asd
Tuesday, September 17, 2024

ওস্তাদ মমতাজ আলী খান: বাংলা গানের অনন্য সুরকার এবং বাংলা লোকসঙ্গীতের অসাধারণ কারিগর …

– শাহরিয়ার খান সাকিব।

আজ, ১লা আগস্ট, বাংলাদেশের প্রতিভাবান লোকসঙ্গীত শিল্পী, গীতিকার ও সুরকার ওস্তাদ মমতাজ আলী খানের ১০৯তম জন্মদিন। ১৯১৫ সালে মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার ইরতা কাশিমপুর গ্রামে জন্মগ্রহণকারী এই মহান শিল্পীর জীবন ও কর্ম বাংলা সঙ্গীতের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা। তাঁর সৃষ্টি করা ‘এই যে দুনিয়া কিসেরও লাগিয়া, শোন বলি মুসলমান করি আমি নিবেদন, এই দুনিয়া ফানা হবে কিছুই রবে না, জ্বালাইলে যে জ্বলে আগুন নিভানো যে ভীষণ দায় কিংবা গুন গুনা গুন গান গাহিয়া নীল ভ্রমরা যায়’-এমন অসংখ্য গান আজও বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

মমতাজ আলী খানের পিতা আফসার আলী খান ও মাতা বেদৌরা খান ছিলেন মূলত: পল্লীগীতির শিল্পী। ছোটবেলা থেকেই পিতার গান শুনে শুনে তাঁর মনে গানের প্রতি এক অদম্য আকর্ষণ জন্মায়। সপ্তম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে তিনি গান শেখার জন্য কলকাতায় যান। সেখানে উস্তাদ নেসার হোসেন খানের কাছে পাঁচ বছর ধরে রাগ সঙ্গীতের তালিম নেন। পাশাপাশি উস্তাদ জমির উদ্দীন খানের কাছে খেয়াল, ঠুমরী ও গজলের তালিম গ্রহণ করেন।
রাগসঙ্গীতের শাস্ত্রীয় শিক্ষার পাশাপাশি মমতাজ আলী খানের মনে লোকসঙ্গীতের প্রতি এক বিশেষ আকর্ষণ জন্মায়। তিনি প্রচলিত লোকসঙ্গীত চর্চা করার পাশাপাশি নিজেও নতুন লোকগান রচনা করেন এবং অন্যদের রচনায় সুরারোপ করেন। এই সময় তিনি ওস্তাদ মোহম্মদ হোসেন খসরুর মতো বিখ্যাত শিল্পীর সান্নিধ্য পান।

১৯৩২ সালে তাঁর গাওয়া ‘ওরে শ্যাম কেলে সোনা’ এবং ‘আমি যমুনাতে যাই বন্ধু’ গান দুটি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৩ সালে তিনি কলকাতা বেতারের সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নির্বাচিত হন এবং একই বছরে ‘অভিযাত্রী’ ছবিতে কণ্ঠ দেন। এরপর ‘মধুচন্দ্রিমা, অশ্রু দিশারী, কলঙ্ক’ সহ আরও কয়েকটি ছবিতে কণ্ঠশিল্পী হিসেবে কাজ করেন। কলকাতা বেতারে গান করার সূত্রে কে. মল্লিকের সাথে তার পরিচয় ঘটে। কে. মল্লিকের সূত্রে তার সাথে নজরুল ইসলামের পরিচয় ঘটে। এরপর নজরুল ইসলাম তাকে দিয়ে দুটি ইসলামী গান রেকর্ড করান। ১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণে তিনি শান্তিনিকেতন যান। রবীন্দ্রনাথকে ভাটিয়ালি, মুর্শিদি, দেহতত্ত্ব, বিচ্ছেদী ইত্যাদি লোকগান শুনিয়ে মুগ্ধ করেন মমতাজ আলী খান।

১৯৩৫ সালে তিনি উস্তাদ আয়েত আলী খানের কাছে দুই বছর সরোদ বাজানো শিখেন। সং পাবলিসিটির এক অনুষ্ঠানে তাঁর গাওয়া ‘আমার বন্ধুরে আগে বলিস’ গান শুনে পল্লীকবি জসীমউদ্দিন মুগ্ধ হন এবং পরবর্তীতে জসীমউদ্দিনের অনেক গানে মমতাজ আলী খান সুরারোপ করেন। ১৯৩৭ সালে তিনি সং পাবলিসিটি বিভাগের চাকরি ছেড়ে কলকাতা বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে যোগদান করেন।

১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু উদ্দীপনামূলক গান রচনা ও সুরারোপ করেন। তার রচিত ‘বাংলা মায়ের রাখাল ছেলে বাঁশী দিল টান’, ‘বাংলাদেশের মাটি ওগো তুমি আমার জন্মস্মৃতি’ প্রভৃতি গান মুক্তিযোদ্ধাদের ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনে লোকসঙ্গীত বিভাগ খোলা হলে, তিনি এ বিভাগের দায়িত্ব নেন এবং সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে লোকসঙ্গীত শেখান। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রেডিও টেলিভিশনের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের সঙ্গীত পরীক্ষার অন্যতম পরীক্ষক ছিলেন।

লোকসঙ্গীতে অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে তিনি রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদকে ভূষিত হন। ১৯৬২ সালে সাউথ ইস্ট এশিয়ান মিউজিক কনটেস্টে প্রথম স্থান অধিকার করেন। এ ছাড়াও ১৯৭৭ সালে গীতিকবি সংসদ পদক, ১৯৮৬ সালে কালু শাহ পদক এবং বিভিন্ন সময়ে জাতীয় রবীন্দ্র পরিষদ পদক, লালন একাডেমি পদক, নজরুল একাডেমি পদক, পতাকা পদক, মানিকগঞ্জ সাহিত্য ও সঙ্গীত একাডেমি পদকসহ অসংখ্য পুরস্কার-সম্মাননা লাভ করেন।

ওস্তাদ মমতাজ আলী খান কেবল একজন শিল্পীই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বাংলা লোকসঙ্গীতের একজন অসাধারণ কারিগর। তাঁর সৃষ্টি করা গানগুলো আজও বাঙালির হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি বাংলা গানের জগতে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles