– মোঃ এরশাদুল হক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।
ভোর হলো
দোর খোলো
খুকুমণি ওঠ রে!
ঐ ডাকে
জুঁই-শাখে
ফুল-খুকী ছোট রে!
খুকুমণি ওঠ রে! (প্রভাতী)
জনপ্রিয় এই কবিতাটির সঙ্গে আমাদের কম-বেশি সকলেরই স্মৃতি জড়িত। কবি নজরুল আজন্ম শিশু মনকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন- “আমি শিশু, আমি কিশোর।” কবি নিজেকে শিশু-কিশোর ভেবেছেন বলেই শিশুসাহিত্য রচনা করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি উপলব্ধি করেছেন, শিশু মন অতিমাত্রায় খেয়ালি, স্বপ্নময় এবং কল্পনাপ্রবণ। কল্পনায় সে রথে চড়ে সূর্যিমামার আগে যেতে চায়। এজন্যই কবি তাঁর কবিতায় বলেছেন-
আমি হবো সকাল বেলার পাখি
সবার আগে কুসুম বাগে
উঠবো আমি ডাকি।
শিশুর মনের সাথে একাত্ম না হলে কিংবা শিশু-ভাবে ভাবিত হতে না পারলে শিশুসাহিত্য রচনা কখনই সম্ভব নয়। শুধু তাই নয়, তাঁর মন ছিলো শিশুর প্রতি আশ্চর্য রকম সংবেদনশীল। এজন্যই হয়তোবা তিনি খুব সহজে শিশুদের সাথে একাত্ম হতে পেরেছেন এবং শিশুদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে সক্ষম হয়েছেন। তাইতো তিনি শিশুর সাধ-স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্ক্ষা, হাসি-তামাশা, অনুকরণ প্রিয়তা, স্কুল জীবনের অভিজ্ঞতা, বাবা-মায়ের সাথে মান-অভিমান, বুড়ো দাদুকে নিয়ে হাস্যালাপ, অচিনপুরে দুঃসাহসিক অভিযান প্রভৃতি গভীরভাবে অনুধাবন করে সাহিত্যে রূপদান করেছেন। এছাড়াও তিনি অনুভব করেছেন, শিশুর জগৎ মাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। তাই শিশুর সকল চাওয়া-পাওয়া, মান-অভিমান মার কাছেই। শিশু অবাক বিস্ময়ে মাকে প্রশ্ন করে-
মাগো! আমায় বলতে পারিস
কোথায় ছিলাম আমি
কোন না জানা দেশ থেকে তোর
কোলে এলাম নামি ?
মাও শিশুকে ভালোবেসে উত্তর দেয়
তুই যে আমার, এই ত সেদিন
আমার বুকে ছিলি!
মা ও সন্তানের মধ্যে যে মধুর সম্পর্ক তারই চমৎকার বর্ণনা ফুটে উঠেছে উদ্ধৃত কবিতায়। এখানে বাৎসল্য রসের চরম সমন্বয় অনুসৃত হয়েছে। পাশাপাশি কবি একজন শিশুর দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা দিয়েছেন কবিতার বাণী ভঙ্গিমায়-
পাতাল ফেড়ে নামব নিচে
উঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে।
কাজী নজরুল ইসলামের বহুল প্রচলিত ছড়া, কবিতার বাইরেও স্বল্পপরিচিত শিশুসাহিত্য নিয়ে কাজ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ছায়ানট (কলকাতা)। এ কাজটির প্রসঙ্গে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সোমঋতা মল্লিক বলেন- “বর্তমান প্রজন্মের শিশু-কিশোররা একান্নবর্তী পরিবারের সদস্য না হওয়ায় ঠাকুমা কিংবা দিদিমার কণ্ঠে ছড়া, কবিতা শোনার সুযোগ থেকে বঞ্চিত।
সেইসব শিশু-কিশোরদের কথা ভেবেই ছায়ানট কলকাতার এই বিশেষ উদ্যোগ। এখানে কাজী নজরুল ইসলামের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ কল্যাণী কাজীকে ঠাকুমা কিংবা দিদিমা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। কল্যাণী কাজী জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী হলেও আমরা তাঁকে বাচিকশিল্পে বিশেষভাবে পাইনি। তাঁর এই উপস্থাপনায় নেই কোনো কৃত্রিমতা কিংবা আতিশয্যের বাড়াবাড়ি। তিনি অতি সহজ-সরল ভঙ্গিমায় আন্তরিকতার সঙ্গে আবৃত্তি করেছেন ছড়া, কবিতাগুলো।
তাঁর কন্ঠে মোট ২৫টি ছড়া, কবিতা ধারণ করা হয়। এগুলোর মধ্যে -চিঠি, ঘুম পাড়ানী গান, প্রভাতী, কালো জামরে ভাই, শিশু সওগাত, প্রার্থনা, বাংলা মা, খুকুমণি, আঁধারে, ভাই, আর্শীবাদ, পুতুল খেলা, মাতৃ-বন্দনা, প্রজাপতি, ক্ষমা কর হজরত, আমি যদি বাবা হতাম, নতুন পথিক, ঘুম জাগানো পাখি উল্লেখযোগ্য।”
ছায়ানট কলকাতার মহৎ এ কাজে কল্যাণী কাজীর অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ছড়া, কবিতাগুলো আবৃত্তি করতে গিয়ে অতীত স্মৃতি রোমন্থন করেছেন এভাবে-
“জ্ঞান হবার পর থেকে পড়াশোনার সাথে সাথে নাচ, গান, আবৃত্তির প্রতি আগ্রহ জন্মায়। বাবা-মার একমাত্র সন্তান, তাই বাধ্যবাধকতা ছিল না। মনে পড়ে, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় নাম দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার করি। কাজী নজরুল ইসলাম রচিত জনপ্রিয় কবিতা ‘প্রভাতী’ আবৃত্তি করি। এমন সুন্দর ছন্দের কবিতা আগে পড়িনি। সেদিন থেকে কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে ওঠেন আমার প্রিয় কবি।
পরবর্তীকালে আমার আগ্রহ জন্মালো গানের প্রতি। গুরু হিসেবে পেলাম শ্রদ্ধেয় শিল্পী শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র এবং শ্রী দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়কে। শ্রী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র ছিলেন কাজী নজরুল ইসলামের প্রিয় শিল্পী এবং শিষ্য। তিনি আমাকে প্রথম যে গানটি শিখিয়েছিলেন তার প্রথম লাইনটি হলো- ‘আজো কাঁদে কাননে কোয়েলিয়া’। হাম্বীর রাগাশ্রিত এই গানটির রচয়িতা এবং সুরকার হলেন কাজী নজরুল ইসলাম।
কালক্রমে নজরুলের কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধের সঙ্গে গানের ভিতর দিয়ে প্রথমে পরিচয়, পরে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হলাম। আমিই এই বাড়ির প্রথম পুত্রবধূ। শ্বশুর বাবা এবং শাশুড়ি মা দুজনেই অসুস্থ। পরিবারে প্রাচুর্য ছিলো না, কিন্তু আনন্দ ছিলো। শ্বশুর বাবা মানসিকভাবে অক্ষম হলেও শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন। সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতেন। আবার ক্লান্ত হলে তাঁর জন্য নির্দিষ্ট শোয়ার জায়গায় শুয়ে পড়তেন। শাশুড়িমার শরীরের নিচের অংশ কোমর থেকে অবশ হয়ে গিয়েছিল। শরীরের ওপরের অংশ সুস্থ ছিলো। স্বল্প উঁচু একটা চৌকিতে শুয়ে পাশ ফিরে অদ্ভুত প্রক্রিয়ায় বাবাকে খাইয়ে দিতেন, সব্জি কাটতেন, আমাদের খেতে দিতেন। শ্বশুর বাবা যখন হারমোনিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাসি মুখে শব্দ করে তাকাতেন তখন বুঝতাম গান শুনতে চাইছেন। গান শুরু করলে শব্দ করে হাসতেন।
এভাবে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। অকালে আমাদের ছেড়ে মহাপ্রস্থানের পথে রওনা দিলেন আমার স্বামী অনিরুদ্ধ। তিন পুত্রকন্যা- অনির্বাণ, অরিন্দম, অনিন্দিতাকে নিয়ে বেশ বিপাকে পড়লাম। নজরুল সংগীতকে অবলম্বন করে জীবন যুদ্ধে নতুন করে যাত্রা শুরু করলাম।
আজ ছেলে-মেয়েরা নিজেদের দায়িত্ব পালনে সক্ষম। নাতি-নাতনিরাও তাদের কর্মজীবন নিয়ে ব্যস্ত। এই ৮৫ বছর বয়সে বড় একা লাগছিল। এমন সময় ছায়ানট কলকাতার কর্ণধার সোমঋতা আমার কাছে প্রস্তাব নিয়ে এলো কাজী নজরুল ইসলামের শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা বেশকিছু জনপ্রিয় ও স্বল্পপরিচিত ছড়া, কবিতা রেকর্ড করার জন্য। ছায়ানট (কলকাতা) দীর্ঘদিন ধরে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টিকর্মকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দেবার উদ্দেশ্যে বেশকিছু কাজ করে চলেছে। এই কাজের সঙ্গে আমিও ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ায় কাজটি করতে রাজী হয়ে গেলাম। ঘুম পাড়ানী গান, প্রভাতী, কালো জামরে ভাই, শিশু সওগাত, প্রার্থনাসহ মোট পঁচিশটি ছড়া, কবিতা আমার কণ্ঠে রেকর্ড করেছি। আমি উপলব্ধি করলাম শিশুসাহিত্য রচনায় বাবা শ্বশুরের কি সহজ, স্বচ্ছন্দ বিস্তার। প্রথমে ভয় পেলেও পরে নির্বাচিত ছড়া এবং কবিতাগুলো আবৃত্তি করতে গিয়ে ছোট্ট সোনামণিদের হাসি মুখগুলো মনে পড়ায় প্রেরণা পেলাম। ওরা খুশি হলে- সেটাই আমার পরম প্রাপ্তি। অভিভাবকদের মাধ্যমে এ কাজটি বাচ্চাদের কাছে পৌঁছে যাবে- এ বিশ্বাস আমার আছে।”