– সুব্রত মণ্ডল সৃজন।
১৯৪২-২০২২ পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০ বছরের কর্মজীবনে এক হাজারেরও বেশি ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন এবং যার গাওয়া মোট গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষাতে ও বিদেশি ভাষায় গান গাওয়ার একমাত্র রেকর্ডটি যার, তিনিই সঙ্গীতের মহীয়সী লতা মঙ্গেশকর। যার জন্ম ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দ বর্তমান ভারতের মধ্য প্রদেশ। আজ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ খ্রিস্টাব্দ সকাল বেলাতেই পাড়ি জমালেন অমৃতের দেশে। রেখে গেলন তাঁর অসংখ্য সৃষ্টি ও ভক্ত।
পিতা পণ্ডিত দীনানাথ মঙ্গেশকর একজন মারাঠি ও কোঙ্কিণী সঙ্গীতজ্ঞ এবং মঞ্চ অভিনেতা ছিলেন। তার মাতা শেবন্তী (পরবর্তী নাম পরিবর্তন করে সুধামতি রাখেন) বোম্বে প্রেসিডেন্সির তালনারের (বর্তমান উত্তর-পশ্চিম মহারাষ্ট্র) একজন গুজরাতি নারী ছিলেন।
বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর ছিলেন নাট্যমঞ্চের পরিচিত মুখ। বাবার হাত ধরেই অনেক ছোট বয়সে নাটক, গানের সঙ্গে পরিচয়। দিদিমার কাছে লোকগানের তালিম নেওয়া শুরু সেই ছেলেবেলায়। মাত্র ১৩ বছর বয়সে গান গেয়ে ২৫ টাকা রোজগার করেছিলেন লতা।
শৈশবে বাড়িতে থাকাকালীন কে এল সায়গল ছাড়া আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তার। বাবা চাইতেন ও শুধু ধ্রপদী গান নিয়েই থাকুক। জীবনে প্রথম রেডিও কেনার সামর্থ্য যখন হলো, তখন তার বয়স আঠারো। কিন্তু রেডিওটা কেনার পর চালু করতেই প্রথম যে খবরটি তাকে শুনতে হয় তা হচ্ছে, কে. এল. সায়গল আর বেঁচে নেই। সঙ্গে সঙ্গেই রেডিওটা ফেরত দিয়ে দেন তিনি। তারপর এই আমাদের বিস্ময়কর লতা মঙ্গেশকর!
লতা মঙ্গেশকর তার কর্মজীবনে অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন (২০০১), দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মবিভূষণ (১৯৯৯), তৃতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা পদ্মভূষণে (১৯৬৯) ভূষিত হয়েছেন। এই সঙ্গীতশিল্পীকে ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার তাদের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা লেজিওঁ দনরের অফিসার খেতাব প্রদান করেছে। এছাড়া তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার (১৯৮৯), মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার (১৯৯৭), এনটিআর জাতীয় পুরস্কার (১৯৯৯), জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার (১৯৯৯), এএনআর জাতীয় পুরস্কার (২০০৯), শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৩টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ৪টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। তিনি ১৯৬৯ সালে নতুন প্রতিভা বিকাশের লক্ষ্যে শ্রেষ্ঠ নারী নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তী কালে তিনি ১৯৯৩ সালে ফিল্মফেয়ার আজীবন সম্মাননা পুরস্কার এবং ১৯৯৪ ও ২০০৪ সালে দুইবার ফিল্মফেয়ার বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন।
ভারতীয় সরকার গত ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৯ তাকে ‘ডট্যার অব দ্য নেশন’ খেতাবে ভূষিত করেন।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে লতা সর্বজ্যেষ্ঠ। তার বাকি ভাইবোনেরা হলেন – আশা ভোঁসলে, ঊষা মঙ্গেশকর, মীনা মঙ্গেশকর ও হৃদয়নাথ মঙ্গেশকর।
প্রেম একবারই এসেছিল নিরবে,
আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাবো,
প্রিয়তম কি লিখি তোমায়,
না যেও না রজনী এখনো বাকি,
আকাশ প্রদীপ জ্বলে… অজস্র গান মানুষের হৃদয়ের খোরাক।
সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ গোটা বিশ্ব! শোকের ছায়া বহির্বিশ্বেও! ভারতরত্নের স্মৃতিচারণায় বাংলার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। কারও কাছে, ‘লতাজি একটা স্বপ্নের মতো।’ কেউ আবার টুইটে লিখেছেন, ‘জীবন্ত সরস্বতীর প্রয়াণ!’
সঙ্গীতাঙ্গন আজ এই জীবন্ত সরস্বতীর প্রয়াণে শোকাহত! সেই সাথে অসীম শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন। বেঁচে থাকবেন এই কোকিলকণ্ঠি সঙ্গীতপ্রিয়দের হৃদয়ে চিরদিন।