– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
গতকাল ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটার সময় বাংলাদেশের যন্ত্র সংগীতের তিন বরেণ্য শিল্পী যথাক্রমে – ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ ও ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের স্মরণে বাংলাদেশ শিল্পকলা
একাডেমির সংগীত ও নৃত্যকলা মিলনায়তনে ‘ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সংগীত নিকেতন’ এক যন্ত্রসংগীত অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গত ২রা সেপ্টেম্বর ছিল ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের ৫২তম প্রয়াণ দিবস এবং ৬ই সেপ্টেম্বর ছিল ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের ৪৭তম প্রয়াণ দিবস। ২৯শে এপ্রিল ছিল ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান এর প্রয়াণ দিবস। ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান ১৯৭৩ সালে ‘ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সংগীত নিকেতন’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানের শ্লোগান হল ‘যন্ত্রসংগীতের প্রসারে আমরা নিবেদিত’। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন সংগীত গবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন খান এবং সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান। এই অনুষ্ঠান চলাকালে অনেক দর্শককে দাঁড়িয়ে থেকে অনুষ্ঠান উপভোগ করতে দেখা যায় কারণ সন্ধ্যা সাতটা বাজার আগেই মিলনায়তন শ্রোতাদের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়ে যায়। যদিও বলা হয় সরোদ যন্ত্রশিল্প বিলীন হয়ে যাচ্ছে কিন্তু এই অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়েছে এই যন্ত্রশিল্পকে যে কোনোভাবেই হোক ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ এর বংশধরগণ বাঁচিয়ে রাখবে সঙ্গীতভূবনে। বিলীন হতে দিবেনা এই যন্ত্রশিল্পকে।
এই অনুষ্ঠানকে দুটি পর্বে ভাগ করা হয়। প্রথম পর্বে ছিল আলোচনা অনুষ্ঠান এবং দ্বিতীয় পর্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালিত হয়। আলোচনা পর্বে অতিথি হয়ে আসেন শ্রদ্ধেয় ডঃ তানভীর আহমেদ খান, শ্রদ্ধেয় ডঃ আব্দুল বাকি এবং শ্রদ্ধেয় সুরকার ও সংগীত পরিচালক শেখ সাদী খান (ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের পুত্র)। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ এর পরিবারবর্গ অংশগ্রহণ করেন এবং সেই সাথে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সংগীত নিকেতনের ছাত্রছাত্রীগণ অংশগ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানটির উপস্থাপিকার ভুমিকা পালন করেন ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের পৌত্রী (ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের আরেক পুত্র, সংগীত গবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন
খান এর কন্যা) প্রফেসর রীনাত ফওজিয়া। অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে আলোচনা করেন যথাক্রমে –
ডঃ তানভীর আহমেদ খান – আমি ১৯৭০ সালে জাগো আর্ট সেন্টারে সেতার শিখতে যাই, সেখানে ওস্তাদ মীর কাশেম আমার ওস্তাদ ছিলেন। ওস্তাদ মীর কাশেম আমাকে ৭ বছর সেতার শেখান। তারপর আমি ইউনিভার্সিটি
অব শেফিল্ডে চলে যাই। সেখানে সেতার সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। মাঝে মাঝে বাজাতাম। তারপর ১৯৮৪ সালে দেশে এসে ওস্তাদজীর সাথে যোগাযোগ করার চেস্টা করলাম এই ভেবে যে, আবার সেতার শেখা শুরু করব কিন্তু ওস্তাদজী অসুস্থ ছিলেন। তখন বুঝতে পারিনি যে, ওস্তাদজীর ক্যান্সার হয়েছে। ওনার বাসায় একদিন খবর নিতে গিয়ে ওনার মেয়ের কাছে জানতে পারলাম উনি হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে কমায় আছেন। গিয়ে দেখলাম তাই! তার দু’দিন পর তিনি মারা গেলেন। আবার পি এইচ ডি করতে শেফিল্ডে চলে গেলাম। পরে দেশে এসে আমি সরোদ শেখার ইচ্ছে পোষণ করলাম। ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানকে তো আমি ছোটবেলা থেকেই দেখেছি।
শাহিন ওর ডাকনাম। তাই শাহিন নামধরে তুই তুই করে বলি কিন্তু ও এখন আমার ওস্তাদজী। এখন ও আমাকে সালাম করে আর আমি ওকে সালাম করি। আমরা দুজনে মিলে নয় বছর ধরে যেটা করি তাহলো প্রতি বুধবার রাত নয়টা থেকে রাত বারটা পর্যন্ত আমরা যুগলবন্দী করি। আমাদের সাথে তবলাবাদকও আছেন। সরোদ শিখতে গিয়েছিলাম এবং সরোদও কিনেছিলাম কিন্তু আমরা যুগলবন্দী করি সেতারে। আমার বাসায় আমরা বসি প্রতি বুধবার।
এখন বলবো ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ এর কথা যিনি বাবা আলাউদ্দিন খাঁ নামে পরিচিত। অনেকেই তাঁর সমন্ধে জানেন কিন্তু যারা জানেন না তাঁরা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনবেন তাহলে বুঝতে পারবেন, উনি কি করেছেন জীবনে।
উনার জন্ম ৮ইঅক্টোবর ১৮৬২ এবং উনি মারা যান ৬ইসেপ্টেম্বর ১৯৭২সালে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিবপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সবদার হোসেন খাঁ আর মাতার নাম সুন্দরী বেগম। তাঁর মাতার নাম সুন্দরী বেগম তা অনেকেই আমরা জানতাম না। আলাউদ্দিন খাঁ এর ডাকনাম ছিল আলম। বাল্যকাল থেকেই তাঁর সংগীতের প্রতি অনুরাগ জন্মে। সেই সময় অগ্রজ ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর নিকট তাঁর সঙ্গীতে হাতেখড়ি। সুরের সন্ধানে তিনি দশ বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে এক যাত্রাদলের সঙ্গে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ান। ওই সময় তিনি জারি, সারি, বাউল, ভাটীয়ালী, কীর্তন, পাঁচালি প্রভৃতি গানের সঙ্গে পরিচিত হন। তারপর তিনি কোলকাতায় যান এবং সঙ্গীত শিক্ষালাভের জন্য তিনি প্রায় ভিক্ষাজীবনও কাটান। কেদারনাথ নামে এক ডাক্তারের অনুগ্রহে তিনি প্রকৃত সঙ্গীতসাধক গোপালকৃষ্ণ ভট্টাচার্য ওরফে নুলো গোপালের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। ১২ বছর সরগম সাধনার শর্তে নুলো গোপাল আলাউদ্দিনকে শিষ্য হিসেবে বরণ করে নেন। সাত বছর পর প্লেগ রোগে আক্রান্ত হয়ে নুলো গোপাল মৃত্যুবরন করেন। গুরুর মৃত্যুতে তিনি মর্মাহত হন। এই কষ্টে আলাউদ্দিন কন্ঠসঙ্গীতের সাধনা ছেড়ে যন্ত্রসঙ্গীত সাধনায় নিমগ্ন হন। স্টার থিয়েটারের সঙ্গীতপরিচালক অমৃতলাল দত্ত ওরফে হাবু দত্তের নিকট তিনি বাঁশি, পিকলু, সেতার, ম্যান্ডোলিন, ব্যাঞ্জো ইত্যাদি দেশি-বিদেশি বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখেন। সেই সঙ্গে তিনি লবো সাহেব নামে এক গোয়ানিজ ব্যান্ড মাস্টারের নিকট পাশ্চাত্য রীতিতে এবং বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ অমর দাসের নিকট দেশীয় পদ্ধতিতে বেহালা শেখেন এবং একই সময় তিনি মিসেস লবোর নিকট স্টাফ নোটেশনও শেখেন। এ ছাড়া
হাজারী ওস্তাদের নিকট সানাই, নাকারা, টিকারা, জগঝম্প এবং নন্দ বাবুর নিকট মৃদঙ্গ ও তবলা শেখেন। এভাবে তিনি সর্ববাদ্যে বিশারদ হয়ে ওঠেন।
আলাউদ্দিন খাঁ কিছুদিন ছদ্মনামে মিনার্ভা থিয়েটারে তবলা শিল্পী হিসেবে চাকরি করেন। অতঃপর ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার জমিদার জগৎকিশোর আচার্যের আমন্ত্রনে তাঁর দরবারে সঙ্গীত পরিবেশন করতে যান। সেখানে ভারতের
বিখ্যাত সরোদিয়া ওস্তাদ আহমেদ আলী খাঁর সরোদ বাদন শুনে তিনি সরোদের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তাঁর নিকট পাঁচ বছর সরোদে তালিম নেন। পরে ভারতখ্যাত তানসেন বংশীয় সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর নিকট সরোদ
শেখার জন্য তিনি রামপুর যান। ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ রামপুরের নবাব হামেদ আলী খাঁর সঙ্গীতগুরু ও দরবার-সঙ্গিতজ্ঞ ছিলেন। আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর নিকট দীর্ঘ ত্রিশ বছর সেনী ঘরানায় সঙ্গীতের অত্যন্ত দুরূহ ও সূক্ষ্ম কলাকৌশল আয়ত্ত করেন। তিনি প্রচুর গান রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানে তিনি ‘আলম’ ভনিতা ব্যবহার করেছেন। ১৯১৮ সালে নবাব তাঁকে মধ্য প্রদেশের মাইহার রাজ্যে প্রেরণ করেন। মাইহারের রাজা ব্রিজনারায়ণ আলাউদ্দিন খাঁকে নিজের সঙ্গীত গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত করলে তিনি মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এভাবে আলাউদ্দিন খাঁ জীবনের বড় অংশ শিক্ষার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেন। আলাউদ্দিন খাঁ সরোদে বিশেষত্ব অর্জন করেন। সহজাত প্রতিভাগুনে তিনি সরোদবাদনে ‘দিরি দিরি’ সুরক্ষেপণের পরিবর্তে ‘দারা দারা’ সুরক্ষেপণ পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। সেতারে সরোদের বাদন প্রনালী প্রয়োগ করে সেতারবাদনেও তিনি আমূল পরিবর্তন আনেন। এভাবে তিনি সঙ্গীতজগতে এক নতুন ঘরানার প্রবর্তন করেন যা, ‘আলাউদ্দিন ঘরানা’ বা শ্রেনী ‘মাইহার ঘরানা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
ডঃ আব্দুল বাকী – আমি তানভীর সাহেবের মত ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের ছাত্র। খুব ছোট থেকেই শাহাদাত সাহেবের বাসা আমার বাসার কাছেই ছিল। আমার দীর্ঘ পচিশ বছরের শখ ছিল এরকম একটি যন্ত্র বাজানোর। বাংলাদেশে
এই ধরনের যন্ত্র নেই তাছাড়া আমার মনে হয়েছিল এই ধরনের ওস্তাদের সংস্পর্শে আসা দুরূহ ব্যাপার। আর আমার চাকরিটা বা পেশাটা এমন অত্যন্ত সময় দাবি করে। ফলে আমার কখনই হয়ে উঠেনি। কিন্তু যেদিন আমি অবসরে
গেলাম আমি সিদ্ধান্ত নিলাম এই সাংঘাতিক জিনিসটি আমি চেষ্টা করে দেখবো এবং ঘটনা চক্রে আমার এক ভাই তাঁর সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। সেই সুবাদে বা তাঁরই হাত ধরে আমি এই গুণী লোকটির সংস্পর্শে আসি। যখন তিনি
জানলেন যে, আমি একটি দুষ্ট বুদ্ধি নিয়ে তাঁর সামনে এসেছি, উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে দেখলেন কারণ ওনার চেয়ে অনেক বেশি বয়স আমার। শুধু তাই নয় ওনার যে কাছের বন্ধুবান্ধব যারা আছেন, সচিব বন্ধু
যারা আছেন তাঁরা সবাই আমার সরাসরি ছাত্র। তো সেই ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা তৈরি হল কিন্তু আমি চেস্টা করলাম, যে গুরু সে গুরুই হবে। তো উনি আমাকে হেসে বল্লেন, যে বয়সে এই সাংঘাতিক অপদার্থ বিশ্বাসী অবিশ্বাসী যন্ত্রটি মানুষ তুলে রাখে, আপনি সেই যন্ত্রটি হাতে নেওয়ার স্বপ্ন দেখেন! চেস্টা করে দেখান, হলেও হতে পারে। আমি এখন মনে করি হলো না, আমার হবারও নয়। কিন্তু ঐ যে বলেনা, নিষিদ্ধ প্রেম! আমি এখনো সেই নিষিদ্ধ প্রেমের
আকর্ষণে তাঁর পিছু আছি। এই আছি থাকার শাস্তি হিসেবে উনি পরশুদিন আমাকে বল্লেন, আপনি এই অনুষ্ঠানের জন্য কিছু বলুন। আমি বিনয়ের সাথে বললাম আমি এই জিনিসটার জন্য সুপাত্র নই। তারপর উনি একটি কাগজ
ধরিয়ে দিলেন। আমি ধরেই নিলাম কাগজে বায়োগ্রাফিগুলো আছে। আমি জানি এরকম একটি সুধি সমাজ আমার কাছে কিছুই শুনতে চাইবেনা কারণ ডঃ তানভীর যেখানে আছেন সেখানে আমি জানতাম তিনি একটি সুন্দর
ইতিহাস বলে দিবেন। আমার জানানোর মত এমন ভাল কিছু নেই কিন্তু তারপরেও আমি ছোট্ট করে কিছু কথা লিখে নিয়ে এসেছি আপনারা যদি অনুমতি দেন তাহলে আমি পড়ে শুনাই। আজকে স্মরণ করা হচ্ছে দেশ বরেণ্য
তিন ওস্তাদ – ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আয়েত আলি খাঁ ও ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান, তাদের অবদানকে বর্তমান শ্রোতাদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়া। বর্তমানের ব্যস্তজনগোষ্ঠীকে সামান্য মনে করিয়ে দেয়া যে, এই গুণীজনদের
শাস্রীয়কলা এখনো সগৌরবে বাঁচিয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শাস্রীয়কলার বিশেষ ঘরানাকে বাঁচিয়ে রাখার পুরোধা হলেন ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান। এই সুন্দর আয়োজনে ওস্তাদ শাহাদাত ও তাঁর ছাত্রদেরকে অপরিমেয়
শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমার ভাবতে ভাল লাগে যে, বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি গ্রামে একটি পুরোবাড়ি এই উপমহাদেশের শাস্রীয়সঙ্গীতকে কতটা আলোকিত করলে আজো গুরু হিসেবে সবাই মনে রাখে। বাংলাদেশে ওস্তাদ মোবারক হোসেন খান, ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান এই ঘরানাকে আলো ছড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে আজো নিয়োজিত আছেন। আমি বলবো অত্যন্ত সাফল্যের সাথে, অত্যন্ত দক্ষতার সাথে, পরিনত বোধের মধ্যে অনেককে ছড়িয়ে দেয়া, অনেককে কাছে টানা, অনেককে বুঝিয়ে বলা, অনেককে এই যন্ত্রের প্রতি আকর্ষণ করার জন্য তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন যথেষ্ট, এটাই আমার বিশ্বাস। সুর সম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সম্পর্কে কিছু বলার প্রয়োজনবোধ করছি না, বিশেষ করে ডঃ তানভীর আহমেদ খান যা বলেছেন তারপরে আমার সত্যি সত্যি যোগ করার মত হাতে কিছু নেই। আমরা বলবো এরা দু’জন কাল শ্রেষ্ঠ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ দুজন প্রতিনিধি হিসেবে আমরা পেয়েছি। আমরা গৌরব করতে পারি এই অর্থে যে, এই দু’জন লোক বা তিনজন লোক আমাদের দেশেই ছিল কিন্তু সেই প্রতিষ্ঠার মূলসুরটি কিন্তু আমাদের দেশে না হয়ে দেশের বাইরে অনেকদূরে হয়ে গেছে। তাই আমাদের
অত্যন্ত দুর্ভাগ্য যে, আমাদের শাস্রীয়সঙ্গীতের যে মূল আকর্ষণ, যে মেধা, যে মননশীলতা তার সবগুলো আমরা দিতে পারিনি। তাই হয়তো ঘর থেকে বের হয়ে অনেকদূরে বিদেশ বিভূইয়ে গিয়ে জায়গা করে নিতে হয়েছে। এখন
আমরা বুঝতে পারি বিদেশ বিভূইয়ে লোকাল লোক না হয়েও তাঁকে জায়গা করে নিতে কত কষ্ট করতে হয়েছে। আমরা সেই কষ্ট স্বীকার করে আজকে তাঁদের উত্তরসূরীদের মধ্যে এখানে দাঁড়িয়ে কিছু বলার যে সুযোগটা পেলাম
তার জন্য কৃতার্থ। বাংলাদেশের পরিমণ্ডলে এই তিনজন অত্যন্ত বিস্মনিয় ব্যক্তিত্ব, শিষ্ঠাচারে সঙ্গীতজ্ঞ হয়েও কর্মক্ষেত্রে বিশিষ্টজন হয়ে ছিলেন। ঐ পরিবারের আরেক অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হলেন মোবারক হোসেন খান। এরকম
পরিবারে একাধিক গুরু থাকবেন সম্ভবত এটাই নিয়ম। ওস্তাদ মোবারক হোসেন তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। প্রকৃতপক্ষে ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান সেই ঘরানার আলোকবর্তি হয়ে আজো আছেন। বলতে দ্বিধা নেই, গুণ ও গন্ধ কখনোই
লুকানো যায় না। এই পরিবারে রয়েছে গুণের সমাহার, গন্ধের সর্বগ্রাসী প্রয়াস। এই ঘরানার সবাই বাংলাদেশকে সুবাসিত করুক, পুস্পিত করুক এই কাম্না করি। পরিশেষে এই গুণীজনদের মনে রাখার যথার্থ পথ হল তাদের উত্তরসূরিদের উৎকর্ষ শোনা, দেখা ও তাঁদেরকে সহযোগিতা করা।
শেখ সাদী খান – আসসালমু ওয়ালাইকুম বিনীত শ্রোতা। প্রথমে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আজকে সঙ্গীতের দুই মহাপুরুষের স্মরণে আমরা অনুষ্ঠান করতে এসেছি, আপনাদেরকে কিছু কথা বলতে এসেছি, ওনাদেরকে যারা জানেন
না তাঁদের সম্পর্কে জানানোর জন্য এসেছি আমরা। আপনারা এসেছেন তাই আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আপনারা সবই শুনেছেন। এর আগে আমার সম্মানিত ব্যক্তিগণ, শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিগণ তাঁরা কথা বলে গেছেন। আলাউদ্দিন খাঁর সম্পর্কে কথা বলে গেছেন, আয়েত আলী খাঁ সম্পর্কে কথা বলে গেছেন। এই পরিবারে যারা আছেন তাঁদের কিছু মানুষের নাম বলে গেছেন। তো আমিতো ভালো বক্তা না। মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় কথা বলতে হয় তাই বলি। যেহেতু আজকে বাবা চাচাদের অনুষ্ঠান সেখানে নিজেদের কথা বলাটা মানায়ওনা আবার যে, নিজের বাবার কথা বলব, নিজের চাচার কথা বলব। নিজের ভাইয়ের কথা বলব। মানায় না
সেটা ঠিক। অন্যেরা বললে এটা বেশী মানায়, এটা আরও বেশী বিশ্বস্ত হয়। তা যাই হোক,আমার বাবা আয়েত আলী খান সাহেব ওনার সম্পর্কে আপনারা জানেন শুনেছেন, স্মৃতিকথা কি বলব! বাবার সাথে স্মৃতি ছোটবেলায়ই ছিল। আমি যখন প্রাপ্ত বয়স্ক হচ্ছি সে সময় বাবাকে হারালাম। বাবার কাছেই আমার হাতেখড়ি ছিল। আমি তবলায় হাতেখড়ি নিয়েছিলাম বাবার কাছে আবার বেহালারও হাতেখড়ি নিয়েছিলাম বাবার কাছে। তারপর আমি উচ্চাঙ্গ সংগীতে শিক্ষা নেয়ার জন্য আমার মেঝভাই বিশ্বখ্যাত সরোদবাদক এবং মিউজিক কম্পোজার ওস্তাদ বাহাদুর খাঁ সাহেবের কাছেই আমার সঙ্গীতে্র তালিম, বেহালায় তালিম। আমি বেহালা বাজাতাম, ক্লাসিক্যাল বাজাতাম দীর্ঘ বছর বাজিয়েছি। বাবার কথা বলতে গেলে আমার নিজের কথাও আসে। যখন পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে শিক্ষা নিয়ে আসলাম। এখানে আসার পর রেডিওতে প্রোগ্রাম করতে গেলাম। ক্লাসিকাল প্রোগ্রাম করতে গেলাম, ক্লাসিকাল অডিশন দিলাম, পাশ করলাম। আমাকে দিয়ে দিল চাকরি। রেডিওতে চাকরি করব বেহালাবাদক হিসেবে। তো সে অনেক বড় ইতিহাস! অতো বড় ইতিহাস আপনাদের শোনার ধৈর্য্য থাকার কথা না। আমি ১৯৭৭সন পর্যন্ত বেহালা বাজিয়েছি। তারপরে জীবন বাঁচানোর জন্য হয়তো আপনারা শুনছেন, অনেকেই বলেছে, অনেক গুণীজনও বলেছেন যারা সংগীতের অনুরাগী অনেকসময় ওনারাও বলেছেন যে, আসলে আমাদের দেশে উচ্চাঙ্গ সংগীতের যে কদর থাকার কথা ছিল সেটা কখনোই নাই! এখনো কিন্তু নাই। এখন আমরা যারা করছি বা যারা করছেন তাঁরা কিন্তু নিজের দায়ে পড়ে করছেন, ভালবাসেন বলে করছেন, সঙ্গীতের নেশা আছে বলে করছেন নিজেদেরকে এগিয়ে নেয়ার জন্য কিন্তু ক্লাসিক করে বা এটার ওপর নির্ভর করে চলাফেরা আসলেই কষ্টকর। এগুলো নিয়ে আর আলাপ আলোচনা করতে চাইনা। এগুলি আসলে এক সময় রাজারা সঙ্গীতজ্ঞদেরকে দেখাশোনা করতেন তাঁদেরকে সমস্ত দায়দায়িত্ব দিতেন তাঁদের শিল্পীদের, তাঁরা সাধনাও করতেন, সাধনা করে একেকজন এক একটা রাগ সৃষ্টি করতেন বাজিয়ে মানুষকে মন্ত্রমুগ্ধ করতেন। তো আমাদের এখানেতো ঐ পর্যায়ের মানুষ খুব কম আছে এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে চাইনা। যার জন্য আমি একটু ছুটে এসেছি, লোকোসঙ্গীতের দিকে চলে আসছিলাম আমি। আমি যেটুকু ক্লাসিক বিদ্যা শিখেছি সেই ক্লাসিক বিদ্যাটাকে যদি সহজভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরতে পারি, সেটা গানের মাধ্যমে হোক, বাদনের মাধ্যমে হোক আমি সেই পথটাই কিন্তু বেছে নিয়েছি। এই পথটা নিয়ে আমি দেখলাম যে যারা বিশ বছর সাধনা করে লাইন লাইটে আসতে পারেনাই আমি কিন্তু তাড়াতাড়ি এসেছি। যেহেতু আমি লোকসঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজে গান রচনা করে তাড়াতাড়ি মানুষের মন জয় করতে পেরেছি। কিন্তু সহজ প্রাপ্তিটা মানুষ যেমন চায়, সহজ জিনিস্টা শুনতে চায়, মানুষ কঠিন জিনিসে যেতে চায়না। আর এখন দিনদিন যে অবস্থা হচ্ছে পৃথিবীর, মানুষের এত ধৈর্য্য নাই। তারজন্য যে সাধনার প্রয়োজন সেই সাধনা করার সময় এখন মানুষের নাই। এখন গল্প করার জন্য, আড্ডা দেয়ার জন্য, টাকা বানানোর বুদ্ধি করার জন্য সময় পাওয়া যায়। এরকম অনেক কিছু আছে তো এগুলোতে যেতে চাইনা। সঙ্গীতের পেছনে থাকতে চাই। সঙ্গীতের সাধনা করলে, সঙ্গীতের সাথে থাকলে মানুষের জীবনযাপন সুন্দর হয়। মানুষ যারা সঙ্গীত সাধনা করে, যাদের মধ্যে শৈল্পিক গুণাবলি আছে এবং যারা গানবাজনা, আর্ট করা, কবিতা লেখা ইত্যাদি করে তারা কিন্তু সন্ত্রাসী হয়না কখনোই। তাই এটাই বলতে চাচ্ছি, আজকে এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের প্রত্যেকের ঘরে একটা বিপ্লব ঘটানো উচিত। ঘর থেকেই কিন্তু শিল্পী তৈরি হয়, সাংস্কৃতিক ধারার সৃষ্টি হয়। তাই সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে। আমাদের ছেলেপেলেরা এখন যে অবস্থায় আছে সেইদিক থেকে আমরা চেষ্টা করলে সব দিক থেকে সংযত রাখতে পারবো মনে হয়। শিল্পী
হয়ে গান গাইতে হবে এমন কোনো কথা নাই। শিল্পী হোক, শিল্পী মন থাকুক। শিল্পীর মন থাকলে অনাচার কম হবে। ডানে বামে গণ্ডগোল কম হবে। এবার বাবার কথায় আবার যাই। আজকে অনেক বছর হয়ে গেল ওনার প্রয়াণ।
আমাদের খাঁ সাহেবের ৪৭বছর হয়ে গেছে আর বাবার আরেকটু বেশি! ওনাদের দেখেছি যতটুকু, শিখতে তো ততটুকু পারিনি! ওনারা এক একজন ত্রিশ বছর সাধনা করেছেন, তালিম নিয়েছেন ওস্তাদের কাছে। আমার বাবা বিশ
বছর ওস্তাদ ওয়াজির খাঁ সাহেবের কাছে ছিলেন। ওনারা যেভাবে ওস্তাদের কাছে তালিম পেয়েছেন, শিখেছেন এবং ওনারা ওনাদের অনুসারী তৈরি করতে পেরেছেন। আমরা কিন্তু ওনাদের কাছ থেকে ওতটুকু শিখতে পারিনি। দেখেছি আমরা, শুনেছি। আমরা তো যেটুকু দেখেছি, শুনেছি সেটুকু দিয়েই আমরা আমাদের পথ এগিয়ে নিচ্ছি। আমি এই পরিপ্রেক্ষিতে এইটুকুই বলতে চাই, ওনাদের স্মরণের দিনে ওনাদের আত্মার প্রতি আমি মাগফেরাত কামনা
করি। আপনারাও এই দু’জন সঙ্গীতের মহাপুরুষের সাথে আমার বড় ভাই চলে গেছেন, ওস্তাদ আবেদ হোসেন খান সাহেব, ওস্তাদ বাহাদুর হোসেন খান সাহেব ওনারাও চলে গেছেন পৃথিবী থেকে তাঁদের জন্যও দোয়া করবেন।
আমরা ছয় ভাইয়ের ভেতর তিনভাই এখন আছি। আমার ইমিডিইয়েট বড় ভাই মোবারক হোসেন খান সাহেব, উনি খুব অসুস্থ! ওনার জন্য দোয়া করবেন। আপনাদের দোয়াই আমাদের কাম্য। তাছাড়া বরেণ্য দুই মহাপুরুষের
জন্য আপনারা অন্তত তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করবেন, এটাই হয়তো তাঁদের জন্য বড় পাওয়া, আপনাদের কাছ থেকে।
আলোচনা পর্ব শেষ হলে দ্বিতীয় পর্বে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে প্রথমেই ‘ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সঙ্গীত নিকেতন’ এর তবলাবাদক সঞ্জীব মজুমদারের ছোট ছোট ছাত্রছাত্রীবৃন্দ তবলা বাজিয়ে দর্শক শ্রোতাদের মনরঞ্জন করে। এরপর আসে সঙ্গীত নিকেতনের ছাত্রছাত্রীর অর্কেস্ট্রার দল। তারাও তাঁদের যন্ত্রশিল্পে দক্ষতার পরিচয় দেয়। এই দলের পরিবেশনা শেষ হলে ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের পৌত্র এবং সংগীতগবেষক ও লেখক মোবারক হোসেন
খানের পুত্র তানিম হায়াত খান তাঁর সরোদের ঝংকারে সকলকে মুগ্ধ করে রাখেন এবং তাঁর সাথে তবলায় ছিলেন সঞ্জীব মজুমদার।। এরপর আসে দর্শকশ্রোতাদের প্রতীক্ষার পালা শেষ হওয়ার সেইক্ষণ! ওস্তাদ আয়েত আলী
খাঁ সাহেবের সুযোগ্য পৌত্র ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান (ওস্তাদ আবেদ হোসেন খানের একমাত্র ছেলে) এবং ওস্তাদ আয়েত আলী খাঁ সাহেবের প্রপৌত্রীদ্বয় ও ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খানের দুই মেয়ে, সেতারে আফসানা খান
ও সরোদে রুখসানা খান মঞ্চে আরোহণ করেন। পিতা ও কন্যাদের যন্ত্রশিল্প সরোদ ও সেতারের ঝংকারে দর্শকশ্রোতা অভিভূত হয়ে পড়ে। অসাধারণ এক পরিবেশনা ছিল। মিলনায়তন হাততালির শব্দে ভরে যায়। অনুষ্ঠান শেষে
দর্শক শ্রোতারা বিমুগ্ধচিত্তে বাড়ি ফিরে যায়।