– মোঃ মোশারফ হোসেন।
মরে যাওয়া মানুষ আর চলে যাওয়া দিন দুটি একই রকম একবার চলে গেলে আর কখনো ফিরে আসে না।
চলে যাওয়ার দিনটি, যতদিন আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে থাকে, ততদিন পর্যন্ত ওই দিনটাকে নিয়ে, আমরা কত স্বপ্ন দেখি, কতভাবে সাজাই সেদিনটাকে। কিন্তু যখনই সেই দিনটা আমাদের জীবন থেকে চলে যায়, তখন সাথে
সাথে আমাদের সব আশাও শেষ হয়ে যায়। তেমনি যেই মানুষটা আমাদের চলার পথের সঙ্গী, যার চোখ দিয়ে আমরা অনেক স্বপ্ন দেখবো আশা করি। যার পা দিয়ে আমরা অনেক দুর এগিয়ে যাবো বিশ্বাস করি, সেই মানুষটাও মরে গেলে সব আশা, বিশ্বাস ভরসা ভেঙ্গে যায়। স্বপ্নের পথে হেঁটেছি, আরো হাঁটবো সেই আশাই ছিলো আমাদের সবার। কিন্তু যেই মানুষটার সাথে সেই পথে হাটবো ভেবেছি, তাকেই তো একটু আগে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে রেখে আসলাম।
হ্যাঁ বলছিলাম, বিশিষ্ট সাংবাদিক, গীতিকার, কলামিস্ট ও সাহিত্যিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর কথা। আজ শনিবার, বেলা ১১টা ১৫ মিনিটে তার মরদেহ নিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানবন্দরে মরদেহ গ্রহণ করেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক। এরপর আবদুল গাফফার চৌধুরীর মরদেহ দুপুর ১টায় জাতীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর বিকেল সাড়ে ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর বিকেল ৪টায় তার মরদেহ জাতীয় প্রেসক্লাবে আনা হয়। পরে বিকেল সাড়ে ৫টায় তার মরদেহ মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। এর আগে, গত ১৯মে যুক্তরাজ্যের লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গাফফার চৌধুরী। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৮ বছর। ডায়াবেটিস, কিডনি রোগসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি।
২০মে শুক্রবার পূর্ব লন্ডনের ব্রিকলেইন মসজিদে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে পূর্ব লন্ডনের ঐতিহাসিক শহীদ আলতাব আলী পার্কের শহীদ মিনারে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ব্রিটিশ-বাংলাদেশি কমিউনিটির সদস্যসহ সর্বস্তরের মানুষ তার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ১২ ডিসেম্বর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ার চৌধুরী বাড়িতে। তার বাবা হাজী ওয়াহিদ রেজা চৌধুরী ও মা জহুরা খাতুন।
১৯৫০ সালে ‘দৈনিক ইনসাফ’ পত্রিকায় কাজের মাধ্যমে সাংবাদিক হিসেবে গাফফার চৌধুরীর কর্মজীবন শুরু। মহিউদ্দিন আহমদ ও কাজী আফসার উদ্দিন আহমদ তখন পত্রিকাটি পরিচালনা করতেন। ১৯৫১ সালে ‘দৈনিক
সংবাদ’ প্রকাশ হলে গাফফার চৌধুরী সেখানে অনুবাদকের কাজ নেন। এরপর বিভিন্ন সময় তিনি বহু পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন সময় মাসিক সওগাত, দিলরুবা, মেঘনা, ইত্তেফাক, আজাদ, জেহাদ ও পূর্বদেশসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন বরেণ্য এই সাংবাদিক। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সপরিবারে সীমান্ত পেরিয়ে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছান। সেখানে মুজিবনগর সরকারের মুখপত্র সাপ্তাহিক জয়বাংলায় লেখালেখি করেন। এ সময় তিনি কলকাতায় দৈনিক আনন্দবাজার ও যুগান্তর পত্রিকায় কলামিস্ট হিসেবেও কাজ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তিনি দৈনিক জনপদ বের করেন।
১৯৭৩ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলজিয়ার্সে ৭২ জাতি জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যান আবদুল গাফফার চৌধুরী। দেশে ফেরার পর তার স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য প্রথমে কলকাতা নিয়ে যান।
সেখানে সুস্থ না হওয়ায় তাকে নিয়ে ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে যান। এরপর তার প্রবাসজীবন শুরু। আজ সেই প্রিয়তম স্ত্রী’র পাশেই কবর দেওয়া হয় তাকে। জীবনের সঙ্গী মরনের সঙ্গী হয়ে চির বিদায় নিল আজ। আমরা তার বিদায়ী আত্বার শান্তি কামনা করি।