asd
Saturday, November 23, 2024

গানের পিছনের গল্প – “শোনো একটি মুজিবরের থেকে”…

প্রিয় পাঠক,
অভিনন্দন এবং ভালোবাসা নিবেদন করছি আপনাদের প্রতি। সঙ্গীতাঙ্গন এর উদ্দেশ্য সবসময়ই দেশের সকল সুরকার, গীতিকার, শিল্পী এবং সব ধরনের মিউজিসিয়ানদের পাশে থেকে আমাদের দেশীয় সঙ্গীতকে অনেক দুর এগিয়ে দুর নিয়ে যেতে। আমরা চাই সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে যেকোনো গানের আসল স্রষ্টা সম্পর্কে জানুক। এ জন্য আমরা সব সময় আপনাদের সহযোগীতা কামনা করছি।
কারণ দেশের একাধিক চ্যানেলে এ প্রজন্মের শিল্পীরা গানটির স্রষ্টাদের নাম না বলতে পেরে সংগ্রহ বলে থাকেন। এতে গানের মূল স্রষ্টা ব্যথিত হোন, এমন অনেক অভিযোগ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। তাই একটি গানের মূল স্রষ্টাকে পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে আমরা বহুদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছি, শুধুমাত্র সঙ্গীতকে ভালোবেসে। এবারের বিষয় ‘একটি গানের পিছনের গল্প’ আমাদের অনেক প্রিয় একজন সঙ্গীতপ্রেমী ভাই জনাব মীর শাহ্‌নেওয়াজ সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধ্যমে জানাবেন আমাদের প্রিয় গানের পিছনের গল্প। এবং দেশের বরেণ্য সকল শ্রদ্ধাভাজন শিল্পীগন আপনারাও নিজ দায়িত্বে সঙ্গীতাঙ্গনের মাধ্যমে জানাতে পারেন আপনার নিজ সৃষ্টি অথবা আপনার প্রিয় গানের গল্প। এতে আর এ প্রজন্মের শিল্পীরা ভুল করবেন না গানের স্রষ্টাকে চিনতে।
আসুন সবাই গানের সঠিক ইতিহাস জানতে একতা গড়ি। – সম্পাদক

– তথ্য সংগ্রহীত লেখক – মীর শাহ্‌নেওয়াজ…

শিল্পীঃ অংশুমান রায়
সুরকারঃ দীনেন্দ্র চৌধুরী
গীতিকারঃ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার

বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে কারাগারে নিঃসঙ্গ। ফাঁসির মঞ্চ তৈরি। কবরও খোঁড়া হয়েছে। বিচারের নামে প্রহসনপর্বও চলছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন সাড়ে সাত কোটি বাঙালিসহ বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাছে এক অনুপ্রেরণার নাম। বঙ্গবন্ধুর নামে বাঙালি যুদ্ধজয়ের মনোরথের ধ্বজা উড়িয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেই মার্চেই পথ দেখিয়েছিলেন। তাই স্লোগান উঠেছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে তুমুল তুখোড় যুদ্ধ চালিয়েছে।

বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা ও সহায়তার জন্য তখন এগিয়ে এসেছিলো পশ্চিমবঙ্গের গ্রামোফোন রেকর্ড কোম্পানিগুলো। এইচএমভি, হিন্দুস্তান রেকর্ডস্, টুইন রেকর্ড, কলম্বিয়া, পলিডর, সেনোলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গান, কবিতা, নাটক ও যাত্রাপালার রেকর্ড প্রকাশ করেছিল। একাত্তর সালের জুন মাসে গ্রামোফোন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের উপর গান তৈরির জন্য গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীদের অনুরোধ জানায়। বাংলা গানের নামীদামী শিল্পী, সুরকার, গীতিকাররাও এগিয়ে এসেছিলেন।

একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও বেজেছে কোলকাতার শিল্পী অংশুমান রায়ের গাওয়া, ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে’। গানটি ছিল বঙ্গবন্ধু’র স্বাধীনতার ঘোষণার উপর। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে যেসব গ্রামোফোন রেকর্ড বাজানো হয়েছে, তা ঢাকায় উৎপাদিত ছিল। তবে কেবল বাপি লাহিড়ীর সুরে, শ্যামল গুপ্তের লেখা এবং আবদুল জব্বারের গাওয়া ‘হাজার বছর পরে’ এবং ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম’ গান দুটি বাজানো হয়েছিল। যার প্রকাশক ছিলো এইচএমভি।

একাত্তরের এপ্রিল মাসে এইচএমভি থেকে গান রেকর্ড করার অনুমতি পেয়ে শিল্পী অংশুমান রায় শরণাপন্ন হলেন খ্যাতনামা গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের। অংশুমানের অনুরোধে গৌরীপ্রসন্ন লিখলেন বাঙালির সেই বিখ্যাত চিরসবুজ চিরঞ্জয়ী গান ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে উঠে রণি।’ কলকাতার একটি চায়ের দোকানে বসে গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন চেইন স্মোকার অংশুমানের কাছ থেকে চারমিনার সিগারেট প্যাকেট নিয়ে তার উপর লিখলেন গানের প্রথম চারটি লাইন। তৎক্ষণাৎই অংশুমান রায় গান নিয়ে সুরকার ও সংগীত পরিচালক দীনেন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে বসে চারটি লাইনে সুর তৈরি করেন। যে গান চল্লিশ বছর পর আজও প্রাণে তুফান তোলে। উদ্দীপনা জাগায়। মনে আনে যুদ্ধদিনের দৃশ্য। চোখে ভাসে ৭ মার্চের ভাষণ।

১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে পুরো গানটি রেকর্ড করার সময় বিপাকে পড়েন অংশুমান অপর পিঠের গান নিয়ে। উদ্ধার করলেন আবারো গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। সুর কথা ঠিক রেখে গানটির ইংরেজি ভার্সন তৈরি করলেন। এইচএমভি ইংরেজি ভার্সনে নারীকণ্ঠ সংযোজনের পরামর্শ দেয়। করবীনাথ নামে একজন শিল্পী তখন মঞ্চে ইংরেজি গান গাইতেন। দীনেন্দ্র চৌধুরী তাকেই বেছে নেন। তারপর তৈরি হলো গানটির ইংরেজি ভার্সন ‘মিলিয়ন মুজিবরস সিংগিং’ খুব দ্রুতলয়ে গানটি গাওয়া হয়েছে। গানটির রেকর্ড বিক্রি হয়েছিল প্রচুর পরিমাণে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশেও এই গানের রেকর্ড বিক্রি হয়েছে। ইংরেজি গানটি আজকাল আর শোনা যায় না। বেতারে টিভিতে বাংলাটিই বাজানো হয়। অথচ ইংরেজি ভার্সনটি বাজানো হলে বিদেশী শ্রোতাদের কাছেও গানটি জনপ্রিয় হতো। কারণ এই গানে আছে বাংলার সেই সব শিক্ষিত মানুষদের কথা, যারা এই বাংলাকে দেখেছেন সোনার বাংলা, রূপসী বাংলা। আর বঙ্গবন্ধু এনে দিলেন জয় বাংলা। একাত্তরে শরণার্থী শিবিরে, মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পে গানটি বেজেছে তখন। আকাশবাণী থেকে প্রথম গানটি প্রচারিত হয় ‘সংবাদ বিচিত্রা’ নামে একটি অনুষ্ঠানে। উপেন তরফদার ছিলেন যিনি অনুষ্ঠান প্রযোজক, তিনি গানটি তৈরি হবার পর হারমোনিয়াম সহযোগে গাওয়া অংশুমানের কণ্ঠে গানটি টেপ রেকর্ডারে ধারণ করে তা প্রচার করেছিলেন একাত্তরের জুলাই মাসে। স্বাধীনতার পর ঢাকা বেতারের বিশ্বসংগীত অনুষ্ঠানে ও বহির্বিশ্ব কার্যক্রমে গানটির ইংরেজি ভার্সন বাজানো হয়েছে।

‘শোন একটি মুজিবুরের রক্ত থেকে লক্ষ্য মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি’ গানের স্রষ্টা খ্যাতিমান গৌরীপ্রসন্নর শেকড় বাংলাদেশের পাবনাতে। তার পিতা হরিপ্রসন্ন মজুমদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার পর বিজ্ঞান অনুষদে অধ্যাপনা করেছেন। বাল্যকালে সংগীতচর্চা শুরু। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে সুরকার অনুপম ঘটকের কাছে গান শিখেছেন। প্রিয়শিল্পী ছিলেন শচীনদেব বর্মণ ও আব্বাসউদ্দিন আহমদ। তাদের গানের জলসার নিয়মিত শ্রোতা ছিলেন। সে সুবাদে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে শচীনদেব বর্মণের সঙ্গে। ভেবেছিলেন অক্সফোর্ডে পড়াশোনা করবেন, পিতার মতোই অধ্যাপনা বেছে নেবেন। কিন্তু শচীন কর্তা তাকে যেন বেঁধে দিলে আষ্টেপৃষ্ঠে গানের জগতে। কিন্তু ছিলেন তিনি বাঁধন হারা। গানপাগল হলেও গায়ক হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশে আগ্রহী ছিলেন না। শচীন কর্তার অনুরোধে গান লেখা শুরু, তারপর আর থেমে থাকেন নি।

এখনো দশ জানুয়ারি, চবি্বশ জানুয়ারি, একুশ ফেব্রুয়ারি, সাত মার্চ, সতের মার্চ, ছাবি্বশ মার্চ, পনের আগস্ট, ষোল ডিসেম্বরের বিশেষ দিনগুলোতে যখন বেজে ওঠে অমর সেই গান ‘শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বর’ শ্রুতি গোচর হয় বাঙালির। প্রাণে প্রাণে যেন সাড়া জাগে, ভেতর থেকে গেয়ে ওঠে যেন, ‘লক্ষ মুজিব জন্ম নেবে।’ বাঙালি জাতি তার মুক্তিসংগ্রামে বাংলার মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য গৌরীপ্রসন্ন
মজুমদার, অংশুমান রায়, দীনেদ্র চৌধুরী ও করবীনাথ যে মহৎ সৃষ্টি রেখে গেছেন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বাংলাভাষী মানুষদের যে সহায়তা ও অবদান বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তির ইতিহাসে সন্নিবেশিত থাকাই যুক্তিযুক্ত।

“শোন একটি মুজিবরের থেকে
লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণী
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।।

এই সবুজের বুকে চেরা মেঠো পথে
আবার যে যাব ফিরে, আমার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
শিল্পে-কাব্যে কোথায় আছে
হায়রে এমন সোনার খনি।।

বিশ্ব কবির ‘সোনার বাংলা’,
নজরুলের ‘বাংলাদেশ’,
জীবনানন্দের ‘রূপসী বাংলা’
রূপের যে তার নেই কো শেষ, বাংলাদেশ।

জয় বাংলা বলতে মন রে আমার
এখনও কেন ভাবো আবার
হারানো বাংলাকে আবার তো ফিরে পাব
অন্ধকারে পূর্বাকাশে, উঠবে আবার দিনমণি।।”

অলংকরন – গোলাম সাকলাইন…

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles