– কবি ও কথাসাহিত্যিক রহমান ফাহমিদা।
একটি দেশ তার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে তুলে ধরে নিজেকে। তেমনি আমাদের দেশেও রয়েছে নানান ধরণের সংস্কৃতি। প্রত্যেক দেশের সংস্কৃতি সারা বিশ্বে প্রতিনিধিত্ব করে তার নিজ দেশের। বাংলা সাহিত্য-সঙ্গীত এর বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল কলকাতাকে কেন্দ্র করে। কারণ লালন-হাসন রাজা ছাড়া প্রধান প্রায় সকল গীতিকবি-সুরকার-শিল্পীর কাজের শুরু হয়েছিল কলকাতা থেকে। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর সাহিত্য সঙ্গীতের আরেকটি কেন্দ্র হয়ে ওঠে ঢাকা। সত্যি কথা বলতে কি পূর্ব বাংলার লোকসঙ্গীত (তখন বলা হত পল্লীগীতি) পশ্চিম বাংলার লোকসঙ্গীতকে ছাড়িয়ে অনেক উপরে উঠে, অনেক বিস্তৃতি লাভ করে এবং অনেক বেশী জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শুধু গ্রাম বাংলার মানুষ নয়, শহরের শিক্ষিত লোকেরাও লোকসঙ্গীতের ভক্ত হয়ে ওঠেন। লোকসঙ্গীত বাংলাদেশের সঙ্গীতের একটি অন্যতম ধারা। এটি মূলত বাংলার নিজস্ব সঙ্গীত। গ্রাম বাংলার মানুষের জীবনের কথা, সুখ-দুঃখের কথা ফুটে ওঠে এই সঙ্গীতে। এর আবার অনেক ভাগ রয়েছে। এটি একটি দেশের বা দেশের যে কোনো অঞ্চলের কালচার বা সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। যেমনঃ
১। ভাওয়াইয়া
২। ভাটিয়ালী
৩। পল্লীগীতি
৪। গম্ভীরা।
‘রুপালী নদী রে, রুপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’ একটি জনপ্রিয় পল্লীগীতি। এই কালজয়ী গানটির গীতিকবি ছিলেন জনপ্রিয় গীতিকবি আনিসুল হক চৌধুরী (মে ৩১, ১৯১৯ – সেপ্টেম্বর ৮, ২০০৯) শিল্পী ছিলেন পল্লীগীতির রাজ্যের রাজা বা মরমী শিল্পী আবদুল আলীম (জুলাই২৭, ১৯৩১ – সেপ্টেম্বার ৫, ১৯৭৪) এবং এই গানের সুরকার ছিলেন বাংলাদেশের প্রখ্যাত সুরকার এবং সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা (২৫শে ডিসেম্বর, ১৯৩৪ – ২৭শে জানুয়ারি, ১৯৯৯)। আজকে এই স্বনামধন্য তিনজন মানুষই নেই এই পৃথিবীতে। তবে তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফসল, ষাটের দশকের তুমুল জনপ্রিয় এই গান এখনো ভেসে বেড়ায় বাংলার আকাশে বাতাসে এবং মানুষের মুখে মুখে। এই গানের রচয়িতা আনিসুল হক চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী ছিল এই সেপ্টেম্বর মাসের ৮ তারিখে। তিনি ৭ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার সেন্ট পিটার্সবার্গ জেনারেল হাসপাতালে স্থানীয় সময় বিকেল চারটা ও বাংলাদেশ সময় ৮ সেপ্টেম্বর ২০০৯, রাত তিনটায় মারা যান। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন। তিন ছেলে, তাঁর সহধর্মিণী (অবশ্য তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছর পর তিনিও মারা যান) এবং ছেলের বউ ও নাতি-নাতনি নিয়েই একসাথে প্রবাসে বসবাস করছিলেন।
আনিসুল হক চৌধুরী ১৯১৯ সালের ৩১ মে, বিক্রমপুর জেলার সিরাজদিখান থানার খিলগাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম বজলুল হক চৌধুরী এবং মাতার নাম জোবেদা চৌধুরী। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় অনার্সসহ এম এ পাস করেন। মূলতঃ তিনি ছিলেন একজন অধ্যাপক, কবি, গীতিকবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তবে তাঁর লেখা গানের সাথেই সবাই বেশি পরিচিত। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ঢাকা বেতারে যে সব আধুনিক বাংলা গান প্রচারিত হত, সেই গানগুলোর স্বনামধন্য গীতিকবি ছিলেন ফররুখ আহমদ, সায়ীদ সিদ্দিকী, আজিজুর রহমান, আনিসুল হক চৌধুরী, আবদুল লতিফ প্রমুখ। ঐ সময়ে বাংলা গানকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে আরোহণ করিয়েছিলেন যারা, তাদের মধ্যে আনিসুল হক চৌধুরী ছিলেন অন্যতম।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে প্রথম দিকে যে কয়েকটি গান রচিত হয়েছে এর মধ্যে একটি গান ছিল আনিসুল হক চৌধুরীর লেখা। গানটি ছিল, ‘ভাই রে ভাই, বাংলাদেশে বাঙালি আর নাই’। তাঁর লেখা অন্যান্য গানের মধ্যে গণসংগীত ‘ঘুম ঘুম, শুধু ঘুম পাড়ানী গান আজ নয়’। দেশাত্মবোধ গান ‘সাগর পাড়ের দেশ, আমাদের হাজার নদীর দেশ’। এখনো অনেকের হৃদয় ছুঁয়ে আছে।
সঙ্গীত শিল্পী আব্বাসউদ্দিন আহমদ, আবদুল আলীম, আব্দুল লতিফ, ফেরদৌসি রহমান, লতিফা হেলেন সহ প্রতিষ্ঠিত সব শিল্পীই তাঁর লেখা গান গেয়েছেন। তাঁর গানের সুর করেছেন জনপ্রিয় সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক আলতাফ মাহমুদ, শেখ সাদী খান, সত্য সাহা, মমতাজ আলী খান প্রমুখ। বিভিন্ন গুণীজন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন এইভাবে-
আনিসুল হকের রচিত গান ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্র কর্তৃক সমাদৃত ও সম্প্রচারিত হয়েছে। – ( কবি জসীমউদ্দিন, ৩ জুন,১৯৪৩ )।
তাঁর রচিত কতগুলি গান আমি গেয়েছি। অল্প ক’জন প্রথম শ্রেণীর গীতিকারের মধ্যে তিনি অন্যতম’। – ( পল্লীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দিন আহমদ ২০মে, ১৯৫৮ )।
বাংলা গানের রচয়িতা হিসেবে তিনি একটি নাম ও খ্যাতি অর্জন করেছেন। – ( কবি গোলাম মোস্তফা ১৬ জুন, ১৯৪৯ )।
আর এই গুণী গীতিকবি সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু বলেছিলেন, কবি আনিসুল হক চৌধুরী সংগীতের ক্ষেত্রে আমার একজন পুরনো বন্ধু। আমি তাঁর লেখা অনেক গান সুরারোপ করেছি এবং তা শ্রোতাদের উচ্চ প্রশংসাও লাভ করেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের পর গান রচনায় যারা মৌলিকতা, সাবলীলতা, আন্তরিকতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা দাবি করতে পারেন, সেই অল্প ক’জন গীতিকবিদের মধ্যে তিনিও একজন। ( ২২মে, ১৯৫৮ )।
একটি গান মানুষের হৃদয়ে যুগের পর যুগ কিভাবে জায়গা করে নেয় তা এই ‘রুপালী নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’ কালজয়ী গানটিই তার প্রমাণ! এই গানটি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা যে মুখরোচক সংবাদ পরিবেশন করেছিলেন তার কিছু অংশ আলোকপাত করা হল-
‘রুপালী নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’ বাংলাদেশের অতি জনপ্রিয় গানটি গাইছেন উত্তর কোরিয়ার একজন মহিলা শিল্পী। শিল্পীর সাথে সাথে তাল মেলাচ্ছেন শিল্পকলা একাডেমীর মিলায়তনের হাজার দর্শক শ্রোতা। করতালিতে মুখর সারা প্রাঙ্গন। এক সময় গানটি শেষ হল, শ্রোতা দর্শকদের পক্ষ থেকে আবার রব উঠল ‘ওয়ান মোর’, ‘টু মোর’, মোর মোর। এর বুঝি আর শেষ নেই। ভুল, অসুদ্ধ আবেগময় উচ্চারণে গীত গানটি শ্রোতাদের পাগলপ্রায় করে তুলেছে। (সাপ্তাহিক পূর্বাণী, বৃহস্পতিবার, ২৫ শে ফাল্গুন, ১৩৮৪, ৯ই মার্চ, ১৯৭৮)।
তাঁর ( আবদুল আলীমের ) মৃত্যুর দিনে টোকিওতে অনুষ্ঠিত একটি সঙ্গীত বিষয়ক সেমিনারে সেদিন তাঁর রেকর্ডকৃত গান, ‘রুপালী নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’ গানটি বাজানো হয়েছিল। (বেতার বাংলা সেপ্টেম্বর, ১৯৮০, প্রথম পক্ষ, পৃষ্ঠা-৭, আব্দুল আলীম, ‘এ কে মুজতবা)।
‘রুপালী নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল………।’
আজো যেখানেই যাই না কেন, শুনি এই গান, শহর থেকে শহরতলী, তারপর গ্রাম, ছাঁয়া সুনিবিড় সবুজ গ্রামে বাতাসে ভর করে আছে ‘রুপালী নদীরে…’। কি বাণীতে, কি সুরে-মোহময় করে রাখে এ গান। মন ভরে যায়, যতবার বাজে ভাল লাগে। আর শুনতে শুনতে চোখের পর্দায় ভেসে ওঠে অপরূপ দেশের ছবি। মানুষের মনে দাগ কেটে অমরত্ব লাভ করেছে এ গান। বাজবে যুগে যুগে কালে কালে। দেশে, দেশে। কিছুদিন আগে উত্তর কোরিয়ার শিল্পীরা এসেছিল ঢাকায়। তাঁরা গেয়েছে এই গান এ দেশে। এমন কি চীন, জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়ন, আমেরিকা আর ভারতে সুনাম কুড়িয়েছে গানটি। বোম্বে শহরে সুধীজনের এক বিরাট উৎসবে মধুকণ্ঠি মিতালী মুখার্জী এ গান গেয়ে ঝড় তুলেছিলেন। গানটি মিতালী মুখার্জীকে রাতারাতি খ্যাতি এনে দেয়।
গানটিকে যিনি চির অমর করে রেখেছেন, দরদী কন্ঠে ছড়িয়ে দিয়েছেন হাটে, মাঠে, ঘাটে, তিনি শতাব্দীর কন্ঠ মরহুম আবদুল আলীম, সে কথা তো সবারই জানা। কিন্তু স্রষ্টা, যিনি সৃষ্টি করেছেন এই নন্দিত সঙ্গীত তার নাম জানে ক’জন। অনেকে ধারণা করে থাকেন, হয়তো এটা লোকায়ত বাংলার সংগ্রহ। কখনো কোনো কালে কারো মুখে মুখে তৈরি, অজানা অচেনা কোনো মানুষের। কালের গর্ভে সে হারিয়ে গেছে।
আসলে তা নয়। এই মুহূর্তে আমাদের সামনে বসে আছেন গানের স্রষ্টা বা গীতিকার জনাব আনিসুল হক চৌধুরী। একজন প্রচার বিমুখ ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন মানুষ। তাঁর বড় পরিচয়, রেডিও বাংলাদেশের প্রবীণতম গীতিকবি তিনি। (পৃষ্ঠা- ৪, চিত্রালী, ২৪ অক্টোবর, ১৯৮০, ৭ কার্তিক, ১৩৮৭, ঢাকা)।
গীতিকবি আনিসুল হক চৌধুরী ঢাকা বেতার কেন্দ্রের জন্মলগ্ন থেকে প্রতিষ্ঠানটির সাথে জড়িত। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি প্রবাস জীবনে লেখালেখি চালিয়ে গিয়েছেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কবিতা লিখতেন। মারা যাবার কিছুদিন আগে প্রবাসে বসেই দেশের একটি অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎকার দেয়ার সময় তিনি বাংলা গান সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘এই সময়ের বাংলা গান শুনে আরাম পাই না। কেমন যেন অন্য রকম। শুনলে মনে হয়, আমাদের সংস্কৃতির মূল শিকড় থেকে আমরা যেন অনেক দূরে সরে গেছি’। তিনি আরও বলেন, ‘বাংলা গানের সঙ্গে আগে দেশি বাদ্যযন্ত্রের যে সংমিশ্রণ ঘটত, তা এখন হারিয়ে গেছে’।
‘রুপালী নদী রে, রূপ দেইখা তোর হইয়াছি পাগল’… গানটির গীতিকবি, সুরকার ও শিল্পী তিনজনই এই পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন কিন্তু রেখে গেছেন তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অপরূপ এক সৃষ্টি, এই গান। এই গান বেঁচে থাকবে অনন্তকাল মানুষের মুখে মুখে এবং বেঁচে থাকবেন তাঁরা তিনজনই মানুষের হৃদয়ের মাঝে। এই সেপ্টেম্বর মাসেই এই গানের গীতিকবি আনিসুল হক চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ৮ সেপ্টেম্বর। তাই সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে তাঁকে জানাই অনেক অনেক শ্রদ্ধাঞ্জলি।