– মোশারফ হোসেন।
ভুলিনি আপনারে হয়েছে গত
অনেক কাল তব,
আপনারে পড়ে বারং বার জাতি
আছেন এখনো নব।
বে-দিশার জোস ফেরে আপনাতে
আপনার কথা পড়ে,
ন্যায়ের পথে লড়ে তব না হটে পিছু
কবিতার বাক্য নড়ে।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ তার ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। তার বিদায়ী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। সব্যসাচী এই মানুষটিকে নিয়ে দুই বাংলার মানুষই ভারী কৌতূহলী। তার ভালো মন্দের সমালোচনা পর্যালোচনা বিশ্লেষণ সব সময়ই হয়ে আসছে। সঙ্গীতাঙ্গন এর আজকের বিশ্লেষণ তার জীবনের এক অমৃত্য সত্যি ভাবনা নিয়ে। তার ভাবনা আর বাস্তবতা যেনো একই সূতোয় বাঁধা। তার বিদায়ী দিনে সেই ভাবনার স্মৃতিচারণ করবো।
একদিনের কথা, কবি খুব ব্যাস্ত সময় পার করছেন। গান লেখা, সুর করা, শিখিয়ে দেয়া, রেকর্ডিং করা সব মিলিয়ে খুবই ব্যাস্ততা। তার গানগুলোর বেশি ভাগ গেয়েছেন কে মল্লিক। সেই শুবাদে একদিন এই কে মল্লিকের কাছে এক লোক এলো। লোকটির নাম প্রফেসর জি দাস। এসে ধরল মল্লিককে, সে গান গাইতে চায়। গান গাইতে হলে তো পরীক্ষা দিতে হবে কোম্পানিতে, পরীক্ষা নেয়া হলো। ফলাফল, একেবারে অচল! গান নেওয়া হবে না শুনে ওখানেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠলেন বেচারা প্রফেসর। কে মল্লিক যতই সান্তনা দেন, বেচারা ততই কাঁদেন। আওয়াজ শুনে এলেন গ্রামোফোন কোম্পানির বড়বাবু। তিনি সব শুনে প্রফেসরকে বললেন, আপনার গলা এখনও ঠিক হয়নি। সুর-তাল-লয় ঠিক থাকছেনা, ক’দিন পর আসুন, দেখা যাক কী হয়।
প্রফেসর লোকটি তখন বড়বাবুর কাছে কয়েকজনের নামে বিচার দিলেন। বললেন তাকে ফুঁসলিয়ে মিষ্টি খেয়ে নিয়েছে তার কাছ থেকে গান গওয়ার সুযোগ করে দেবে বলে। ওরা নাকি তাকে এও বলেছে যে তোমার গলা ভাল হলেও কে মল্লিক হিংসা করে তোমাকে গান গাইতে দিবে না। বড়বাবু বুঝলেন যে বেচারা খুব সরল মানুষ, তাকে যেভাবে বুঝানো হয়েছে সে বুঝেছে। প্রফেসরের কান্না আর থামছে না।
এমন সময় রুমে ঢুকলেন কাজী নজরুল। কী ব্যাপার ? বলে তিনি মনোযোগী হলেন কান্নাকাটির কারণ জানতে। বড়বাবু আর কে মল্লিক তাকে সব খুলে বললেন। কবি তখন বললেন, বেচারা থেকে রেকর্ডের আশ্বাস দিয়ে যখন মিষ্টি খাওয়া হয়েছে, অতএব তার একটা গান রেকর্ড করতেই হবে।
কে মল্লিক বললেন, আরে কাজীদা, কী বলছেন আপনি ? দেখছেন না লোকটা একজন পাগল।
কবি উত্তর দিলেন, ‘আরে মল্লিক, আমরা বাঙালীরাও কিন্তু কম হুজুগে নই, দেশটাও হুজুগে।’ এই বলে কবি প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘শোনো, তুমি কাল এসো, তোমাকে শিখিয়ে আমি রেকর্ড করিয়ে নিব। কবি নজরুল বলে কথা। মল্লিক আর বড়বাবু তাকে ভাল করেই জানেন। কাজেই সবাই পরবর্তী কান্ড তামাশা দেখার অপেক্ষায় থাকলেন। কবি গান রেকর্ডের সব ব্যবস্থা করলেন। গান লেখা হলো, কবি প্রফেসরকে বললেন যে এই গানের কথা যেন কেউ জানতে না পারে, যখন গান বাজারে আসবে তখনই শোনা যাবে প্রথম। রেকর্ডের সব ঠিকঠাক করে কবি বললেন, আচ্ছা, এবার গান ধরো- গানটি ছিলো এমন-
কলা গাড়ি যায় ভষড় ভষড়
ছ্যাকরা গাড়ী যায় খচাং খচ
ইচিং বিচিং জামাই চিচিং
কুলকুচি দেয় করে ফচ…’
অদ্ভুত এমন গান শুনে উপস্থিত বাকি দুজন অদ্ভুত রকম ভাবে ওখানেই হাসতে লাগলেন, কবির কান্ড দেখে তারা ততক্ষণে খেই হারিয়ে ফেলছেন। পরের দিন এর আরেক জোড়া লিখে আনলেন কবি, এবার অপর পিঠে রেকর্ড করালেন-
মরি হায় হায় হায়,
কুব্জার কী রুপের বাহার দেখো।
তারে চিৎ করলে হয় যে ডোঙা
উপুড় করলে হয় সাঁকো।
হরি ঘোষের চার নম্বর খুঁটো,
মরি হায় হায় হায়…’
এ গানে প্রফেসরকে যে চতুষ্পদ বানানো হচ্ছে, তাও কেউ টের পেল না। খুব উৎসাহে প্রফেসর রিহার্সাল করতে থাকল। রেকর্ডিং ম্যানেজারকেও জানানো হলো না, কী গান কাকে দিয়ে রেকর্ড হচ্ছে। চরম গোপনে গান দুটো রেকর্ড হল, তারপর বাজারে ছাড়া হল।
বাজারে প্রকাশিত হওয়ার দু’একদিন পর কবি মল্লিককে ডেকে বললেন, একটু দেখে আসুন তো বাজার থেকে, কেমন বিক্রি হচ্ছে গান দুটো ?
বাজারে খোঁজ নিয়ে এসে মল্লিক হাসতে হাসতে বললেন কবিকে, কাজীদা, খুব বিক্রি হচ্ছে অদ্ভুত গান দুটো। ক্রেতারা কিনছে আর গাইছে, কলা গাড়ী যায় ভষড় ভষড়…’
কোম্পানির ম্যানেজার তো দারুণ খুশী। বড়বাবুকে ডেকে বললেন, ‘তুমি তো বলেছিলে, লোকটি পাগল। ওর গান তো বেশ সেল হচ্ছে, আরও দু একটা নাও না ওর গলায়…’
মল্লিক সাহেব দৌড়ে গিয়ে কাজীকে কর্তার প্রস্তাব জানালেন। কবি হাসতে হাসতে বললেন, মল্লিক সাহেব, এবার কিন্তু গালাগাল খেতে হবে, হুজুগে দেশে এসব একবারই চলে। বলেই আবার জোরে হাসিতে ফেটে পড়লেন কাজী নজরুল ইসলাম। যদিও এখানে হাসির খুরাকি ছিলো, কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি এমনই চলছে। আজকের এই দিনে কবিকে ও তার কর্মকে সম্মানের সঙ্গে স্মরণ করি।