– মারজানা শেখ।
৭ জানুয়ারি ১৯২২। সকাল বেলা ‘বিজলী’ পত্রিকার চারটি কপি হাতে করে জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির সামনে হাজির কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তখন তার বয়স মাত্র ২৩। ‘গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি আপনাকে হত্যা করব, গুরুজি, গুরুজি’ বলে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিমায় চিৎকার করছেন নজরুল।
শান্ত ও ধ্যান গম্ভীর ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি গিয়ে অমন করে চিৎকার করা বা বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে চেঁচানো যে কারও জন্য বেমানান ছিল, তবুও নজরুল স্বভাবসুলভ আচরণে সেদিন তা করে দেখিয়েছিলেন। অথচ জোড়াসাঁকো পুরো বাড়িটাই ছিল শান্ত, স্নিগ্ধ, সুন্দর আর রমণীয়। বাঘা বাঘা লোক, পণ্ডিত-মনীষী সংযতভাবে ওই বাড়িতে ঢুকতেন, দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়তেন বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কথা বলার সময়। কেউ কখনো একটু সময়ের জন্যও অসংলগ্ন আচরণ করতেন না। চিৎকার চেঁচামেচি তো দূরের কথা।
নজরুল সেদিন ঠাকুর বাড়ির এই শান্ত সমাহিত নীরব পরিবেশ ভঙ্গ করে অকম্পিত কণ্ঠে চিৎকার করে গুরুজি, আপনাকে হত্যা করব, ইত্যাকার দম্ভোক্তি করে মহা হুলুস্থুল কাণ্ড বাধিয়েছিলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ একটু বিরক্ত বা বিব্রতবোধ করেননি, বিন্দুমাত্র অসন্তুষ্ট হননি।
রবীন্দ্রনাথ উপর থেকে বললেন, ‘কী হয়েছে ? ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন ? এসো, উপরে এসে বসো?’ এবার ‘বিজলী’ হাতে উপরে উঠলেন নজরুল। রবীন্দ্রনাথকে সামনে বসিয়ে বিচিত্র ভঙ্গিমায় বিদ্রোহী কবিতাটি শুনিয়ে দিলেন- যা আগের দিন ছাপা হয়েছে বিজলী পত্রিকায়। রবীন্দ্রনাথ বিষ্ময়ে অভিভূত হয়ে এতক্ষণ শুনছিলেন, স্তব্ধ হয়ে নজরুলের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। কবিতা পড়া শেষ হলে তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন এবং দু’হাত প্রসারিত করে তরুণ কবিকে বুকে টেনে নিলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ কাজী, তুমি আমাকে সত্যিই হত্যা করবে। আমি মুগ্ধ হয়েছি তোমার কবিতা শুনে। তুমি যে বিশ্ববিখ্যাত কবি হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তোমার কবিতার জগৎ আলোকিত হোক, ভগবানের কাছে এই প্রার্থনা করি।’
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে সেদিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নজরুলের মিলন মুহূর্তটি সাধারণ ব্যাপার ছিল না। কারণ, নজরুল জন্মেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ৩৮ বছর পরে। সময়ের এই দূরত্বটা বেশ বড়। অবস্থাগত দূরত্বটা ছিল আরও বেশি প্রসারিত। তারপরও দুজনের ভাব ছিলো অনেক। এভাবেই নজরুলের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের প্রমাণ মিলে।