– শহীদুল্লাহ ফরায়জী।
গানের কবি গাজী মাজহারুল আনোয়ার চিরকালের জন্য মৃত্যুকে অতিক্রম করে, স্বপ্নের সাম্রাজ্যে সৌর মন্ডলের গভীরে অবস্থান গ্রহণ করেছেন, চিরন্তন রূপের রাজ্যে সমাহিত হয়েছেন, পরম জগতের সন্ধান পেয়েছেন, অদৃশ্য আত্মার সীমানা অতিক্রম করে মহাশূন্যতায় আশ্রয় নিয়েছেন।
তিনি আশীর্বাদ প্রাপ্ত সৌভাগ্যবান। নীরবে মৃত্যুর কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন ফলে কোনদিন মৃত্যু তাঁকে আর স্পর্শ করতে পারবে না। নশ্বর জীবন থেকে অবিনশ্বর জীবনের অধিকারী হয়েছেন। এতদিন তিনি জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে ছিলেন, এখন জীবনের অভিযাত্রা সমাপ্ত করেছেন। তাঁর আর আত্মপরিচয়ের কোন তাগিদ নেই, আত্মজ্ঞানের কোন প্রয়োজন নেই। তিনি ভালো-মন্দ, সত্য-মিথ্যা সবকিছুকে ছেটে ফেলেছেন, দেহপাখিকে মুক্ত করে সকল আকাঙ্ক্ষা গোপন করে উপযুক্ত পুরস্কার দিয়েছেন।
এখন তিনি শব্দহীন কুঞ্জবনে বসে আলোকোজ্জ্বল স্নিগ্ধতায় নক্ষত্রের অক্ষরে অনন্তকালের গীতিময় কাব্য রচনা করবেন। সেখানে জোছনার বীণায় সুর শুনবেন। অথচ তাঁর স্ত্রী জোহরা গাজী, কন্যা দিঠি আনোয়ার এবং পুত্র সরফরাজ আনোয়ার অদৃশ্য ভুবনে কোনদিন অংশীদার হতে পারবেন না। সেখানে তিনি হেঁটে চলবেন মহিমান্বিত স্রষ্টার ছায়ার সঙ্গে, অনন্ত প্রশান্তির সঙ্গে।
এতদিন তিনি শরীরকে আঁকড়ে ধরেছিলেন, এখন শরীরের সত্তা থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন তিনি সময়ের ভিতর আবদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন সময়ের ভিতর আবর্তিত হতেন।
কিন্তু হঠাৎ করে চোখের পলকে প্রলয় ঘটে গেছে।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার আমাদের জগৎ এবং চারিপাশকে পরিত্যাগ করে ফেলেন। সমুদ্র সমান বাসনা ছুঁড়ে ফেলেছেন, জনপ্রিয়তা, সাক্ষাৎকার বক্তৃতা সবকিছু থেকে নিজেকে বিযুক্ত করে নিয়েছেন, বেঁচে থাকার মোহ- বেঁচে থাকার অদৃশ্য কঠিন জাল ছিঁড়ে ফেলেছেন। জীবনের সমস্ত অর্জন, গভীর অনুভূতি, অপূর্ব সংগীতের পুঁজিকে শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা দিয়ে আমাদের মাঝে বন্টন করে গেছেন।
গাজী মাজহারুল আনোয়ার ছিলেন প্রকৃতগতভাবে কবি। অপ্রত্যাশিতভাবে গানের জাদুকর। কেউ গানের দাবিতে দরখাস্ত করলেন আর উনি সাথে সাথে মঞ্জুর করে দিতেন। সিনেমার গল্প শুনতেন সিচ্যুয়েশন বুঝতেন সাথে সাথে লেখা শুরু এবং শেষ। মনে হতো উনি শোনার ভান করছেন, অথচ এর মধ্যেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে নিতেন। গানকে তিনি শ্বাস প্রশ্বাসের মতো সহজ করে নিয়েছেন। শ্বাস প্রশ্বাসের জন্য যেমন কসরৎ করতে হয় না, গাজী মাজহারুল আনোয়ারকে গান লেখার জন্য কোনদিন কসরৎ করতে হয়নি, যা বিস্ময়কর। স্বভাবদত্ত কবিক্ষমতাকে তিনি উচ্চমাত্রার গানে রূপান্তর করেছেন, প্রতিটি গানকে নিখুঁত পরিণত রূপ দিতে পেরেছেন। তিনি নিজের ভিতর শব্দের ভান্ডার সংরক্ষণ করে রাখতেন। প্রয়োজনে যুতসই শব্দ, অভিধা, অন্ত্যমিল, ছন্দ মিল, সম্ভাষণ ব্যবহার করেছেন অতি সহজে। তিনি সংগীতে দক্ষ কারিগর। গানের শৈলীর বিচারে গাজী মাজহারুল আনোয়ার অনন্য। শব্দকে দুর্দান্তভাবে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বাংলা সংগীতকে অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন, যার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক। তিনি প্রতিদিন অনেক গান রচনা করতে পারতেন, তিনি গানের সংখ্যায় কোনদিন ভীত সন্ত্রস্ত হননি। কয়েক হাজার গান রচনা করে সর্বকালের জ্বলজ্বল করা ইতিহাসের নায়ক তিনি, সংখ্যার প্রতিযোগিতায়ও তিনি সর্বসেরা। তিনি কিংবদন্তি, তিনি আধুনিক বাংলা গানের অন্যতম চিত্রকর, হৃদয় ক্ষরণ করে অনুভূতির রঙ্গে সংগীতের চিত্র অহরহ অঙ্কন করেছেন। তিনি গান লিখেননি যেন গানের ছবি এঁকেছেন।
তিনি অবলীলায় অসাধ্যকে সাধ্য করেছেন। তিনি প্রেমের গানে ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিয়েছেন, বিরহের গান জোছনায় প্লাবিত করেছেন, দুঃখের গানে আর্তনাদ দিয়েছেন, শোকগাথায় হাহাকার দিয়েছেন, বিবেকের গানে দার্শনিক নির্বিকারতা দিয়েছেন, আকুল আকাঙ্ক্ষার বিস্তার করেছেন।
দেশাত্মবোধক গানে আত্মত্যাগের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, দেশপ্রেমের মহত্তম ভাবনা দিয়েছেন, মহাবিপর্যয় থেকে উদ্ধারের বার্তা দিয়েছেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে জাতিকে পুনর্গঠনের তাগিদ দিয়েছেন।
জয় বাংলা বাংলার জয়-এই গান লিখে আমাদের সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামের মাথায় সোনার মুকুট পরিয়ে দিয়েছেন। অদ্ভুত অবিশ্বাস্য চেতনা- সমগ্র জাতির মননে বপন করে দিয়েছেন। শুধু শব্দ দিয়েই বিশাল শক্তিমত্তার আবির্ভাব ঘটিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালির গহন গহীনে লুকিয়ে থাকা মনস্তত্বের গভীরে প্রবেশ করে জীবনের নির্যাস উত্তোলণ করেছেন তিনি। অস্ত্র হাতে না নিয়েও শুধু শব্দ সৈনিক হয়েই অসামান্য বীরত্বসূচক ভূমিকা রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। জয় বাংলা গান আমাদের অমূল্য দলিল।
একতারা তুই দেশের কথা বলরে এবার বল- অগণিত মানুষের আত্মত্যাগ, অগণন দুর্দশার মাধ্যমে রাষ্ট্র আমরা বিনির্মাণ করেছিলাম, তা দ্রুত আমাদের হাতছাড়া হয়ে যায়, সুতরাং আমার দেশের কথা বল, যা একান্ত প্রয়োজন, জন্মভূমি অতীত হয় না, মাতৃভূমিকে আড়াল করা যায় না। তিনি সংগ্রামকে পরিসমাপ্তি করতে চাননি, সংগ্রামকে জীবনের সাথে প্রবাহমান দেখতে চেয়েছেন। সংস্কৃতি বিসর্জন যোগ্য নয়, সে বিষয়ে আমাদেরকে সতর্ক করেছেন।
একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গায়- কী নির্মম হাহুতাশ, চারিদিক পাথরের মত কঠিন, প্রলোভনের খাঁচায় বন্দি পাখি মাটিতে মাথা ঠোকে, যেতে পারে না আপন ঠিকানায়। অনুতাপের আগুনের শিখায় জনম ভর পুড়তে থাকে অথচ কেউ তাকে যেতে দেয় না, মানুষের জন্য গাজী মাজহারুল আনোয়ারের বেদনা দু’চোখের জলে দু’পাশে লুটায়, কেউ এগিয়ে এসে ছোট্ট সোনার গায় দেখাতে নিয়ে গেল না কোন অনুকম্পায়।
আছেন আমার মোক্তার আছেন আমার ব্যারিস্টার- নিজেদের সালিশি ব্যবস্থা অভিশপ্ত বাস্তবতা আমাকে পরপার পার করতে পারবে না, স্রষ্টা সৃষ্টির আপনজোরে আমাকে উদ্ধার করবেন- এভাবেই অভিলাষ পূর্ণ করতে চেয়েছেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার। পরমাত্মার কাছে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন। কত সহজে জগতের নকশাকে আত্মসাৎ করে নিজেকে বিলুপ্ত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
সবাই তো ভালবাসা চায়- মানুষ নিরন্তর ভালোবাসার অনুসন্ধানী। প্রতিমুহূর্তে মানুষকে দুঃখ যন্ত্রণা ভক্ষণ করে ফেলে, অহরহ দগ্ধ করে ফেলে, অনবরত খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে ফেলে কিন্তু ললাট থেকে ভালোবাসা ঝরে পড়ুক তা কোন মানুষ চাওয়ার সক্ষমতাও অর্জন করতে পারে না। জীবন ঐশ্বরিক কিন্তু ভালোবাসা অপর্যাপ্ত উপহার। কি দারুণ আকুলতা দিয়ে তিনি বলেছেন সবাই তো ভালবাসা চায়।
আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল, ইশারায় শিস দিয়ে আমাকে ডেকো না, চোখ যে মনের কথা বলে, নীল আকাশের নিচে আমি রাস্তায় চলেছি একা, সবাই বলে বয়স বাড়ে আমি বলি কমেরে, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, সে যে কেন এলো না, আমি তো বন্ধু মাতাল নই, ও পাখি তোর যন্ত্রণা, ভেঙ্গেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা, হারজিত চিরদিন থাকবে, বন্ধু তোর বরাত নিয়ে, সুরের ভুবনে আমি আজও যদি আমাকে জানতে সাধ হয়, গান নয় জীবন কাহিনী- এমন ধরনের সাড়া জাগানো অসংখ্য গান দশকের পর দশক আমাদেরকে মুগ্ধ করে রেখেছে।
গাজী ভাইয়ের মৃত্যুতে আমার অন্তরাত্মা বলছে, আমাদেরকে আত্মশুদ্ধির পথে পরিচালিত হতে হবে, জীবনকে সৌন্দর্য ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করতে হবে। ভিতরের অন্ধকারকে দূরীভূত করে ক্রমাগত নিজেদেরকে আলোকিত করতে হবে। প্রতিমুহূর্তে আত্মসমীক্ষা করে জীবনের ‘সত্য’ ও ‘সৌন্দর্য’কে ক্রমাগত উদঘাটিত করতে হবে। অন্তরের পবিত্রতায় নিজেদেরকে শক্তিমান করতে হবে। আমাদেরকে মানবিকতা ও নৈতিকতার স্থায়ী পুরস্কার অর্জন করতে হবে। আমাদেরকে জ্ঞানী ও সংবেদনশীল সমাজ বিনির্মাণ করতে হবে।
আত্ম জ্ঞান আত্মপূর্নতা দিয়েই মৃত্যুকে ভালোবাসতে হবে, মৃত্যুকে জয় করতে হবে।
শেষ কথা গাজী মাজহারুল আনোয়ারের সংগীতের সুউচ্চ আকাশের গৌরব বা উল্লাস কোনটাই স্বল্প পরিসরে উত্থাপনযোগ্য নয়। এতো গানের গুরুত্বপূর্ণ রহস্যকে উন্মোচন করাও সম্ভব নয়।
গাজী ভাই, আপনি অতর্কিত আমাদের হৃদয়কে আক্রমণ করে বিহবল ও বিষন্ন করে দিয়ে গেছেন। আপনার চিরকালীন বিদায়ে আমাদের কারো আর্তনাদ, কারো সকরুণ ক্রন্দন, কারো সুগভীর দীর্ঘশ্বাস আপনাকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। সংগীত জগত আপনার অনুপস্থিতিতে এক অতলান্তিক খাদে পড়ে গিয়েছে। আপনার শূন্যতা নিরন্তর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হবে আমাদের সত্তায়।
আপনি কোন একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পর যদি একটি কলম নিয়ে যেতে পারতাম’। বাস্তবে কোন কলম আপনাকে দিতে পারিনি কিন্তু প্রতিটি বাঙালি অপরিসীম আগ্রহে তার হৃদয়ের স্বর্গীয় কলম আপনাকে উৎসর্গ করেছে।
আপনার গভীর চৈতন্যকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আমরা প্রার্থনা সংগীত রচনা করব, অগ্নিশুদ্ধ অনুতাপ আর অনুশোচনার তীব্রতা দিয়ে জীবনমুখী গান লিখব। যে সমাজে অর্থের বিনিময়ে নিজের কন্যাকে বিক্রি করে দেয় সেখানে মানবতার জয়গান করার মধ্য দিয়েই আপনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে।
আপনার সাথে কতবার দেখা হয়েছে কথা হয়েছে। আবার যদি দেখা হতো, আবার যদি কথা হতো ঐশ্বরিক শক্তির প্রভাবে আকাশের সকল উজ্জ্বল নক্ষত্রকে জড়ো করে আপনাকে সংবর্ধনা দিতাম, অন্তর আত্মা দিয়ে আনন্দের আতিশয্যে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানাতাম। দুদন্ড আপনার কাছে বসে অগণিত কথার ঝাঁপি খুলে বসতাম।
আমরা আপনাকে যথাযোগ্য সম্মান জানাতে পারিনি, সুষমামণ্ডিত গভীরতম শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসার মালা গলায় দিতে পারেনি। অকারনেই আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ভালোবাসাকে গোপন করে রেখেছি। ঈর্ষা হীনমন্যতা আমাদেরকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমরা প্রত্যেকেই ছদ্মবেশি। ভিতর বাহির সমান করা ছাড়া মানুষ হওয়া যায় না। মানুষ হওয়া থেকে আমরা অনেক দূরবর্তী।
আপনি বাংলা সংগীতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমাদের চেতনার আকাশে আপনি জ্বলজ্বল করে জ্বলবেন।
লেখক: গীতিকবি
fa*******@gm***.com