– মোশারফ হোসেন মুন্না।
ভালোবাসা – প্রতিটি মানুষের অনুভূতি প্রকাশের সর্বোচ্চ স্তরের নাম। এটি আমাদের দৈনন্দিন সম্পর্কে মিশে সেগুলোকে আরো শুদ্ধ করে তোলে। পরিবার থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে এর পরিধি বাড়তে থাকে। কিন্তু বর্তমান আধুনিক সময়ে এসে ভালোবাসা সমৃদ্ধ সম্পর্ক চারপাশে খুব একটা দেখা যায় না। রিলেশনশীপ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে না এখন আর।
সম্পর্কের পৃথিবীটা মহিনের ঘোড়াগুলির গানের মত ‘বোকা বাক্সে’ বন্দী হয়ে পড়েছে। এই বন্দীদশার কারণ কখনো অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন ? অনুসন্ধান করলে হয়ত নিজেকে দায়ী করতে হবে। কারণ আধুনিকতার মোড়কে আমাদের চিন্তা-ভাবনার বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে। এই পরিবর্তনের কারণে সম্পর্কের স্থায়িত্বও কমে গিয়েছে। ঠিক কি কি কারণে বর্তমানে এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে তাই নিয়ে ভারতের জনপ্রিয় লাইফস্টাইল বিষয়ক অনলাইন পোর্টাল ‘মেনজএক্সপি’-তে লিখেছেন এর বিনোদন সম্পাদক অংকুশ বাহুগুনা।
সঙ্গীতাঙ্গন সেই লেখাটা অনুবাদ করছি –
ইদানীংকালের সম্পর্কগুলো কেন জটিল হয়ে যাচ্ছে ? কেন অনেক চেষ্টার পরেও আমরা প্রতিবার ভালোবাসায় ব্যর্থ হচ্ছি ? কেন মানুষজন হঠাৎ করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে অজ্ঞ হয়ে যাচ্ছে ? তাহলে কি আমরা ভালোবাসতে ভুলে গেছি ? নাকি আমরা একেবারে ভালোবাসার সংজ্ঞা ভুলে গেছি ?
বস্তুত, আমরা অনেক কিছুতে প্রস্তুত নই। আমরা কোন ছাড় দিতে প্রস্তুত নই, কোন আপস করতে প্রস্তুত নই, শর্ত ছাড়া ভালোবাসার জন্য প্রস্তুত নই। আরো নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, একটা সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখতে আমরা এ বিষয়গুলোতে খেয়াল রাখতে রাজি না। রিলেশনশীপ টিকিয়ে রাখতে সময় দিন আপনার সঙ্গীকে। আমরা সবকিছুকে সহজে পেতে চাই। আবার সবকিছুকে সহজে ছেড়ে দিতে চাই। এগুলোর ফলে কোন ছোট বাঁধা আমাদের সামনে এলে সবকিছু শেষ হয়ে যায়। যার কারণে ভালোবাসা পরিণত হবার আগেই আমরা সম্পর্ক থেকে সরে আসি। আমরা এখন ভালোবাসা খুঁজি না, শুধু একটা ঘোরের মধ্যে থেকে নিজেদের রোমাঞ্চিত করতে চাই। আমরা সপ্তাহান্তে সিনেমা দেখা কিংবা পার্টিতে উপস্থিত হবার জন্যে একজনকে চাই। কিন্তু যে আমাদের গভীর নিরবতার কারণও বুঝবে এমন একজনকে চাই না। আমরা একসাথে সময় কাটাতে আগ্রহী কিন্তু স্মৃতি গড়তে আগ্রহী না। আমরা একঘেয়েমির মধ্যে থাকতে চাই না। সারাজীবনের জন্যে একজন সঙ্গীকে নির্বাচন করি না। কেবল সাময়িক সময়ে নিজেকে প্রাণবন্ত রাখতে সঙ্গী নির্বাচন করি। যখন আমাদের এই ঘোর কেটে যায় তখন একে অন্যের উপর আগ্রহ হারাতে থাকি। আমরা রোমাঞ্চকর অনুভূতিতে অন্ধ বিশ্বাস রাখি বলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সৌন্দর্যকে বিশ্বাস করতে চাই না। আমরা ভালোবাসার জন্যে স্থান না রেখে নগর জীবনের নানান বিষয়ে নিত্য বিভর থাকি। একটি সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের পর্যাপ্ত সময় ও ধৈর্য থাকে না। বস্তুগত স্বপ্নগুলোতে আমাদের ব্যস্ত সময় কাটে। তাই ভালোবাসার মত অবস্তুগত স্বপ্নকে লালন করতে পারি না। বর্তমানে সম্পর্ক কেবল একটি স্বাচ্ছন্দ্যবোধের বিষয় হিসেবে দাঁড়িয়েছে।
বাড়ছে ফেসবুক ইউটিউবসহ অনলাইনে থাকার প্রবণতা। ফেসবুক পোস্ট, ক্যারিয়ার কিংবা ভালোবাসার মানুষ, সবক্ষেত্রেই আমরা সাময়িক আত্নতৃপ্তি লাভ করতে চাই। অল্প পরিসরের জানা-শোনা থেকেই আমরা একটা সম্পর্কের পরিপক্কতা কামনা করি। কিন্তু পরস্পর অনুভূতিগুলো অনেক সময় ধরে তৈরী হতে হতে এই পরিপক্কতা আসে। সত্যি বলতে, শুধু ভালোবাসা নয়, সময় ও ধৈর্য ছাড়া কোন কিছুই ধরা দেয় না। আমরা বর্তমানে একজনের সাথে পুরো একটা দিন না কাটিয়ে একশ জনের সাথে এক ঘন্টা করে সময় ব্যয় করি। আমরা বিভিন্ন ‘অপশন’ রাখতে বেশি পছন্দ করি। এছাড়াও আমরা ‘অধিক সামাজিক’।
আমরা মানুষকে ভালোভাবে জানার চেয়ে কেবল নামমাত্র সম্পর্ক রাখতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছি। আমরা লোভীও বটে। কারণ আমরা সবকিছু পেতে চাই। নামমাত্র ভালোলাগা থেকে আমরা একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছি। তারপর ভালো কাউকে পেলে বর্তমান সম্পর্কে পিছপা হয়ে নতুন দিকে ঝুঁকছি। আমরা একজন মানুষের মধ্যে সবকিছু খুঁজে নিতে পারছি না। আমরা তাকে ‘পারফেক্ট’ হিসেবে পেতে চাই। কিন্তু তাকে কিংবা অন্য কাউকে ‘পারফেক্ট’ হবার জন্যে পর্যাপ্ত সুযোগ দেই না। আমরা ভালোবাসা থেকে যৌনতাকে আলাদা করে বলতে পারি না বা ভাবতে পারি না বস্তুত আমরা সবার উপরেই হতাশ হয়ে পড়ছি।
অন্যদিকে, প্রযুক্তি আমাদের এতটা কাছে নিয়ে এসেছে যে নিশ্বাস নেওয়ার জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। সঙ্গীর সাথে সামনাসামনি সাক্ষাৎ করার জায়গাটুকু টেক্সট, ভয়েস মেসেজ, স্ন্যাপচ্যাট কিংবা ভিডিও কল দখল করেছে। আমাদের আর একসাথে সময় ব্যয় করার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ প্রযুক্তির বদৌলতে আলাদা থেকেই আমরা অনেক সময় ব্যয় করছি। ফলে সামনাসামনি বলার মত কিছু অবশিষ্ট থাকছে না। আমরা এক ধরণের ”যাযাবর প্রজন্ম’। আমরা এক জায়গায় বেশিক্ষণ মনস্থির করতে পারি না। পাশাপাশি ‘প্রতিশ্রুতি’-র ব্যাপারে একটা ভীতি কাজ করে। ‘কোন সম্পর্ক চালিয়ে যেতে পারবো না’- এই বিশ্বাসটি আমাদের মধ্যে বেশি প্রতীয়মান হয়। যার কারণে আমরা একটি নির্দিষ্ট সম্পর্কে জড়াতে পারি না। শুধু এটি নয়, আমাদের প্রতিটি সিদ্ধান্তে ‘ভয়’ কাজ করে। আমরা একজনের সাথে বাকি জীবন কাটানোর কথা চিন্তা করতে পারি না। তাই বারবার সরে আসি। ‘দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ক’-কে আমরা সামাজিক কীট হিসেবে অবজ্ঞা করি। আমরা নিজেদের সবার থেকে আলাদা মনে করতে পছন্দ করি। আমরা সমাজের কাছে আদর্শ হতে চাই না।
আমরা ‘স্বঘোষিত যৌন ভারসাম্য রক্ষা করা প্রজন্ম’। আমরা ভালোবাসা থেকে যৌনতাকে আলাদা করে বলতে পারি না বা ভাবতে পারি না। আমরা ‘Hook Up Culture’ অনুসরণ করা প্রজন্ম। আমরা প্রথমে যৌনচিন্তা করি। তারপর সে মানুষটিকে ভালোবাসার সিদ্ধান্ত নিতে চাই। যৌনচিন্তা খুব সহজে আসে। কিন্তু নিজের ভেতরে বিশ্বস্ততা আসা কঠিন হয়ে পড়ে। আমরা জানি না কিভাবে পাগলের মত ভালোবাসতে হয়। শারীরিক সম্পর্কের এ বিষয়গুলো আমাদের কাছে মাদকের মত হয়ে গিয়েছে। সম্পর্কে ভালোবাসার থেকে ভালোলাগা বেশি কাজ করে বলে এই ধারণাগুলো আমাদের মধ্যে লালিত হতে থাকে। কিন্তু এটি কেবল কিছুক্ষণের জন্যে আত্মতৃপ্তি দেয়। এমনকি বর্তমান সময়ে বাইরের কারো সাথে শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো এখন আর নিষিদ্ধ বলে গণ্য হয় না। সত্যি বলতে, আমাদের সম্পর্কগুলো আর আগের মত সরল নেই।
এখন অঙ্গীকারহীন সম্পর্ক, প্রয়োজনমূলক সম্পর্ক, স্বার্থ উদ্ধারমূলক সম্পর্ক, নিষিদ্ধ সম্পর্ক, পিছুটানহীন সম্পর্কের মত অনেক ধরণের সম্পর্ক শ্রেণীবিভাগ তৈরী হয়েছে। ভালোবাসা প্রকাশ ও ভালোবাসাকে আকড়ে ধরে রাখার জন্যে আমাদের কাছে খুব অল্প পরিমাণ ‘বিশেষ কিছু বিষয়’ আমরা কেবল বাস্তবিক যুক্তি দিয়ে চলা প্রজন্ম। আমরা জানি না কিভাবে পাগলের মত ভালোবাসতে হয়। আমরা ভালোবাসার প্রয়োজনে সাত সমুদ্র তের নদী পারি দেবার কথা চিন্তা করতে পারি না। যার কারণে, পথের দূরত্বজনিত সমস্যায় আমরা সম্পর্ক থেকে সরে দাঁড়াই। আমরা ভালোবাসার ব্যাপারে খুব বিচক্ষণ। আমরা অনেক কিছু ভেবে ভালোবাসতে চাই। এমনকি আমরা নিজের ভালো-মন্দের ব্যাপারেও অনেক বিচক্ষণ।
নিজেকে গুটিয়ে নিলে সম্পর্ক গুলো খারাপ হয়ে পড়ে। আমরা একটা ভীত প্রজন্ম। আমরা ভালোবাসতে ভয় পাই, অঙ্গীকার করতে ভয় পাই, ধ্বংস হতে ভয় পাই, আঘাত পেতে ভয় পাই, হৃদয়ে রক্তক্ষরণের ভয় পাই। আমরা কাউকে শর্তছাড়া ভালোবাসি না। আবার আমাদেরকে শর্তছাড়া ভালোবাসতেও দেই না। মানসিক ভীতির কারণে সৃষ্টি হওয়া দেয়ালের ওপাশ থেকে আমরা ভালোবাসা চেয়ে বেড়াই। আবার ভালোবাসা আসলে আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি। কারণ আমরা ভাবি – আমরা সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো না। নিজেদের দুর্ভেদ্য করে রাখাতে আমাদের একটা ভালোলাগা কাজ করে। তাই নিজের সত্ত্বাকে কখনো কারো কাছে উন্মুক্ত করি না। গোপনীয়তা আমাদেরকে ঘিরে ধরেছে।
এমনকি বর্তমানে আমরা সম্পর্কের মূল্য দিতে পারি না। চারপাশের মানুষের কথা শুনে আমরা সম্পর্ক থেকে সরে দাঁড়াই। ভালোবাসার মানুষটি আমাদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে।
ভালোবাসা মানুষের একটি সহজাত প্রবৃত্তি। আমাদের মাঝে এই অনুভূতিগুলো নড়বড় হলে পৃথিবীর কোন কিছু জয় করা সম্ভব নয়। তাই নতুনভাবে দিন শুরু করা প্রয়োজন। আর সেই দিনগুলো হবে বাংলা গানের সাথে থাকা এক একটা দিন। বাংলা গানেই খুজে পাওয়া যাায় ভালোবাসার আসল সুত্র। দেশের শিল্পীরা গেয়েছেন লাখো ভালোবাসার গান। তা শুনলে আর গানের অনুভূতিগুলো বিচার করলে হয়তো ভালোবাসা থেকে বিরহ, বিচ্ছেদ আর সম্পর্ক নষ্ট হবেনা। ভালোবাসার মানে বুজলে ভালোবাসাা অমর হবে। সবাই সবার ভালোবাসা নিয়ে সুখী হোক। আর ভালোবাসার মধুর করতে বাংলা গান থাকুক মুখে মুখে। যে গানে ভালোবাসা খুঁজেছেন ইতিহাসে থাকা ভালোবাসার মানুষগুলো।