– মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না।
জন্ম যেখানে মৃত্যু সেখানে – এটাই প্রকৃতির নিয়ম। কিন্তু তবু ছেড়ে জেতে মন চায় না এই ভালবাসার পৃথিবী। গতকাল রাতে আমরা হারালাম সঙ্গীত ভুবনের সবার প্রিয় কিংবদন্তি শিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহ-কে। কেউ যেন তা বিশ্বাস করতে পারছেন না কারণ তাঁর কোন অসুখ হবার খবর কেউ জানতেন না। দেশের শিল্পীরা খবরটি জানার পর ফেসবুক হয়ে উঠেছিল দুঃখের সাগরে ভাসমান। ২৩শে মার্চ মধ্যরাতে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি স্বামীর হাতে হাত রেখে ((ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বারিধারায় নিজ বাসায় শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় রাত সাড়ে ১১টায় শাহনাজ রহমতউল্লাহ মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। তিনি স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন। স্বামী মেজর (অব.) আবুল বাশার রহমতউল্লাহ ব্যবসায়ী, মেয়ে নাহিদ রহমতউল্লাহ থাকেন লন্ডনে আর ছেলে এ কে এম সায়েফ রহমতউল্লাহ যুক্তরাষ্ট্রের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করে এখন কানাডায় আছেন। তাদের দেশে ফেরার টিকেট এখনো নিশ্চিত হয় নেই। তাই অপেক্ষা না করে আজ ২৪ মার্চ, রবিবার বাদ জোহর বেলা ২টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর বনানীর সম্মিলিত সামরিক বাহিনীর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে কণ্ঠশিল্পী শাহনাজ রহমতউল্লাহকে।
এর আগে আজ বাদ জোহর বারিধারার ৯ নম্বর রোডের পার্ক মসজিদে তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। শাহনাজ রহমতুল্লাহর স্বামী অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবুল বাশার রহমতুল্লাহ বলেন, যে চলে গিয়েছে তাকে তো আর ফেরানো যাবে না। ছেলে কবে আসতে পারছে তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ তাদের টিকিট পাওয়ার বিষয় আছে। তারা এলে দোয়া অনুষ্ঠানে অংশ নেবে।
দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে দীর্ঘ ৫০ বছরের ক্যারিয়ারে অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন উপহার দিয়েছেন এই গুণী শিল্পী। ক্যারিয়ারের ৫০ বছর পূর্তির পর গান থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বিদায় নেন শাহনাজ রহমতউল্লাহ। এ ছাড়া গান থেকে বিদায় নেওয়ার আরও একটি কারণ হলো ধর্মপরায়ণ জীবন বেছে নেওয়া। সারাক্ষণ মহান আল্লাহর ধ্যানেই মগ্ন থাকতেন এ শিল্পী। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টা করে যেতেন। শাহনাজ রহমতউল্লাহ গত প্রায় সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে সঙ্গীতাঙ্গন থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘরসংসার, আল্লাহর পথেই তার সময় কাটাতেন।
তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আর কোনোদিনই গান গাইবেন না। তিনি তার সিদ্ধান্তেই অটল ছিলেন। শাহনাজ রহমতউল্লাহর কণ্ঠে এদেশের মানুষ শুনে এসেছেন কালজয়ী গান ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আমার দেশের মাটির গন্ধে’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বলরে আমায় বল’, ‘সাগরের তীর থেকে’, ‘যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়’, ‘খোলা জানালা’, ‘পারি না ভুলে যেতে’, ‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে’ ইত্যাদি। আরো অসংখ্য গান রয়েছে তার গাওয়া।
শাহনাজ রাহমতউল্লাহর জন্ম ১৯৫২ সালের ২রা জানুয়ারি ঢাকায়।
তার বাবা এম ফজলুল হক, মা আসিয়া হক। মায়ের হাতেই ছোটবেলায় তার গানের হাতেখড়ি। পরিবারের সবার কাছে তিনি ছিলেন আদরের শাহীন। ছোটবেলাতেই তিনি শিল্পী হিসেবে পরিচিতি পান। মাত্র ১১ বছর বয়সে ১৯৬৩ সালে ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন। সেই থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত নিয়মিত গান করেছেন। টেলিভিশনে গান গাইতে শুরু করেন ১৯৬৪ সাল থেকে। শাহনাজ রহমতউল্লাহ সত্তরের দশকে অনেক উর্দু গীত ও গজল গেয়েছেন। প্রখ্যাত গজলশিল্পী মেহেদী হাসানের কাছে তিনি গজল শিখেছেন। ১৯৭৩ সালে তিনি আবুল বাশার রহমতউল্লাহর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের এক মেয়ে এবং এক ছেলে। সংগীতে অবদানের জন্য তিনি একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। শাহনাজ রহমতউল্লাহ প্রথম উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নেন ওস্তাদ ফুল মোহাম্মদের কাছে।
এরপর তিনি ওস্তাদ মনির হোসেন, গজল সম্রাট মেহেদী হাসান, শহীদ আলতাফ মাহমুদের কাছেও গানে তালিম নেন। বিয়ের পরে তিনটি চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেছিলেন এ শিল্পী। খান আতাউর রহমানের সুরে ‘আবার তোরা মানুষ হ’, আলাউদ্দীন আলীর সুরে ‘সাক্ষী’ ও আনোয়ার পারভেজের সুরে ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক করেন। এসবের মধ্যে ‘ছুটির ফাঁদে’ চলচ্চিত্রে গাওয়া ‘সাগরের সৈকতে কে যেন দূর থেকে’ গানটির জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। শাহনাজ রহমতউল্লাহর ভাই আনোয়ার পারভেজ ছিলেন এদেশের প্রখ্যাত একজন সুরকার এবং সংগীত পরিচালক। আরেক ভাই জাফর ইকবাল ছিলেন এদেশের চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়ক।
বিবিসির জরিপে সর্বকালের সেরা ২০টি বাংলা গানের তালিকায় শাহনাজ রহমত উল্লাহর গাওয়া চারটি গান স্থান পায়। এর মধ্যে আনোয়ার পারভেজের সুর করা দুটি, খান আতাউর রহমানের একটি ও আবদুল লতিফের সুরে একটি গান রয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন দেশের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও সঙ্গীত অঙ্গন সহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ। আমরা তাঁর বেহেস্থ নসীব কামনা করি।