– সংগ্রহ – মোশারফ হোসেন মুন্না
উনিশ’শ সাতানব্বই সনে ওস্তাদ মোজাম্মেল হোসেন পদক, দু’হাজার সনে দেশের শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত গুণী হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ থেকে রবীন্দ্র পদক, দু’হাজার সাত সনে ওস্তাদ মোশাররফ হোসেন পদক, দু’হাজার এগারো সনে সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস, দু’হাজার বার সনে বাংলা একাডেমী ফেলোশিপ, দু’হাজার চৌদ্দ সনে একুশে পদক -এতগুলো প্রাপ্তিতে যিনি সম্মানিত ও সমাদৃত, আমার মতো ক্ষুদ্র একজনের প্রশংসা তাঁর জন্যে একেবারেই তুচ্ছ। উক্ত প্রাপ্তিগুলোর সবই ছিল দেশের সঙ্গীতের ক্ষেত্রে শিল্পী এবং শিক্ষক হিসেবে রামকানাই দাশের অবদানের স্বীকৃতি। কিন্তু একজন বড় মাপের সঙ্গীতজ্ঞ হয়েও তিনি কী -পরিমাণে অহংবোধ-বর্জিত, আত্মপ্রচার-বিমুখ, গুণগ্রাহী ব্যক্তি ছিলেন তার কিছুমাত্র আঁচ করা যায় না ওই প্রাপ্তি-তালিকা থেকে। তাই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমি তাঁর গুণীজনসুলভ বিনয়ী ব্যক্তিত্বের ওপর আলোকপাত করতে চাই। তা করতে গিয়ে আত্মকথনজনিত যে-ত্রুটি হয়ে যাবে আমার, তার জন্যে পাঠকদের কাছে আমি প্রারম্ভেই ক্ষমাপ্রার্থী।
রামকানাই-এর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় হয়েছিল তাঁর খ্যাতি-বিস্তৃতির সাত-আট বছর আগে। সনটা ছিল উনিশ’শ ঊননব্বই কি নব্বই। ঢাকায়, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি করি তখন। সঙ্গীত-সংক্রান্ত ‘নন্দনতত্ত্ব’ বিষয়ের প্রশিক্ষক হিসেবে সিলেট শিল্পকলা একাডেমি-আয়োজিত প্রশিক্ষণ-শিবিরে গিয়ে থাকতে হয়েছিল দিন-সাতেক। রামকানাই দাশের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ ও সামান্য পরিচয় ঘটেছিল তখনই। তিনি ছিলেন স্থানীয় (সিলেট শাখার) শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গীত প্রশিক্ষক। যে-কদিন ছিলাম, অকৃত্রিম সহযোগিতা ও আন্তরিকতায় তিনি আমাকে সঙ্গ দিয়েছিলেন প্রায় সারাক্ষণ। প্রশিক্ষণ ক্লাসেও তিনি বসে থাকতেন একজন মনোযোগী শিক্ষার্থীর একাগ্রতা নিয়ে।
প্রশিক্ষণ-শিবিরের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা হবার পর, একদিন আগ্রহভরে তিনি তাঁর নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘সঙ্গীত পরিষদ’-এ নিয়ে গিয়েছিলেন আমাকে। সমবেত ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে আমার পরিচয় তুলে ধরে, বিনীতভাবে আমাকে বলেছিলেন, ‘আমার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আপনি কিছু শিখিয়ে যান, যেটা আমাদের স্মরণীয় হয়ে থাকবে’। তাঁর সেই আবদার রাখার জন্যে সামান্য-কিছু পাঠ দিতে হয়েছিল আমাকে, তাঁর স্কুলের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে। তাতেই কৃতজ্ঞতা সহকারে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেছিলেন। তাঁর উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয়েছিল আমাকে পেয়ে তিনি যেন বিশাল কিছু পেয়ে কৃতার্থ হয়ে গেছেন।
ওই সময় স্থানীয় ‘বলরামের আখড়া’য় কোনো এক উৎসব উদযাপিত হচ্ছিল। তারই অনুষঙ্গ হিসেবে আয়োজন হয়েছিল সঙ্গীত অনুষ্ঠানের। রামকানাই বাবুর ব্যবস্থাপনায় নজরুলসঙ্গীত শিল্পী মফিজুল ইসলাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অজিত রায় এবং আমাকে সেই আখড়ার মঞ্চে গান পরিবেশন করতে হয়েছিল। যেহেতু স্থানটি ছিল বলরামের আখড়া’ তাই, কীর্তন-গায়নে পারদর্শী না-হয়েও, উপলক্ষ-সম্মত হবে ভেবে, আমি চন্ডীদাসের পদাবলীর ভিত্তিতে বিরচিত একটি ভাঙা কীর্তন গেয়েছিলাম। আনাড়ির মতো করে গাওয়া আমার সেই কীর্তন শুনে সবার আগে উদ্বাহু হয়ে তুমুল জোরে অবিশ্রাম তালি বাজিয়ে ‘আজ এই আসর মুত্তালিব বিশ্বাসের, আজ এই আসর মুত্তালিব বিশ্বাসের’ বলতে-বলতে সোল্লাসে মিলনায়তন প্রদক্ষিণ করেছিলেন তিনি। যেন এমন কীর্তন-গায়ন এর আগে কোনোদিন শোনা হয়নি তাঁর এবং আমাকে তুলে ধরেছিলেন এক অতি দক্ষ কীর্তনীয়া হিসাবে। এর পর যে ক’দিন ছিলাম, সঙ্গে করে তিনি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন সিলেটেরই আর একজন খ্যাতিমান ‘সঙ্গীতজন’, পটল দা’ নামে খ্যাত বিদিতলাল দাস-এর বাসায় এবং ইউরোপিয়ান ক্লাব সহ আরো কয়েকটা প্রতিষ্ঠানে। এছাড়া পীর হাবিবুর রহমান সহ আরো কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সন্নিধানে সগৌরবে আমাকে নিয়ে গিয়েছেন। সঙ্গে করে পাঁচ জায়গায় বেড়িয়ে এবং পাঁচজনের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে আত্মতৃপ্তি অনুভব করেছেন তিনি।
সিলেটে অবস্থানকালীন সাত দিনে, সব মিলিয়ে রামকানাই বাবুর সাথে আমার মেলা-মেশা একেবারে কম হয়নি। কিন্তু ওই মেলা-মেশার মধ্য দিয়ে, কিছুটা অনুমান করতে পারলেও, সম্পূর্ণভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি কত বড় এক সঙ্গীত-ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। বুঝতে পারিনি, কারণ আত্মজাহির-মূলক বিন্দু পরিমাণ কথাও বের হয়নি তাঁর মুখ থেকে ওই ক’দিনে। তাঁর বিরাটত্ব টের পেয়েছি পরে, ক্রমে ক্রমে। আর যত টের পেয়েছি ততই নিজের ক্ষুদ্রতা স্মরণ করে, সংকোচ অনুভব করতে করতে বুঝেছি, প্রথম পরিচয়ে আমাকে নিয়ে তিনি যা যা করেছিলেন তার সবই ছিল তাঁর মহান, উদার মনোবৃত্তির, অর্থাৎ মহানুভবতার পরিচায়ক।
পরবর্তী দশ-এগার বছরে, ঢাকায় দু’একবার-মাত্র হঠাৎ করে আমাদের সাক্ষাৎ হয়েছিল; এর বেশি-কিছু নয়। এর পর যেন বেশি করে ঘনিষ্ঠতা হল বিদেশের মাটিতে বসে। অভিবাসী হিসেবে আমি নিউইয়র্কে এসেছিলাম ২০০২ সনে, তিনি এসেছিলেন ২০০৪-এ। তিনি থাকতেন তাঁর সুগায়িকা কন্যা কাবেরী দাশের জ্যাকসন হাইটসের বাসায়। সাঙ্গীতিক পরিবেশ উপভোগের বাসনায়, কন্যা এবং পিতার আন্তরিক আমন্ত্রণেও বটে, আমি প্রায়ই যেতাম তাঁর কাছে। কথায় কথায় জেনেছিলাম, তিনি আমার চেয়ে মাত্র কয়েক মাসের বড়ো। অর্থাৎ আমরা সমবয়সী। তাই ‘দাদা’ হয়ে গিয়েছিলাম একে অপরের। দীর্ঘ সময় ধরে আমাদের আলোচনা হত, প্রধানত সঙ্গীত বিষয়ে।
রাগসঙ্গীতে অদক্ষ আমি অনেক-কিছু অর্জন করেছিলাম তাঁর বাচন ও বর্ণনা সুবাদে। সেই আলোচনা-সূত্রে আরও অনেক রকম কথা শুনেছিলাম তাঁর মুখ থেকে। তাঁর আবাল্য সঙ্গীত-জীবনের কাহিনী পরবর্তীকালে, যার অনেকখানি তিনি তুলে ধরেছেন আত্মকথামূলক ‘সঙ্গীত ও আমার জীবন’ পুস্তকে। শুনে এবং তাঁর অর্জিত সঙ্গীত-বিদ্যার নানাবিধ দৃষ্টান্তের নিরিখে বুঝেছিলাম, দেহে-মনে তিনি ছিলেন ‘মূর্তিমান সঙ্গীত’। রাগসঙ্গীতে পারদর্শী হয়েও তিনি ছিলেন লোকসঙ্গীতের একনিষ্ঠ স্তাবক ও সাধক। আলোচনার ফাঁকে-ফাঁকে, সিলেট-অঞ্চলের বিভিন্ন আঙ্গিকের লোক-গান শোনাতেন তিনি। এটা ব্যতিক্রমী ঘটনা, কারণ লোকসঙ্গীতের প্রতি এমন শ্রদ্ধাপূর্ণ মূল্যবোধ ইদানীংকালের রাগসঙ্গীত-শিল্পীদের মধ্যে তেমন পরিলক্ষিত হয় না। তাঁর আত্মমগ্ন হয়ে গাওয়া লোকসঙ্গীতে সামান্যত যা ধরা আছে কয়েকটা সিডি-তে পাওয়া যায় তাঁর জীবনদর্শন, জীবনাচরণ ও আত্মানুসন্ধান-প্রবৃত্তির পরিচয়।
রামকানাই দাশের উল্লিখিত আত্মজীবনীমূলক পুস্তকে, তাঁর আবাল্য যাপিত জীবনের নানান দিক নিয়ে অকপট উক্তিই শুধু নয়, তাঁর ভাষাজ্ঞান, সাহিত্যবোধ, সর্বোপরি শিল্পগুণসম্মত ও সুসংযত প্রকাশ ক্ষমতা আস্বাদনে আমি বিমুগ্ধ। যাঁরা না-পড়েছেন, তাঁদেরকে বোঝানো যাবে না এই বই কতখানি প্রসাদগুণ-মন্ডিত।
তাঁর সুযোগ্যা কন্যা কাবেরীর বাসায় বসে শুধু নয়, ফোনেও আমাদের আলাপ-আলোচনা হত প্রচুর। আমার সঙ্গীত-বিষয়ক কিছু লেখা শুনে প্রশংসা করার মতো কিছু পেলেই তিনি ফোন করতেন প্রায়শই। তিনি কপটাচারী ছিলেন না আদৌ, তাই বলতে হচ্ছে, আমাকে উজ্জীবিত-উৎসাহিত রাখার জন্যেই হয়তো বা তিনি অমন করতেন। অথবা এটা ছিল তাঁর গুণগ্রাহী সত্তার স্বত: স্ফূর্ত বহি:প্রকাশ। প্রশংসা-বাক্যে আমাকে সন্তুষ্ট বা অনুপ্রাণিত করে রাখার সেই অকপট অমায়িক ‘সুরেলা’ ব্যক্তিটি ইহধাম ত্যাগ করে ‘সুরধুনীর দেশে’ চলে গেছেন দু’হাজার চৌদ্দ’র সেপ্টেম্বরে! কিন্তু আমার অধমর্ণ মনটা এখনও ভাবে, এখনই যদি কাবেরীর বাসায় গিয়ে কলিং বেলে চাপ দিই, তিনি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে সাদর ভঙ্গীতে বলবেন, ‘আদাব দাদা, আসেন আপনাকে দেখলেই বড়ো খুশি লাগে। কাবেরীর মা, কোই গ্যালা, চা কর। এই দ্যাখো, যার গান পছন্দ কর, তিনি আইয়া পোড়ছেন।’ কিন্তু বাস্তবে যদি তা না ঘটে ? সেই অনাকাঙ্খিত চিত্রটাকে চাক্ষুষ করতে চাই না। তাই কাবেরীর বাসায় যেতে ইচ্ছে করে না আর।
আমার মানসলোকে রামকানাই দাশ এখনো উজ্জ্বলভাবে বিদ্যমান। মনে হয়, যেন আমি যাব বলে তিনি বসে আছেন কাবেরীর বাসায়, বসার ঘরে। সেখানে গেলেই আমার মতো এক সংকীর্ণ নদী নিজেকে মিশিয়ে দিতে পারবে বিস্তৃত এক সাগরে। এটা যদি কল্পনাবিলাস হয় হোক। এই বিলাসকে আমি লালন করতে চাই, আত্মপ্রবোধ হিসেবে, আমরণ।