asd
Friday, November 22, 2024

১৮ সালে হারিয়েছি যাদের ?…

– মোঃ মোশারফ হোসেন মুন্না।

জীবন নিয়ে পৃথিবীর বুকে এলে মরতে হবে এটাই বাস্তব। তবে কিছু কিছু মৃত্যু মন মানতে চায় না। তবুও মেনে নিতে হয়, নিতে হবে। সঙ্গীতকে ভালোবেসে সঙ্গীতের স্বার্থে যারা ছিলেন আজ তাদের অনেকেই বিভিন্ন সময় পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেছেন পড়পারে। সঙ্গীত জগত থেকে চলে যাওয়া ২০১৮ সালের যে সঙ্গীত প্রেমীরা আমাদের মাঝে শোকের ছাঁয়া ফেলেছেন আজ তাদের স্মরণ করছি হৃদয়াবেগে।
আইয়ুব বাচ্চুঃ
আইয়ুব বাচ্চু একজন বাংলাদেশী গায়ক, গিটারবাদক, গীতিকার, সুরকার, ও চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শিল্পী ছিলেন। এল আর বি ব্যান্ড দলের লীড গিটারবাদক এবং ভোকাল বাচ্চু ছিলেন বাংলাদেশের ব্যান্ডসঙ্গীত জগতের জনপ্রিয় ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের একজন। এর পূর্বে তিনি দশ বছর সোলস ব্যান্ডের সাথে লিড গিটারবাদক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। সঙ্গীতজগতে তার যাত্রা শুরু ফিলিংস ব্যান্ড দলের মাধ্যমে। তিনি তার শ্রোতা-ভক্তদের কাছে “এবি” নামেও পরিচিত। তার ডাক নাম রবিন। মূলত রক ঘরানার কন্ঠের অধিকারী হলেও আধুনিক গান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীত এবং লোকগীতি ঘরানায়ও তিনি কাজ করেছেন। আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালের ১৬ আগস্ট তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া উপজেলার খরনা ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেন। সঙ্গীতে তার আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াই স্কুলজীবনে নিজ চেষ্টায় গায়ক হয়ে ওঠেন। সত্তরের দশকে গিটার বাজাতে শুরু করেন এবং অচিরেই গিটারে দক্ষ হয়ে ওঠেন। চট্টগ্রামে কলেজ জীবনে সহপাঠী বন্ধুদের নিয়ে তিনি একটি ব্যান্ডদল গড়ে তোলেন। এর নাম ছিল ‘গোল্ডেন বয়েজ’। পরে নাম বদলে করা হয় ‘আগলি বয়েজ’। তারপর ফিলিংস ব্যান্ডের সাথে বাচ্চুর সঙ্গীতজগতে যাত্রা শুরু হয়। তার কন্ঠ দেয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। গানটির কথা লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী। আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম প্রকাশিত একক এ্যালবাম ‘রক্তগোলাপ’, যা তেমন সাফল্য পায় নি। বাচ্চুর সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক ময়নার মাধ্যমে। তিনি এল আর বি ব্যান্ড গঠন করেন ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল যার পুরো নাম লিটল রিভার ব্যান্ড, পরে করা হয় লাভ রানস ব্লাইন্ড। ব্যান্ডের সাথে তার প্রথম ব্যান্ড এ্যালবাম এবং বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত এ্যালবাম ‘এল আর বি’ প্রকাশিত হয়। এই এ্যালবামের শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি, ঘুম ভাঙ্গা শহরে, হকার গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। এরপর তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড এ্যালবাম সুখ ও তবুও বের হয়। সুখ এ্যালবামের সুখ, চলো বদলে যাই, রূপালি গিটার, গতকাল রাতে উল্লেখযোগ্য গান। চলো বদলে যাই বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতে অন্যতম জনপ্রিয় একটি গান। গানটির কথা লিখেছেন ও সুর করেছেন বাচ্চু নিজেই। এছাড়া তার তৃতীয় একক এ্যালবামটি ছিলো ‘কষ্ট’। সর্বকালের সেরা একক এ্যালবামের একটি বলে অভিহিত করা হয় এটিকে। এই এ্যালবামের প্রায় সবগুলো গানই জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে কষ্ট কাকে বলে, কষ্ট পেতে ভালোবাসি, অবাক হৃদয়, ও আমিও মানুষ। একই বছর তার চতুর্থ ব্যান্ড এ্যালবাম ঘুমন্ত শহরে প্রকাশিত হয়। তিনি অনেক বাংলা ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। অনন্ত প্রেম – তুমি দাও আমাকে বাংলা ছবির অন্যতম একটি জনপ্রিয় গান। এটি তাঁর গাওয়া প্রথম চলচ্চিত্রের গান।
গিটারে তিনি সারা ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত। জিমি হেন্ড্রিক্স এবং জো স্যাট্রিয়ানীর বাজনায় তিনি দারুনভাবে অণুপ্রাণিত। বাচ্চুর নিজের একটি স্টুডিও আছে। ঢাকার মগবাজারে অবস্থিত এই মিউজিক স্টুডিওটির নাম এবি কিচেন। তিনি ঈদের জন্য নির্মিত ট্রাফিক সিগন্যাল ও হলুদ বাতি শিরোনামের নাটকে অভিনয় করেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ‘টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ, ২০১৪’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ‘বিসিবি সেলিব্রেশন কনসার্ট’-এ অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন নিয়ে মাইলস ব্যান্ডের হামিন-এর সাথে বাচ্চুর বিরোধ সৃষ্টি হয়। এই দ্বন্দ্বের সূত্রে বাচ্চু ও তার ব্যান্ড এল আর বি বাংলাদেশ ব্যান্ড মিউজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বামবা) সদস্যপদ প্রত্যাহার করে।
আইয়ুব বাচ্চু ব্যক্তিগত জীবনে ফেরদৌস আইয়ুব চন্দনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের ফাইরুজ সাফরা ও আহনাফ তাজওয়ার নামে যথাক্রমে একজন কন্যা এবং পুত্র রয়েছে। আইয়ুব বাচ্চুর ফুসফুসে পানি জমার কারণে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন ২৭ নভেম্বর, ২০১২। সেখানে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি সুস্থ হন। কিন্তু তারপর ১৮ই অক্টোবর ২০১৮ সালে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। একই দিন সকালে অসুস্থবোধ করায় তাকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে ডাক্তাররা ৯টা ৫৫ মিনিটে তাকে মৃত ঘোষণা করেন। এভাবেই তিনি চিরদিনের জন্য চলে যান ওপারে।

শাম্মী আখতারঃ
শাম্মী আখতার বাংলাদেশের একজন নারী সঙ্গীত শিল্পী। ২০১০ সালে তিনি ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ চলচ্চিত্রে গানের জন্য শ্রেষ্ঠ নারী সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। শাম্মী আখতার ১৯৫৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর যশোরের তালতলা গ্রামে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু তিনি বেড়ে উঠেছেন খুলনায়। বাবার বদলির কারণে দেশের কয়েকটি জেলায় বিভিন্ন শিক্ষকের কাছে সঙ্গীতের তালিম নেওয়ার সুযোগ পান তিনি। ১৯৭৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি আকরামুল ইসলামের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
ছয় বছর বয়সে তাঁর সঙ্গীতজীবনের শুরু হয়। গানের জগতে তাঁর হাতেখড়ি হয় বরিশালের ওস্তাদ গৌরবাবুর কাছে। তাঁর বাবা শামসুল করিম সরকারি চাকরি করতেন। যার মধ্যে রাজবাড়ী ও খুলনায় সঙ্গীত শিক্ষা নেন বাবু বামনদাস গুহ রায়, রণজিৎ দেবনাথ, সাধন সরকার, নাসির হায়দার ও প্রাণবন্ধু সাহার কাছে।
১৯৭০ সালে তিনি খুলনা বেতারে তালিকাভুক্ত হন। সেখানে আধুনিক গানের পাশাপাশি নজরুল সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৭৫ সালে ঢাকায় এসে গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পান। খুলনা থেকে ঢাকায় চলে আসেন শাম্মী আখতার। নিয়মিত গাইতে শুরু করেন বেতার ও টেলিভিশনে। প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা তাঁকে ‘অশিক্ষিত’ চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার সুযোগ দেন। এতে গান গাওয়ার মধ্য দিয়ে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি। প্রথম প্লেব্যাকেই দারুণ জনপ্রিয় হয় তাঁর গাওয়া গান ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’।
তিনি প্রায় ৪০০টি ছবিতে প্লেব্যাক করেছেন। তার গাওয়া গানের দুটি ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে।। ‘ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না’ ছবির ‘ভালোবাসলেই সবার সাথে ঘর বাঁধা যায় না’ গানের জন্য ২০১০ সালে শাম্মী আখতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
ঢাকা শহর আইসা আমার, আমি তোমার বধু, চিঠি আসবে জানি আসবে, খেলিব প্রেমের পাশা, নেও গো আমারে কাছে ডেকে নেও, বধু যেদিন হইতে, তুমি আমার বন্ধু – পদ্মা মেঘনা যমুনা, ভালোবাসলেই ঘর বাঁধা যায় না, বিদেশ গিয়া বন্ধু তুমি আমায় ভুইলো না, মনে বড় আশা ছিল তোমাকে শুনাবো গান, এই রাত ডাকে ঐ চাঁদ ডাকে হায় তুমি কোথায়, আমার মনের বেদনা বন্ধু ছাড়া বুঝে না, খোদার পরে তোমায় আমি বড় বলে জানি, আমি যেমন আছি তেমন রবো বউ হবো না রে, আমার নায়ে পার হইতে লাগে ষোল আনা, ঝিলমিল ঝিলমিল করছে রাত ইত্যাদি।
তিনি প্রায় পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে স্তন ক্যান্সারের ভুগছিলেন। ১৬ জানুয়ারি ২০১৮, মঙ্গলবার বিকেলে তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতির হলে চামেলিবাগের বাসা থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৭ জানুয়ারি তাঁকে ঢাকার শাহজাহানপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

শিল্পী সাবা তানিঃ

আশি ও নব্বই দশকের শিল্পী সাবা তানি। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও মঞ্চে গান গেয়ে জনপ্রিয় হন শিল্পী সাবা তানি। তার গাওয়া কিছু গজল ওই সময় খুব প্রশংসিত হয়েছিল।
আশি ও নব্বই দশকের জনপ্রিয় সঙ্গীতশিল্পী সাবা তানি মারা গেছেন এই ১৮ সালেই। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহির রাজিউন। তার বয়স হয়েছিল ৪৯ বছর। তিনি মা, দুই ভাই, দুই বোন ও এক ছেলে রেখে গেছেন। সাবা তানি দীর্ঘদিন ধরে নিম্ন রক্তচাপে ভুগছিলেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি সোমবার সকালে রাজধানীর উত্তরার বাসায় বাথরুমে তাকে মৃতাবস্থায় পাওয়া যায়। খালাতো ভাই চিত্রনায়ক নাঈম গণমাধ্যমকে সাবা তানির মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
নাঈম তার পরিবার নিয়ে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি জানান, উত্তরার বাসায় মায়ের সঙ্গে থাকতেন সাবা তানি। ১৮ তারিখ রোববার মা নিউ ইস্কাটনে তার বড় বোনের বাসায় যান। রাতে তিনি সেখানেই ছিলেন। ঐ রাতে অনেকেই সাবা তানিকে ফোন করে পাননি। শেষে বাসার কেয়ারটেকারকে সঙ্গে নিয়ে দরজা ভেঙে আত্মীয়রা বাসায় ঢোকেন। তারা সাবা তানিকে বাথরুমের মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন। এভাবেই ১৮ সাল নিয়ে গেল শিল্পী সাবা তানিকেও।
সবার জন্য দোয়া ও মাঘফেরাত কামনা করি। সবাই স্বর্গবাসী হোক।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles