– শাহরিয়ার খান সাকিব।
লাকী আখন্দ ১৯৫৬ সালের ১৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পাতলা খান লেনে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ বছর বয়সেই তিনি তার বাবা এ কে আবদুল হকের কাছ থেকে সঙ্গীত বিষয়ে হাতেখড়ি নেন। ১৯৬৩ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত টেলিভিশন এবং রেডিওতে শিশু শিল্পী হিসেবে সঙ্গীত বিষয়ক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন তিনি। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই এইচএমভি পাকিস্তানের সুরকার এবং ১৬ বছর বয়সে এইচএমভি ভারতের সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম যুক্ত করেন লাকী আখন্দ। তার সাথে ভাই হ্যাপি আখন্দও তখন সঙ্গীতচর্চা করতেন, প্রায় একসাথেই পথচলা ছিল তাদের। নিজে যা শিখতেন, হ্যাপিকে শিখিয়ে দিতে চাইতেন তিনি। আর তাই ভাইয়ের সাথে আবেগীয় জায়গা থেকে অনেক বেশি কাছে ছিলেন লাকী। নব্বইয়ের দশকে লাকী আখন্দের সুরে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি গেয়ে সুনাম করেছিলেন কুমার বিশ্বজিৎ। গানের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও প্রায় চল্লিশ বছরের পরিচয় ছিল তাদের। তাই লাকীর জন্মদিনে কথা হয় বিশ্বজিত এর সাথে। লাকী আখন্দের যে গানটি তিনি গেয়েছেন তার বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন বসতো একজন কিংবদন্তি। তার বিষয়ে কিছু বলার সাহস আমার আছে নাকি ?
সত্যি বলতে আমি বসকে ভয় পেতাম। তারপরও হুটহাট করে কিছু বলে দিতাম। লাকী ভাইতো বড় দিলের মানুষ। তার সাথে কাজ করার ভাগ্য বলা যায় না, সৌভাগ্য আমার। প্রথম জীবনে আমার সাথে তার তেমন একটা পরিচয় ছিল না। তার ছোট ভাই হ্যাপি আখন্দের সাথে আমার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। হ্যাপি আখন্দের সাথেই আমি প্রথমে লাকী আখন্দের বাড়িতে যাই এবং সেখানে তার সাথে আমার পরিচয়।
একটা এ্যালবামে চারটা গান ছিল সেই গানগুলো কম্পোজিশনের জন্য উনার সাথে গিয়েছিলাম তার বাসায়। কি বলবো পুরোনো সেই ঘটনার কথা মনে হলে এখনো মনে হয় যেন লাকী ভাই এখনো আছেন। সেই ‘৮১ সালের ঘটনা যখন আমি আর হ্যাপি ফ্লোরে ঘুমাতাম, লাকী ভাই বেডে ঘুমাতেন। বসের বাবা তখন বেঁচে ছিলেন। আমি ওনাকে চাচা চাচা বলে ডাকতাম। আমাকে খুব ভালোবাসতো। উনি অন্য রুমে ঘুমাতেন। পনেরো বিশ দিন পর গানগুলোর রেকর্ড হলো। সেই থেকেই ওনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। সঙ্গীত সাধনার শুরুতেই যাদের পেয়েছি তাদেরকে আমি সবার উর্ধ্বে রেখেছি। লাকী ভাইকে সবার উর্ধ্বে রাখি আমি।
পরে ওনার সুরে ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ গানটি গেয়ে তো দারুণ সাড়া পেলাম। গানটা ওনার প্রতি আমার ঋণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। সেই কাহিনী আরো মজার। ‘৯০এর কথা বলছি, মুসা আহমেদের একটা অনুষ্ঠান ছিল সেটা ছিলো বিটিভিতে। অনুষ্ঠানের নামটা ভুলে গেছি। মুসা ভাই বললেন, দুইটা গান করতে হবে। টেলিভিশনে তেমন আয়োজন করতে পারব না। যদি পারো নিজের খরচে করো। আমি রাজি হলাম। গান দুটি কথা ছিল কাওসার আহমেদ চৌধুরীর। দু’টি গানের একটা ছিল যেখানে সীমান্ত তোমার। লাকী ভাই কিন্তু প্রচণ্ড আবেগি এবং উদাসী। অনেক চেষ্টায় উনাকে পাওয়া যেত। কারণ সত্যিকারের শিল্পীর খুবই দাম ছিল তখন। এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে গানটির তিনি সুর করে দিলেন এবং সঙ্গে গানে উনি মুখ দিয়ে পিচ করলেন। সেই মুখের পিচটা কিন্তু বাংলাদেশের কোনো গানে প্রথম ব্যবহার করা হয়। এ্যালভিস স্টুডিওতে গানটি রেকর্ডিং হয়। দুঃখের বিষয় হলো গানটি টেলিভিশনে গিয়েছে কিন্তু তাতে কিছুই হয়নি। ‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ সহ আরো কয়েকটা গান নিয়ে তারপরে এ্যালবাম করা হয়। তারপরইতো গানটা ইতিহাস হয়ে গেল। রাতারাতি আমি হয়ে গেলাম গায়ক। বসের মধ্যে একটা উদাসীন ভাব ছিলো ওনাকে বলতাম, আমাকে একটা গান দেন। উনি বলতেন, ‘দাঁড়াও, নতুন গান বানাই।’ বানাতে বানাতে হঠাৎ বলতেন, ‘আজকে মুড নাই বিশ্ব’। পরে আসো একদিন। তখন আমি আবার একটু বেঁকে বসতাম। বলতাম, ‘পুরানো গাট্টি থেকে কিছু গান দেন না ভাই। এমন করেন কেন ? লাকি ভাই একটু মুখটা অন্যরকম করে বলতেন, ‘আরে এগুলো না, তোমার জন্য নতুন করে বানাব। আমাকে বুঝাতেন যে গান আছে তার থেকে ভালো গান বানাবেন। তিনি বলতেন বিশ্ব আমি এক’শটা ভায়োলিন ইউজ করে তোমার জন্য একটা গান করব। লন্ডন থেকে মিউজিশিয়ান আনাবো। আমরা এখন যেটা করেছি, সেটা উনি ভেবেছেন আশির দশকে। এই দেশে জন্ম না হলে ইউরোপ-আমেরিকায় উনার জন্ম হলে জানি না ওনার অবস্থান কোথায় থাকত। আমার যে গানটিতে আমি বেশি জনপ্রিয় হয়েছি সেটা হলো ‘তোরে পুতুলের মতো করে সাজিয়ে, হৃদয়ের কোঠরে রাখবো’ এইগানটি নিয়ে অনেক কথা আছে। সময় পেলে আরেকদিন এ নিয়ে কথা হবে। এই গানটিও লাকী ভাই এর। আজকের এই দিনে সঙ্গীতাঙ্গন এর মাধম্যে লাকী ভাইকে স্মরণ করা হয়েছে। খুবই খুশি হয়েছি আমি। বসের প্রতি আবারো শ্রদ্ধা জানাই। সবার জন্য নিরাপদ জীবনের শুভ কামনা।