– মোশারফ হোসেন মুন্না।
কোনো কাজ করতে করতে একঘেয়েমি চলে এসেছে? ঠিক আছে, এবার তাহলে একটু গান শোনা যাক! কোনোকিছুই ভালো লাগছে না? হঠাৎ করেই কীভাবে যেন গলা থেকে বেরিয়ে আসে সুর, হোক না সেটা বিরহের! মনে খুব আনন্দ ? বাজাও হৈ-হুল্লোড়ের গান! গান এমন এক জিনিস, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। খালি গলায় কিংবা কোনো যান্ত্রিক মাধ্যমে, কোনো না কোনোভাবে গানের সাথে আমরা আছিই। দেশী-বিদেশী মিলিয়ে অনেকের পছন্দের শিল্পীর তালিকাটিও কম লম্বা নয়।
শুধু আমরা কেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরাও তো একইভাবে গানে মজে ছিলেন। একবারও কি আপনি ভেবেছেন, এই গান, এই সুর এলো কোথা থেকে ? ব্যস্ত ও গতিময় নাগরিক জীবনে এটা নিয়ে ভাববার সময় আপনার-আমার না হলেও প্রাচীন পৃথিবীর মানুষেরা কিন্তু এটা নিয়ে ঠিকই ভাবতো। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে গানের উৎপত্তির ধারণা নিয়েই এখন চলুন জানা যাক।
১। অ্যাজটেক সংস্কৃতিঃ
অ্যাজটেক সভ্যতার লোকেরা বিভিন্ন দেব-দেবীতে বিশ্বাসী ছিল। এদের মাঝে আকাশ ও বাতাসের দেবতা হিসেবে তারা যে দুজনকে মান্য করতো, তাদের নাম ছিলো যথাক্রমে টেজকাটলিপোকা এবং কোয়েটজাল্কোয়াট্ল।
কোয়েটজাল্কোয়াট্ল আবার একইসাথে জ্ঞানের দেবতাও ছিলো। এ দুই দেবতার মাঝে ছিলো অনেকটা খুনসুটির সম্পর্ক; কখনো মিঠা, কখনো ঝাঁঝাল।
“একদিনের কথা, কোয়েটজাল্কোয়াট্ল তখন বসে বসে পৃথিবীতে ঘূর্ণীঝড় তৈরি করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ করে টেজকাটলিপোকার নজরে এলো যে, দুনিয়াতে আসলে সুর কিংবা সঙ্গীত বলে কিছু নেই! এমন এক দুনিয়াকে
তার কাছে নিঃশব্দে পরিপূর্ণ বলেই ঠেকলো। সাথে সাথেই টেজকাটলিপোকার মাথায় এমন পরিকল্পনা খেলে গেলো যেন দুনিয়ার মানুষকে সঙ্গীতের স্বাদ উপহার দেয়া যায়। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তার ভাই কোয়েটজাল্কোয়াট্লকে দিয়ে সূর্যের কাছ থেকে নিয়ে আসবেন সঙ্গীত!
দীর্ঘ, ক্লান্তিকর এক ভ্রমণের পর কোয়েটজাল্কোয়াট্ল অবশেষে সূর্যের বাড়িতে গিয়ে পৌঁছান। সেখানে পৌঁছামাত্রই সঙ্গীতের সুমধুর মূর্ছনা তার ক্লান্তি নিমেষেই দূর করে দেয়। বাতাস ও জ্ঞানের দেবতার সামনে সূর্য তার শিল্পীদের গান থামাতে বলে। সূর্য ভয় পেয়েছিলো এই ভেবে যে, হয়তো কোয়েটজাল্কোয়াট্ল তার শিল্পীদের পৃথিবীতে ধরে নিয়ে যাবে, হলোও ঠিক তা-ই। কোয়েটজাল্কোয়াট্লের শক্তি দেখে শিল্পীরা আর কোনো প্রতিবাদ করতে সাহস পেলো না। তারা পৃথিবীতে যেতে রাজি হলো।
যখন এই শিল্পীদের নিয়ে কোয়েটজাল্কোয়াট্ল পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছান, তখনই গাছে ফুল ফুটতে শুরু করে, ফলগুলো পাকতে শুরু করে; দেখে মনে হয় যেন দীর্ঘ এক নিদ্রার পর আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠছে এই ধরণী।
এভাবেই পৃথিবীতে সঙ্গীতের সূচনা করে দিয়ে সুখে-শান্তিতে আজও নিজেদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন আকাশ ও বাতাসের দেবতা।
২) গ্রীক সংস্কৃতিঃ
মূলত দেবতাদের দূত হিসেবে কাজ করা হার্মিস নিজেও ছিলেন চৌর্যবৃত্তি, ব্যবসা-বাণিজ্য এবং সাহিত্যের দেবতা। শৈশবে একবার তিনি তাকে আটকে রাখা বাঁধন ছিড়ে চলে গিয়েছিলেন তার ভাই অ্যাপোলো যেখানে নানা পশু
চড়াচ্ছিলেন, ঠিক সেখানে। এরপর শুরুতে কিছুক্ষণ ভাইকে তার কাজে সাহায্য করলেও পরবর্তীতে সেখান থেকে একটি কচ্ছপ ধরে সেটিকে হত্যা করেন হার্মিস। এরপর সেই কচ্ছপের খোলসটিকে পরিপূর্ণ রুপে পরিষ্কার করে নেন তিনি। পরে অ্যাপোলোর গরুর নাড়িভুঁড়ি ব্যবহার করে সেই খোলককে তিনি একটি বীণায় রূপান্তরিত করেন! প্রাচীন গ্রীকরা ধারণা করতো, দেবতা হার্মিসই বিশ্বের প্রথম বীণাটি তৈরি করেছিলেন। পরবর্তীতে যখন তাকে পশুহত্যার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলো, তখন তিনি বীণায় এত চমৎকার সুর তুললেন যে, অ্যাপোলো সেই বীণার বিনিময়ে নিজের পশুগুলোই দিয়ে দিলেন হার্মিসকে। বীণার পাশাপাশি বাঁশি ও প্যানপাইপ উদ্ভাবনের কৃতিত্বও হার্মিসকে দিতো গ্রীকরা।
গ্রীক মিথলজিতে সঙ্গীতের সাথে জড়িত আরেক গুরুত্বপূর্ণ যে ব্যক্তির কথা এসেছে, তিনি অর্ফিয়াস। তাকে ‘সঙ্গীতের জনক’ও বলা হয়ে থাকে। অ্যাপোলোর কাছ থেকে বীণা পেয়ে তিনি এতটাই চমৎকারভাবে সেটি বাজাতে শুরু করেন যে গাছপালা, পশুপাখি, এমনকি নিরেট পাথরও নাকি তার সুরে অভিভূত হয়ে নাচতে শুরু করে দিয়েছিলো। মৃত্যুর পর তার সেই বীণাকে স্বর্গের মাঝেই রেখে দেয়া হয় একটি নক্ষত্রপুঞ্জ হিসেবে। সেখানে থেকেই সেই বীণা সুর তুলে যাবে অনন্তকাল।
৩) রোমান সংস্কৃতিঃ
সূর্য, সত্য, চিকিৎসা ও সঙ্গীতের দেবতা হিসেবে অ্যাপোলোর পূজা করতো প্রাচীন রোমের অধিবাসীরা। অ্যাপোলোর ‘সঙ্গীতের দেবতা’ হবার কাহিনীটা অবশ্য বেশ অদ্ভুত। তার বয়স যখন মাত্র চারদিন, তখন পার্নাসাস পর্বতে বাসকারী এক সাপের সাথে ভয়াবহ যুদ্ধ বেঁধে যায় তার। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সাপটিকে লক্ষ্য করে একটি তীর ছুঁড়ে মারে শিশু অ্যাপোলো। সেই তীরের আঘাতেই ইহলীলা সাঙ্গ হয় বেচারার। বিজয়ানন্দ উদযাপন করতে এরপর
নিজের বীণায় সুর তুলে গান গাইতে শুরু করে অ্যাপোলো। তার গান সেদিন দেবতা জিউসের এতটাই ভালো লেগে গিয়েছিলো যে, তৎক্ষণাৎ তিনি তাকে ‘সঙ্গীতের দেবতা’ করে দেন! অন্তত এমনটাই বিশ্বাস করতো প্রাচীন রোমানরা। অবশ্য নিজের সঙ্গীত দক্ষতা রক্ষা করতে সময়ে সময়ে পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়েছে অ্যাপোলোকে। একবার মার্সিয়াস নামক স্যাটার অ্যাপোলোকে সঙ্গীতের প্রতিযোগিতায় আহ্বান জানিয়েছিলো। এতে জয় হয় অ্যাপোলোর। এরপর মার্সিয়াসকে শাস্তি দিতে তাকে একটি পাইন গাছে ঝুলিয়ে জীবন্ত চামড়া ছিলে নেয়া হয়েছিলো।
৪) জাপানী সংস্কৃতিঃ
জাপানের শিন্তো ধর্মাবলম্বীরা উজুমিকে চেনে আনন্দ, উচ্ছ্বলতার প্রতীক হিসেবে। সঙ্গীতের উৎপত্তির সাথে তার নাম জড়ানোর কাহিনী বেশ চমৎকার। এর সাথে জড়িয়ে আছে সৌর দেবী আমাতেরাসুর নামও।
ঝড়ের দেবতা সুসানুর উপর রাগ করে একবার আমাতেরাসু গিয়ে বসে রইলেন এক গুহার মধ্যে। এদিকে তার অনুপস্থিতিতে পুরো সৃষ্টিজগত অন্ধকারে ঢেকে গেলো, বন্ধ হয়ে গেল খাদ্যশস্যের উৎপাদন। দেবতারা সবাই প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন আমাতেরাসুর অভিমান ভাঙাবার, কিন্তু ব্যর্থ হলেন প্রত্যেকেই। এমন সংকটময় পরিস্থিতি থেকে সৃষ্টিজগতকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেন উজুমি। তিনি সারা গা মস ও গাছের পাতা দিয়ে ঢেকে চলে যান আমাতেরাসুর গুহার সামনে। এরপর সেখানে তিনি অনবরত গান গাইতে থাকেন, সাথে চলতে থাকে তার নাচ। একসময় হঠাৎ করে তার ছদ্মবেশ খুলে যায়, দেবতারা তার আসল রুপ জানতে পেরে কর্কশ কণ্ঠে অট্টহাসি শুরু করে। তাদের সেই হাসি শুনে কৌতূহলবশত গুহা ছেড়ে বেরিয়ে আসেন আমাতেরাসু। আর এভাবেই ভয়াবহ এক সংকট থেকে রক্ষা পায় পুরো সৃষ্টিজগত!
৫) মিশরীয় সংস্কৃতিঃ
লেখালেখি কিংবা গণনায় ব্যস্ত হিসেবে চিত্রায়িত ঠথকে প্রাচীন মিশরের অধিবাসীরা জ্ঞানের দেবতা হিসেবে মানতো। মানবদেহ ও আইবিস পাখির মাথাবিশিষ্ট ঠথের হাতে লেখালেখির জন্য সবসময় কলম ও বোর্ড থাকতোই!
খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে গ্রীক ইতিহাসবিদ ডিওডোরাস সাইকালাস ঠথকে প্রথম বীণা তৈরির কৃতিত্ব দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, প্রাচীন মিশরের বীণাগুলো তিন তার বিশিষ্ট ছিলো, যা মিশরের তিনটি ঋতুকে প্রতিনিধিত্ব করতো।
ঠথ কীভাবে বীণাটি বানিয়েছিলেন তা শুনলে বেশ মজাই পেতে হবে। একদিন দেবতা ঠথ নীল নদের তীর ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন। সামনে পড়েছিলো মৃত একটি কচ্ছপের শুকিয়ে যাওয়া খোলস। হঠাৎ করে তার মনের মাঝে কী খেয়াল চাপলো কে জানে, তিনি সজোরে লাথি বসিয়ে দিলেন সেই খোলসে!
লাথি দেয়ার পর খোলস থেকে যে শব্দ বেরোলো তা শুনে বেশ ভালো লেগে যায় ঠথের। তাই তিনি খোলসটা আবার কুড়িয়ে আনেন। এরপর বিভিন্ন প্রাণীর নাড়িভুঁড়ি তাতে লাগিয়ে তিনি তৈরি করেন সুমধুর সুর সৃষ্টিকারী এক বীণা!
৬) চীনা সংস্কৃতিঃ
চীনা ধর্ম হিসেবে পরিচিত চীনের হান জনগোষ্ঠীর মেনে চলা ধর্মবিশ্বাসে এক দেবতা ছিলেন হুয়াংদি। উপকথা থেকে জানা যায়, একবার তিনি লিং লুন নামক এক ব্যক্তিকে নির্দেশ দিয়েছিলেন সুরসৃষ্টির জন্য। দেবতার কাছ থেকে এমন নির্দেশ পেয়ে লিং লুন একটি বাঁশি বানালেন। কিন্তু ওতে সুর ঠিকমতো তৈরি হতো না। এমনকি একবার হুয়াংদি যখন লিং লুনের বাড়ির পাশে দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন, তখন লুনের বাঁশির শব্দ শুনে ঘোড়াটি চমকে উঠে পা ছোড়াছুঁড়ি শুরু করে দেয়। এতে ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে যান দেবতা নিজেই! এমন ঘটনায় লজ্জায় দেবতার পায়ে গিয়ে পড়েন লিং লুন। তার মৃত্যু অনিবার্য ভেবে নিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু হুয়াংদি দয়াপরবশ হয়ে লিং লুনকে তার কাজ চালিয়ে নিতে বলেন। এভাবে বাঁশি উন্নততর করার চেষ্টা করতে করতে একদিন তিনি ফিনিক্স পাহাড়ে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে নারী ও পুরুষ ফিনিক্স পাখিদের সুমধুর কণ্ঠ শুনে তাদের সুরের সাথে মিলিয়ে বাঁশিতে বানান তিনি। এভাবেই প্রাচীন চীনের কিংবদন্তীতে ‘সুরের প্রতিষ্ঠাতা’ হিসেবে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন লিং লুন।
সঙ্গীতাঙ্গন এর সাথে থাকুন আর মজার কিছু কথা জানুন।