছে অনবরত। সেই আকাশের এক তারা ছিলেন সরোদবাদক ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান। দেশ-বিদেশে যার সরোদের ঝংকারে মূর্ছিত হয়েছিল সঙ্গীতাঙ্গন। ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের আকাশ থেকে সেই তারা ঝরে গিয়েছিল আজ থেকে ছয় মাস আগে (২৮/১১/২০২০)। তিনি তাঁর অসংখ্য ভক্ত ও সঙ্গীতানুরাগীদেরকে শোক ও বেদনার সাগরে ভাসিয়ে অকালে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন।
আজ তাঁর ৬৩তম জন্মদিন। সরোদবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান, ৬ই জুলাই ১৯৫৮ সালে কুমিল্লা জেলার নবীনগরে জন্মগ্রহণ করেন। এমন একটি সঙ্গীত পরিবারে তাঁর জন্ম! যে পরিবারের প্রায় সকলেই সারা পৃথিবীতে সঙ্গীতের উচ্চতর শিখরে অধিষ্ঠিত। সেই পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও তাঁর মধ্যে তেমন কোনো অহংকার বা অহমিকা ছিল না। সকলের সাথেই হাসিমুখে কথা বলতেন। আমি কখনোই দেখিনি তাঁকে হাসিমুখ ছাড়া। একজন অমায়িক মানুষ ছিলেন তিনি। আমি তাঁর বেশ কিছু সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ হয়ে। তাঁর শেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম তাঁর বাবার মৃত্যুবার্ষিকীতে (২৯ এপ্রিল,২০২০)। আজকে তাঁর এই জন্মদিনে মনে পড়ছে তাঁর সাথে সাক্ষাৎকার নেয়ার সময়ের কিছু কথা!
সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ হতে আমার নেয়া তাঁর প্রথম সাক্ষাৎকারের হেডিং ছিল- ‘বঙ্গবন্ধুকে দেয়া কথা রাখার জন্যই দেশে ফিরে আসি…ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান’। আমি লিখেছিলাম ‘পৃথিবীর আকাশে যেমন অজস্র তারা তাদের নিজস্ব আলোয় আলোকিত করছে পৃথিবীকে তেমনই এই উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের আকাশেও অনেক তারার আবির্ভাব হয়েছে, যারা সঙ্গীতাঙ্গনে তাঁদের নিজ নিজ গণ্ডিতে আলোকিত করে যাচ্ছে অনবরত। সেই আকাশের এক তারা সরোদবাদক ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান’। কষ্টের ব্যাপার তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে আমাকেই লিখতে হয়েছিল- ‘আজ ২৮/১১/২০২০ তারিখে সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের আকাশ থেকে সেই তাঁরাও ঝরে পড়ে গেল! দেশ-বিদেশে যার সরোদের ঝংকারে মূর্ছিত হয়েছিলেন যে সঙ্গীতাঙ্গন। আজকে থেকে তাঁরা সেই সরোদের ঝংকার আর শুনতে পাবে না। আর মুখরিত করে রাখবেন না তিনি সরোদের মঞ্চ। তবে বাজবে তাঁর সরোদের ঝংকার সকল সঙ্গীতপিপাসুর মনে প্রাণে’।
শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান-এর সাথে আমার সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে শেষ সাক্ষাৎকার ছিল, তাঁর বাবা শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান-এর মৃত্যুবার্ষিকীতে। সেদিন সে অনেক কথা আমার সাথে শেয়ার করেছিলেন এবং আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন তাঁর বাবার কথা বলতে বলতে! কিছু কথা সবার সাথে শেয়ার করছি। সেই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাবা বলতেন, আগে লেখাপড়া পরে গান-বাজনা’। তিনি আরও বলেছিলেন যে, তাঁর বাবা, কখনোই তাঁর গায়ে হাত তুলতেন না এবং সেই সুযোগ তাঁর বাবা কখনোই পাননি কারণ বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে তিনি ভয় পেতেন খুব। তাই কখনই তেমন বেয়াদবই করেননি যে, বাবা তাঁর গায়ে হাত তুলবেন।
পরবর্তীতে অবশ্য তাঁরা দু’জন বন্ধুর মত হয়ে গিয়েছিলেন এবং সব বিষয় একে অপরকে শেয়ার করতেন। সেদিন একটি কথা বলতে গিয়ে শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান-এর গলা অনেকটা ভারি হয়ে গিয়েছিল! আমি বুঝতে পারছিলাম, যে মুহূর্তের কথা তিনি আমার সাথে শেয়ার করছিলেন সেই মুহূর্তটা হয়তো তাঁর চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল। আজকে তাঁর জন্মদিনে সেই মুহূর্তের কথাটি সবার সাথে শেয়ার না করে পারছি না! সে কথাগুলো বলেছিলেন এভাবে- ‘সঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রদত্ত ‘একুশে পদক’ লাভ করি। ঐ দিন বাবা আমাকে ধরে কেঁদে দিয়েছিলেন আর বলছিলেন, এটাই আমার জীবনের সার্থকতা! আমি যে দেখে যেতে পারলাম, তোমার এই সম্মামনা। আর কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, এটা আমার বড় পাওনা। এখন আর আমার কোনো দুঃখ নেই। আমি যা আশা করেছিলাম তা সবই তোমার কাছ থেকে পেয়েছি’।
আমার খুব কষ্ট হয় এই ভেবে যে, এই সাক্ষাৎকার নেয়ার মাত্র ছয় মাস পরেই তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তিনি বলেছিলেন আমাকে, তাঁর অনেক কথা আমাকে বলবেন এই সঙ্গীতাঙ্গন-এর মাধ্যমে যা কখনই কাউকে বলেন নি! আমাদের ভাগ্য খারাপ যে, তাঁর না বলা কথাগুলো আর জানা হলো না এবং লিখতে পারলাম না।
আজকে তাঁর জন্মদিনে তাঁকে স্মরণ করে উদযাপন করা হচ্ছে নবগঠিত ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান সংগীত ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে। এই উপলক্ষে সংগীত ও কথামালার এক লাইভ ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে এই ফাউন্ডেশন। অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করবেন বিশ্ববিখ্যাত সরোদবাদক ও সংগীতজ্ঞ ওস্তাদ আশীষ খান। আরও রয়েছে ওস্তাদ ইউসুফ খান (তবলা), আফসানা খান (সেতার), রুখসানা খান (সরোদ), জাকির খান (তবলা), তানিম হায়াত খান রাজিত (সরোদ) প্রমুখ।
তাঁর শিষ্য ও পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে, পারভেজ খান (সরোদ), মুরসালিন হিমু (সেতার), খাজা মোঃ মাসুম বিল্লাহ(বাঁশি), পৃথুল অর্ণব(সরোদ)প্রমুখ।
কথামালায় অংশ নিবেন ওস্তাদ আশীষ খান, কবি আলফ্রেড খোকন, সেতার বাদক অধ্যাপক রিনাত ফৌজিয়া ও মনিরুল ইসলাম।
সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন-এর জন্য রইল জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি ও ভালোবাসা। তিনি যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আল্লাহ্ তাঁকে জান্নাতবাসী করুন, আমীন।