– শাহরিয়ার খান সাকিব।
আজম তুমি গায়কে আজম
অভিনয়ে হিরো,
মুক্তিযুদ্ধে সাহসী বীর তুমি
নও তো তুমি ভীরু।
মডেলদের মডেল ছিলে তুমি
ক্রিকেট খেলতে ভালো,
পপ রাজত্বে সম্রাট ছিলে তুমি
তুমি ব্যান্ড সঙ্গীতের আলো।
ব্যান্ড সঙ্গীতের অগ্র নায়ক তুমি
গুরু তোমার নাম,
তুমি এসে বাড়িয়েছো পপ গুরু
ব্যান্ড সঙ্গীতের দাম।
তুমি লিখতে, তুমি গাইতে গুরু
দিতে সুরের মায়াজাল,
তোমার গানে স্থান পেয়েছে গুরু
পাড়ার বোকা রঙ্গপাল।
যাদের সাথে তুমি চলতে গুরু
তাদের মুখের কথা,
ব্যাক্তিত্বে অমায়িক তুমি গুরু
তুমি ছিলে সাদামাটা,
পপ সম্রাট আজম খান। নামের সাথে কর্মের কত মিল। আজম শব্দের অর্থ শ্রেষ্ট, উত্তম, সবার উপরে। বাস্তবিক অর্থে আজম খান সব বিষয়ে ছিলেন আজম। তাই তাকে ভালোবেসে নামান্তর করেছেন গুরু হিসেবে। সঙ্গীতশিল্পী, অভিনেতা, ক্রিকেটার ও বিজ্ঞাপনের মডেল ছিলেন আজম খান। তাঁকে বাংলাদেশের পপ ও ব্যান্ড সঙ্গীতের একজন অগ্রপথিক বা গুরু হিসেবে গণ্য করা হয়। তাঁর গানের বিশেষত্ব ছিল পশ্চিমা ধাঁচের পপগানে দেশজ বিষয়ের সংযোজন ও পরিবেশনার স্বতন্ত্ররীতি। রেল লাইনের ঐ বস্তিতে, ওরে সালেকা ওরে মালেকা, আলাল ও দুলাল, অনামিকা, অভিমানী, আসি আসি বলে ইত্যাদি গানগুলো আজমখানকে বাচিঁয়ে রাখবেন অনন্তকাল। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় সংঘটিত কয়েকটি গেরিলা অভিযানে তিনি অংশ নেন। প্রথম কনসার্ট প্রদর্শিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে ১৯৭২ সালে। সঙ্গীতে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে বলে জানান ফিডব্যাক এর ফুয়াদ নাসের বাবু।
তিনি একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। শুধু গায়ক হিসেবে নয় ব্যাক্তি হিসেবেও তিনি নাম্বার ওয়ান পারসন বলে অবহিত করেন মিউজিশিয়ান হাবলু। তিনি যখন রাস্তা দিয়ে চলতো, সিগেরেট খেতে দোকানে যেতো তখন তাকে দেখা যেতো একটা লুঙ্গি ও শার্ট পড়ে যেতেন। এক কথায় এতই সরল সহজ জীবন যাপন করতেন, কল্পনা করা যায় না যে, এত বড় মাপের একজন মানুষ এতোটা সাধারণ জীবন যাপন করেন। যে মানুষটা তাকে চিনে না সে কোনদিনও বুঝতে পারবেনা আজম খান নামে যিনি পপ সম্রাট তিনিই এই ব্যাক্তি। তার এমন সাদামাটা জীবন সত্যিই মহৎ ব্যাক্তিত্বের পরিচয় বহন করেন। তিনি আইডলদের আইডল। এমনই বলেন পিয়ারো খান। তিনি আরো বলেন তার মনটা ছিলো আকাশের মতোই বিশাল। তার মনে ছিলোনা কোন লোভ। সমাজে উঁচু -নিচু বলতে কার কাছে কিছু ছিলোনা। সবাইকে তিনি সমান চোখে দেখতেন।
আজম খানের জন্ম ঢাকার আজিমপুরে। এখানেও কতটা মিল। আজিমপুরে জন্ম বলে হয়তো আজম খান নামটি রাখা হয়েছে। তার বাবা সরকারি কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে তাঁর ছেলেবেলা কাটে আজিমপুরের ১০ নম্বর সরকারি কোয়ার্টারে। ১৯৫৫ সালে তিনি প্রথমে আজিমপুরের ঢাকেশ্বরী স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫৬ সালে তাঁর বাবা কমলাপুরে বাড়ি বানান। এরপর থেকে সেখানে বসতি তাঁদের। সেখানে তিনি কমলাপুরের প্রভেনশিয়াল স্কুলে প্রাথমিক স্তরে এসে ভর্তি হন। তারপর ১৯৬৫ সালে সিদ্ধেশ্বরী হাইস্কুলে বাণিজ্য বিভাগে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকে ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭০ সালে টি অ্যান্ড টি কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। মুক্তিযুদ্ধের পর পড়ালেখায় আর অগ্রসর হতে পারেননি। জনপ্রিয় গিটারিস্ট লাবু রহমান তার স্মৃতি চারণায় বলেন, আজম খান খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তার সাথে বাজিয়েছি দুই বছরের মতো। ১৯৭৭/৭৮ এই দুই বছর তার সাথে কাজ করেছি। আমরা প্রতি সপ্তাহে একবার করে ঢাকার বাইরে পিকনিক করতে যেতাম। সারাদিন ঘুরতাম, গান করতাম, আনন্দ করতাম। অনেক গানের কাজ করেছি আমি। তারমধ্যে অভিমানী, আলাল ও দুলাল, দিদিমা, বাংলাদেশ বাংলাদেশ, ফেলে আসা দিন গুলো পিছু ডাকে, কেউ নাই আমার, আর দেখো না, ব্যস্ত ভবঘুরে, আর গাইবো না গান, থাকবো না যেদিন, রকস্টার, বর্ষাকাল, ব্যস্ত ভবঘুরে, কাজ করতে গিয়ে তাকে কোনদিন রেগে যেতে দেখিনি। তার মেজাজটা সব সময় ভালো থাকতো। আজম খান সব সময় দেরি করে ঘুম থেকে ওঠতো। তাই প্রতিদিন আমি আগেই তার বাসায় চলে যেতাম। সকালে গিয়ে আমি তাকে ঘুম থেকে ওঠাতাম। তারপর সারাদিন প্র্যাকটিস করে বিকেলে চলে আসতাম। তার সাথে একদিন বিটিভিতে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। সেখানে গানের সাথে বাজিয়েছি। তারপর বলতে গেলে দুই বছরের মধ্যে আমিই তার সব গানে বাজিয়েছি। অনেক গান কম্পোজিশন করেছি। যখনই নতুন কোন গান হতো, তখনই আজম ভাই বলতো যে লাবুকে ডাকো। আমার গানে লাবু বাজাবে। আসলে একটি বিষয় আমাকে এখনো আন্দলিত করে যে তার সাথে যখন বাজাতাম, তখন তার গানের ধাচঁ এখনো মনে হয় যেনো সেটা রয়ে গেছে আমার বাজানোতে। আজম খানের গানের যে কর্ড, তা অতি সহজ ছিলো। অনেক সাধারণ কর্ডে তিনি গান করতেন। সহজ ভাষা ব্যবহার হতো। তাই খুব তাড়াতাড়ি তিনি মানুষের মনে ডুকে পড়েছিলেন। তার গান সবাই গাইতে পারতো। আমি এখনো তাকে খুবই মিস করি। যতদিন বাচঁবো তাকে মিস করবো। কেন নয় তার মত একটা মানুষ হয়না।
কর্মজীবনের শুরু প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকের শুরুতে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের পর ১৯৭২ সালে তিনি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ড গঠন করেন। তাঁর ব্যান্ড ‘উচ্চারণ’ এবং ‘আখন্দ’ দেশব্যাপী সঙ্গীতের জগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে। বন্ধু নিলু আর মনসুরকে গিটারে, সাদেক ড্রামে আর নিজেকে প্রধান ভোকালিস্ট করে অনুষ্ঠান করেছেন। ১৯৭২ সালে বিটিভিতে সেই অনুষ্ঠানের এতো সুন্দর দুনিয়ায় কিছুই রবে না রে ও চার কালেমা সাক্ষী দেবে গান দু’টি সরাসরি প্রচার হয়। ব্যাপক প্রশংসা আর তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দিলো এ দুটো গান। দেশজুড়ে পরিচিতি পেয়ে গেলো তাঁদের দল।
১৯৭৪-১৯৭৫ সালের দিকে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে রেললাইনের ঐ বস্তিতে শিরোনামের গান গেয়ে হৈ-চৈ ফেলে দেন। তাঁর পাড়ার বন্ধু ছিলেন ফিরোজ সাঁই। পরবর্তীকালে তাঁর মাধ্যমে পরিচিত হন ফকির আলমগীর, ফেরদৌস ওয়াহিদ, পিলু মমতাজের সাথে। এক সাথে বেশ কয়েকটা জনপ্রিয় গান করেন তাঁরা। এরই মধ্যে আরেক বন্ধু ইশতিয়াকের পরামর্শে সৃষ্টি করেন একটি এসিড-রক ঘরানার গান জীবনে কিছু পাবোনা এ হে হে! তিনি দাবি করেন, এটি বাংলা গানের ইতিহাসে- প্রথম হার্ডরক। এ বিষয়ে পিয়ারো খান বলেন, আমরা যখন কাজ শেষ করতাম তখন সবাই এই গানটা গাইতাম। আজম খান তার শরীরের সব শক্তি দিয়ে গাইতেন তিনি। আমরাও গানটি তার সাথে গেয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়তাম। তার চলে যাবার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে সে বিষয়ে লাবু রহমান, পিয়ারু খান ও ফুয়াদ নাসের বাবু বলেন, বাংলাদেশে আর কোনদিন একটি আজম খান আসবেনা। আজম খান সর্বকালের জন্য একটাই। তার চলে যাওয়া পপ সঙ্গীতে একটা বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। শুধু পপ সঙ্গীতে নয় শূন্যতা আমাদের মনেও।
সেই পপসম্রাট আজম খান দীর্ঘদিন দুরারোগ্য ক্যান্সার ব্যাধির সাথে লড়াই করে ৫ই জুন, ২০১১ইং তারিখ, রবিবার সকাল ১০টা বেজে ২০ মিনিটে ঢাকাস্থ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আজ তার ৯মতম মৃত্যুবার্ষিকী। সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে তার জন্য প্রার্থনা জানাই ভালো থাকুক সে ঐ পারে।