– মরিয়ম ইয়াসমিন মৌমিতা।
আইয়ুব বাচ্চুর মরদেহ পৌঁছানোর আগে ভক্তরা পৌঁছে গিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে। দূর-দূরান্ত থেকে শোকাহত ভক্তরা এসেছিলেন প্রিয় শিল্পীকে শেষ বিদায় জানাতে। শ্রদ্ধা নিবেদনের বেদি থেকে ভক্তদের সারি
চলে গিয়েছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রধান ফটক ছাড়িয়ে আরও খানিকটা দূরে। সারিতে দাঁড়ানো অনেকেই চোখ মুছছিলেন বারবার। একজনের বন্ধু বলছিল, এত লোকের সামনে কাঁদতে লজ্জা করে না ? তাঁর হাতে একটা লাল গোলাপ। কেন কাঁদছিলেন? জানতে চাইলে ভেতরে আটকে রাখা বাকি কান্নাটুকু মুক্ত করে দেন তিনি। কান্নার ওপারে কান পাতলে শোনা গেল, এবির গান শুনেই আমরা বড় হয়েছি। তিনি আমাদের যে গানগুলো দিয়ে গেছেন,
সেগুলো শুনলেই এখন থেকে কান্না পাবে। ভিড়ের ভেতর কালো পাঞ্জাবি পরা নকিব খানকে ঘিরে রেখেছিলেন কয়েকজন ‘ইউটিউবার’। সোলস ব্যান্ডে তাঁরাই নিয়েছিলেন আইয়ুব বাচ্চুকে। তারপর পশ্চিমা ও মেলোডির মেলবন্ধনে দারুণ সব কাজ উপহার দিয়েছিলেন তিনি। নকিব খান সোলস ছাড়ার পর বাচ্চু দলটির হয়ে দুটো অ্যালবামের কাজ করেছেন। তাঁর বিদায়ে ব্যথিত নকিব খান বললেন, বাচ্চু মাত্র ১০ বছর ছিল আমাদের দলে। তারপর নিজের ব্যান্ড নিয়ে কাজ শুরু করে সে। তাকে দেখে নতুন প্রজন্মের শেখা উচিত, ডেডিকেশন থাকলে অল্প সময়ে মানুষ কোথায় পৌঁছে যেতে পারে।
প্রিয় শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে ভক্তদের ভিড় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সঙ্গে শিল্পী আইয়ুব বাচ্চুকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর আয়োজনে উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু। ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এসে তিনি বললেন, বাচ্চু তরুণদের জন্য সঙ্গীতের ভাষা তৈরি করে গেছেন। সে জন্য আজ তাঁকে শ্রদ্ধা ও শোক নিয়ে স্মরণ করছে তরুণেরা। তিনি বাংলা সঙ্গীতভুবনে অমর হয়ে থাকবেন।
এক তরুণীর দেখা মিলল, দূরে দাঁড়িয়ে যিনি চোখ মুছছিলেন। মনে হলো আত্মীয়দের কেউ। তিনি জানান, হ্যাঁ, পরম আত্মীয়। তিনি আইয়ুব বাচ্চুকে শৈশব থেকে চেনেন-জানেন। তিনি আইয়ুব বাচ্চুকে ভালোবাসেন। শিল্পী তাঁকে
মগবাজারের স্টুডিওতে আমন্ত্রণ জানাতেন প্রায়ই, সব সময় সদুপদেশ দিতেন। একবার ছোট ভাইয়ের লিভার সিরোসিস হলে সেই সংকটের কথা ভাগাভাগি করেছিলেন। আইয়ুব বাচ্চু বলেছিলেন, একটা কনসার্টের আয়োজন
করো। আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে গান করব। টাকা নেব না। সেই কনসার্ট থেকে তোলা টাকায় তোমার ভাইয়ের লিভার বদল করা হবে।
সবাই বলছে, মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় এসেছিলেন। কেউ বলছে না, একজন শিল্পী হয়ে ওঠার জন্য এক বুক স্বপ্ন নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় এসেছিলেন। কেউ বলছে না, অভাবনীয় মেধা ও প্রতিভা সঙ্গে নিয়ে
আইয়ুব বাচ্চু ঢাকায় এসেছিলেন। বাংলা ভাষা–সাহিত্য–সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দেওয়ার কেন্দ্রস্থল ‘ঢাকা’য় আইয়ুব বাচ্চু এসেছিলেন তাঁর নিয়ে আসা আলো ছড়িয়ে দিতে। আলো ছড়ানো শেষ। আলো ছড়ানোর জন্য পুড়ে পুড়ে মোমকে গলতে হয়। তাতে হয়তো কিছুটা যন্ত্রণা থাকে। আইয়ুব বাচ্চু কিছুটা যন্ত্রণা নিয়ে চলে গেলেন। বলে রেখেছিলেন, এই বুকে যন্ত্রণা, বেশি সইতে পারি না/ আরো বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে। তিনি উড়াল দিয়েছেন
পৃথিবী ছেড়ে।
ব্যান্ড জগতের আরেক কিংবদন্তি নগর বাউল জেমস। আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যুর খবর যখন শুনেন সকালে, তখন রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন মেলায় যোগ দিতে জেমস বরগুনার পথে। সেখান থেকেই জানান কিংবদন্তী তারকার মৃত্যুতে গভীর শোক। সঙ্গে আসতে না পারার আক্ষেপ ও ক্ষোভ। তবে জানিয়ে দিয়েছিলেন সন্ধ্যায় যখন মঞ্চে নামবেন আইয়ুব বাচ্চুকে স্মরণ করে উৎসর্গ করবেন কনসার্টটি। সন্ধ্যায় মঞ্চে পা রাখেন জেমস। মঞ্চে নেমেই কনসার্টটি উৎসর্গ
করেন প্রয়াত আইয়ুব বাচ্চুকে। তবে তা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। নিজের আবেগকে কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে বলেন, আজকের অনুষ্ঠান হোক এটাই আমি চাচ্ছিলাম না। কিন্তু বাচ্চু ভাইয়ের একটা কথা মনে পড়ে গেল। একটা গল্প বলি, অনেক আগে একটা শোতে হাস্যোজ্জ্বল বাচ্চু ভাই বলেছিলেন, যাই হোক শো ইজ মাস্ট অন। আজো অন, আমি চেষ্টা করছি। নগরবাউল জেমসের কান্নার ভিডিও মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে। সেই সঙ্গে জেমসের কান্নায় আবার ভেঙ্গে পড়ে গোটা বাংলাদেশ।