– রহমান ফাহমিদা, সহকারী-সম্পাদক।
যুগ যুগ ধরেই আমরা দেখেছি যে, কিছু মানুষ কোন বিষয় নিয়ে চর্চা করলেও তাঁর জীবনের মোড় অন্য কোন বিষয়ে ধাবিত হয়। আজকে এমন একজন সংগীত শিল্পীর কথা জানাবো যে কিনা ছেলেবেলায় গান শুরু করেছিলেন রবীন্দ্রসংগীত ও পল্লীগীতির প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কিন্তু পরবর্তীতে বাংলাদেশের জনপ্রিয় পপ গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। হ্যাঁ, আপনারা যার কথা ভাবছেন আমি তাঁর কথাই বলছি, সে হল আর কেউ নয়! আমাদের সবার প্রিয় জনপ্রিয় এবং কিংবদন্তি পপ গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ। সঙ্গীতাঙ্গন-এর সাথে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে তিনি তাঁর জানা-অজানা অনেক কথাই বলেছেন। তবে সেই সাক্ষাৎকারে যাওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে পুরনো কথা (যা অনেকেই জানেন) নতুন করে একটু বলে নেই কারণ এখনকার নতুন প্রজন্মের তাঁর সম্পর্কে জানা উচিত।
ফেরদৌস ওয়াহিদ ১৯৫৩সালের ২৬ মার্চ মুন্সিগঞ্জ জেলার, বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম ওয়াহিদ উদ্দিন আহমেদ এবং মা এর নাম উম্মে হাবিবা নূরজাহান। ছয় ভাই তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট। তিনি তাঁর কিশোর বয়স কাটিয়েছেন কানাডায়। ফেরদৌস ওয়াহিদ একাধারে গায়ক, নায়ক এবং পরিচালক। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করার পর ১৯৭২-৭৩ সালের আগ পর্যন্ত ব্যান্ডগুলো ইংরেজি গান পরিবেশন করত। পরবর্তীতে বাংলা গানে আগ্রহী হয়ে ফেরদৌস ওয়াহিদ ও ফিরোজ সাঁইসহ কয়েকজন বন্ধু মিলে গঠন করেন ‘স্পন্দন’ নামের একটি ব্যান্ড। ব্যান্ডের ‘এমন একটা মা দে না’ ফেরদৌস ওয়াহিদের গাওয়া গানের সুবাদে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে ব্যান্ডটি। পপ গানের প্রতি ব্যক্তিগত ভালো লাগা থেকেই তাঁর এই পপ জগতে আসা। তাঁর সেই সময়কার গাওয়া গানে এবং ফ্যাশনে ওয়েস্টার্ন পপের প্রভাব ও ছিল যথেষ্ট। পরবর্তীকালে ফেরদৌস ওয়াহিদ, আজম খান, ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই এর সাথে পিলু মমতাজ যোগ দেন এবং পাঁচপীর নাম নিয়ে ‘উচ্চারণ’ ব্যান্ডের সাথে তাঁরা পারফর্ম করতে থাকেন।
জনপ্রিয় শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ ১৯৭০ -এর দশকে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর গানের যাত্রা। পরবর্তীতে লোকসঙ্গীতে তালিম নিয়েছেন জনপ্রিয় লোকগীতি শিল্পী আব্দুল আলিম-এর কাছ থেকে। ১৯৬৮ সালে গান শেখা শুরু করেন ওস্তাদ মদনমোহন দাশের কাছে। ক্লাসিকাল গান শেখেন ওস্তাদ ফজলুল হক-এর কাছ থেকে।
জনপ্রিয় পপ গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ-এর জনপ্রিয় গানগুলো হল- মামুনিয়া, আগে যদি জানতাম, এমন একটা মা দেনা, তুমি আমি যখন একা, খোকা। তাছাড়া সিনেমায় তাঁর আলোচিত গানগুলো হল- ওগো তুমি যে আমার কত প্রিয়, আমি এক পাহারাদার, শোন ওরে ছোট্ট খোকা, আমার পৃথিবী তুমি ইত্যাদি। এছাড়াও তাঁর পনেরোটির অধিক একক এ্যালবাম রয়েছে।
ফেরদৌস ওয়াহিদ এর নির্মিত প্রথম সিনেমা ‘কুসুমপুরের গল্প’। এই সিনেমায় তিনি নিজে অভিনয় করেন। ১৯৯৮ সালে আবুল হোসেন খোকন পরিচালিত ‘ভয়ঙ্কর বদমাশ’ সিনেমাতে তিনি নায়িকা ববিতার বিপরীতে নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ২০০৪ সালে পরিচালক হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। তাঁর নির্মিত টেলিফিল্ম ‘ডেঞ্জারম্যান, দুরন্ত অভিযান, কয়েদী।
তাঁর পুরস্কারের মধ্যে আছে – চ্যানেল আই এ্যাওয়ার্ড, সিটি ব্যাংক এ্যাওয়ার্ড, সাঁকো টেলিফিল্ম (আজীবন সম্মাননা ) ইত্যাদি অনেক পুরস্কার। জনপ্রিয় গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদের ছেলে হাবিব ওয়াহিদও সঙ্গীত জগতের একজন জনপ্রিয় শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক। এবার চলে যাই জনপ্রিয় গায়ক ফেরদৌস ওয়াহিদ এর সাথে সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে সাক্ষাৎকার পর্বে। সাক্ষাৎকারটি যথারীতি সালাম বিনিময়ে শুরু হয়। সাক্ষাৎকারটি হুবুহু তুলে দেয়া হল-
আমি যতটুকু জানি, আপনি রবীন্দ্রসঙ্গীত, ক্লাসিকাল, লোকগীতি এগুলোর ওপর চর্চা করেছেন, তারপর আপনি পপ গানে নিয়োজিত হয়েছিলেন। এটা কোন ভাবনা থেকে করলেন ? কারো প্রতি অনুপ্রেরিত হয়ে কি ?-
হ্যাঁ, এটা একদম সত্যি কথা! আমি ছোটবেলা থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুরু করলাম তারপর আমি ‘৭২ সাল থেকে একজন বড় ওস্তাদের কাছ থেকে ক্লাসিকাল শিখলাম কিন্তু মুল ক্লাসিকাল আমি শুরু করি ‘৬৮ সাল থেকে। আমি তো থাকতাম বেশি কানাডাতে তো ঐখানে এল্ভিস প্রিসলী’র শো দেখে মূলত আমি পপ সঙ্গীতের দিকে ঝুঁকি।
আপনার ছোটবেলা থেকেই কি গায়ক হওয়ার ইচ্ছে ছিল-
না, না। আমার পাইলট হওয়ার ইচ্ছে ছিল।
পাইলট কেন ? এত কিছু থাকতে!-
জানি না! আমার প্লেনে চড়তে এবং উরন্ত প্লেন দেখতে খুব ভালো লাগত।
আমরা জানি যে একটি পরিবারের সদস্যরা মিলে একটি ব্যান্ড তৈরি করেছিল। সেই ব্যান্ডের নাম ছিল ‘জিংগা শিল্পীগোষ্ঠী’। এই ব্যান্ড এর শিল্পীরা বাংলা গান করত। তারপর আপনারা ‘স্পন্দন’ ব্যান্ড নিয়ে আসলেন। আপনারা ব্যান্ড নিয়ে আসার আগে, হোটেলে বা যেখানেই বলেন, ইংলিশ গানের প্রচলন ছিল।-
হ্যাঁ, তখন ইংলিশ গানই করত। পাকিস্তান আমলে বাংলা গান করত একমাত্র জিংগা শিল্পীগোষ্ঠী।
কিন্তু আমার জানামতে আপনি এবং ফিরোজ সাঁই এবং সব বন্ধুরা মিলে তখন পপ গানে, বাংলা গান নিয়ে আসেন। আপনাদের ব্যান্ডে আপনার গাওয়া বাংলা গান ‘এমন একটা মা দে না’ তখন তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আমাদের দেশে স্বাধীনতার পর পপ এর ধারাটি যে আসে, তার জন্য আমি সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে বেশি স্মরণ করি এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, মরহুম ফিরোজ সাঁই এর প্রতি। ‘স্পন্দন’ নিয়ে ওর যে ঘুরে বেড়ানো, এর পেছনে প্রাণধালা খাটুনি বা নিবেদন এবং সাংগঠনিক তৎপরতা, সত্যি ফিরোজ সাঁই না হলে সম্ভব হত না। আমরা বরং ওর দ্বারা পরিচিত হই এবং আমরা ওর দ্বারা জিনিসটা বুঝতে পারি। তখন আমরা ওর সঙ্গে একমত পোষণ করা শুরু করলাম। কিন্তু স্পন্দন এর মূল উদ্যোক্তা হলেন মরহুম শেখ কামাল (বঙ্গবন্ধুর ছেলে)। মরহুম শেখ কামাল ছিলেন মূল উদ্যোক্তা তারপর এর দায়িত্ত্ব ছিল ফিরোজ সাঁই এর ওপরে এবং ফিরোজ সাঁই সেখানে সঠিকভাবে দায়িত্ত্ব পালন করেছে। এজন্য আমি বলবো, ফিরোজ সাঁইকে স্মরণ করি এবং অন্তর থেকে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
কিন্তু আমার জানা মতে, আপনাদের এই স্পন্দন ব্যান্ডের কোন এ্যালবাম বের হয় নাই! আপনারা আলাদাভাবে এ্যালবাম বের করেছেন-
নাহ! এ্যালবাম স্পন্দন এর নামে বের হয় নাই কিন্তু ‘স্পন্দনের’ সবকিছুই বিশেষ শিল্পীর নামে হয়েছে। আমি, আজম খান এবং ফিরোজ সাঁই।
আপনি, আজম খান এবং ফিরোজ সাঁই এর নামেই আসছে ?-
নাহ! আমি আলাদা, আজম খান আলাদা এবং ফিরোজ সাঁই আলাদা আলাদা করে এ্যালবাম বের করেছি তবে এর সমস্ত কাজ স্পন্দন এর দিকেই আসছে।
গুরু আজম খান, আমরা সবাই যেভাবে বলি আর কি!-
উনি হেসে বল্লেন- আজম খান আমার গুরু নাহ! আজম খান- ওকে আমি বলি ‘রকস্টার’। ও ‘বব ডিলেন’ এর মত আর কি! আজম খান এর সম্পর্কে আমি বলবো, ও অত্যন্ত একজন অমায়িক মানুষ ছিলেন। জনপ্রিয়তার ‘রাজমুকুট’ ওর মাথাতেই প্রথম পড়ে। এটা ভাগ্যের ব্যাপার!
পরবর্তীতে উনি যে, উচ্চারণ ব্যান্ড গঠন করলেন !-
নাহ! উচ্চারণ ব্যান্ড উনি একা করে নাই। সবচেয়ে বড় কথা হল, উচ্চারণ ব্যান্ডটির নাম দিয়েছিলেন ঢাকা কুরিয়ারের সম্পাদক, এনায়েত উল্লাহ্ খান। অরগানাইজ কিন্তু করেছিলেন সেইই ফিরোজ সাঁই। উচ্চারণ ব্যান্ডের নাম যে, ঢাকা কুরিয়ারের সম্পাদক এনায়েত উল্লাহ্ খান দিয়েছিলেন! এই কথা অনেকেই জানে না। উচ্চারণ ব্যান্ডের নাম কে দিয়েছিল তা আজকে আপনাকে বলে দিলাম।
উচ্চারণ ব্যান্ডে তো আপনারা পাঁচজন ছিলেন, আপনি, আজম খান, ফকির আলমগীর, ফিরোজ সাঁই এবং পিলু মমতাজ।-
এর পরবর্তীতে আরেকজন ছিলেন জানে আলম।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মনে আছে জানে আলম ভাইও ছিলেন।
২০১৬ সাল থেকে নতুন করে ‘স্পন্দন’ ব্যান্ড নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে ফিরোজ সাঁই এবং হাবলু ভাইয়ের ছেলেরা মিলে। তাদের জন্য কি বলবেন এবং আপনাদের সময়ের কিছু স্মৃতিচারণ করুন ।-
আমরা আপনারা সবাই মিলে দোয়া করি নতুন স্পন্দন ব্যান্ডের সদস্যসহ আগামী প্রজন্ম যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গীতকে যেন আরও উন্নতির দিকে নিয়ে যায়।
আমাদের সময়! আমি এতটুকুই বলব যে, আমাদের শিল্পীদের মধ্যে যে জিনিসটা ছিল, হতে পারে লোকসংখ্যা কম ছিল, কাজ কম ছিল এবং আমরা শিল্পীরা সংখায় কম ছিলাম কিন্তু আমাদের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল। আন্তরিকতা ছিল ব্যাপক এবং আমরা আড্ডা মারতাম যার যার বাসায়। তখন তো এতকিছু ছিল না! টেলিফোন ছিল এনালক। আর প্রোগ্রামে যখন যেতাম তখন ফাঁকে ফাঁকে আমরা নিজেরা অনেক হাসিঠাট্টা বলেন, আনন্দের মধ্যেই আমরা আমাদের সৃষ্টিগুলোকে ধরে রাখতাম। এখন আমার যা মনে হয়, তা পাওয়া যায় না। এখন যে যার যার মত ব্যস্ত। এখন সবকিছু হল এক। আগে কিন্তু আমরা সবাই মিলেমিশে কাজ করতাম। এখন এটার অভাববোধ করি। আগের যুগে যেমন দশটা ভাল গান যদি করত, আটটিই সুপার হিট হত। আর এখন দশটা ভাল গান করলে দুইটা সুপার হিট হয়। এর কারণ হল আগে যে সকল মানুষ গান লিখত, সুর করত এবং বাদ্যযন্ত্র বাজাত তখন তাঁরা তাঁদের মেধাকে
কাজে লাগাত। তখন বৈজ্ঞানিক জিনিসগুলো ছিল না। বিজ্ঞানের অবদান যখন এই যন্ত্রপাতিতে আসতে শুরু করল, মানুষের মেধা বিকাশের ক্ষেত্রটি লেইজী হয়ে গেল। এই কারণে মেধাটা কম ব্যবহার করে এবং বৈজ্ঞানিক এই ইলেকট্রনিকস এর অপর নির্ভর করে বেশি। ফলে মূল মেধাটা কম কাজ করে। যেই কারণে শ্রুতিমধুর সুরের অভাবটা এখন বেশি, আগে যেটা কম ছিল। তবে এখন যারা নিজের মেধা কাজে লাগিয়ে মিউজিক করে দেখবেন তারা ভালো আছে। ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে অনেকেই আছে।
ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে তো আপনার ছেলে হাবীব ওয়াহিদও আছেন! সে তো অনেক ভাল কাজ করছেন।-
আমি বলবো হাবীবকে আমার ছেলে হিসেবে চিন্তা না করে যদি শুধু মিউজিসিয়ান হিসেবে চিন্তা করি! তাহলে আমি বলবো, ও আসলেই এই যুগের একজন খুব চিন্তাশীল মিউজিসিয়ান। তারপরে আরও আছে যেমন, প্রীতম হাসান গায়ক খালিদ হাসান মিলু’র ছেলে এবং হৃদয় খান আমাদের রিপন খানের ছেলে। ওরাও কিন্তু কম না! ওরাও কিন্তু মিউজিক নিয়ে বেশ ঘাটাঘাটি করে।
আমাদের দেশ যে স্বাধীনতা লাভ করল! তার পরবর্তী এই ৫০ বছরে সংগীত জগতের পরিবর্তন আপনি কিভাবে দেখছেন ?-
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সঙ্গীত জগতে একটা জিনিসই সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হচ্ছে পপ। আর সঙ্গীত তো শতবর্ষ থেকেই হয়ে আসছে। বাংলাদেশের সঙ্গীতে কোন পরিবর্তন হয় নাই। পরিবর্তন হবে কেন! আমাদের কি পল্লীসঙ্গীত পরিবর্তন হয়েছে ? রবীন্দ্রসঙ্গীত নজরুল সঙ্গীতের কি পরিবর্তন হয়েছে ? একটা ধারা সংযোজন হয়েছে।
আপনি তাহলে ডিজিটাল যুগের যে আবির্ভাব হয়েছে, এটাকে কি বলবেন ?-
ডিজিটাল তো অনেক পরের ঘটনা। স্বাধীনতার পর তখন ইস্টার্ন ওয়েস্টার্ন যন্ত্রপাতি একসাথে করে যে গান গাওয়া হল, পপ নামে তা একটা মূল ধারার সাথে সুংযোজন হয়েছে। এটা আলাদা কিছু না, বাংলাদেশের সঙ্গীতেরই অংশ এখন।
জী, আপনি তো পপ সঙ্গীত নিয়ে বলছেন! কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি এখনকার প্রজন্মের অনেকেই গুরু শিক্ষা না নিয়ে গান করছে, ইউটিউবে দিচ্ছে আবার ঝরেও যাচ্ছে। আপনাদের গানের মত গানের স্থায়িত্ব থাকছে না। আপনাদের গান এখনো শ্রোতারা শুনছেন এবং পছন্দও করছেন। আপনারা তো পপ সঙ্গীতকে এনে নতুন একটি পথ দেখিয়েছেন কিন্তু এখন তো সেরকম নাই! সেই পরিবর্তনের কথাটাই বলতে চাইছি-
নাহ! ঠিক আছে আপনার কথাটি। তবে এখন যেটা হচ্ছে, সেটা তো শুধু সঙ্গীতাঙ্গনেই হচ্ছে না! সমাজের অনেক বিষয়েই এই অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। সেই থেকে যদি শুধু সঙ্গীতের বেলায় বিশ্লেষণ করি তাহলে আমি বলবো, অবশ্যই এখানে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। মেধার কমতি নাই কিন্তু মেধা প্রকাশের ঢংটা পরিবর্তন হয়েছে। আগে যখন আমরা একটা গান করলে তিন চারদিন চিন্তা করতাম। অনেক কিছু নিজস্ব ভাবনাতেই চলে যাচ্ছিল কারণ তখন ডিজিটাল কিছু ছিল না। কিন্তু এখন ডিজিটাল এসে যেমন উৎকর্ষতা বাড়ছে, একইভাবে মানুষের মগজের ক্ষমতাটাও কিন্তু অলস হয়ে যাচ্ছে। অলসতা বাড়ছে এটাও বলতে পারেন। সুরের প্রতি অন্তরঙ্গতা কমে গেছে। ফলে মনে রাখার মত সুরও কম সৃষ্টি হচ্ছে। আপনি বললেন না, ঝরে যাচ্ছে! এই কারণেই ঝরে যাচ্ছে। ওগুলো চমকের মত ভাল লাগে। ডাবের পানি আর কোকোকলা কি এক ?
তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, ভেজাল আছে!-
আপনি মনে করেন সঙ্গীতের ডিজিটাল অবস্থাটাও তাইই। মাঝে মাঝে তৃষ্ণা পেলে কোকোকলা তো একবারই খেয়ে ফেলি আমরা, তাই না! তাই যখন নতুন গান শুনি ঐ নতুনের তৃষ্ণার জন্য একবারই শুনি তারপর ফেলে দেই। এই হচ্ছে তফাৎটা।
সঙ্গীত জগতে দীর্ঘ দিনের পথচলায় সেটা তো আমরাও জানি আপনার অনেক প্রাপ্তি, তবুও আপনার কাছ থেকে জানতে চাচ্ছি। তাছাড়া সঙ্গীত জগতে আপনার কোন অপ্রাপ্তি বা আক্ষেপ আছে কিনা!-
আমার প্রাপ্তি তো একটাই! সেটা হল মানুষের ভালোবাসা। আর রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ছাড়া আমি অনেক পুরস্কার পেয়েছি।
ওটা কী আপনার অপ্রাপ্তি না আক্ষেপ!-
এটা আমার আক্ষেপ না, এটা আমার ভাগ্য! আক্ষেপ আমি কখনোই করব না। আমি ভাগ্যকে বিশ্বাস করি। যদি ভাগ্য খারাপ না হত তাহলে আমি রাষ্ট্রীয় পুরস্কারও পেতাম। মানুষ গায়ের জোরে কিছু পায় না, ভাগ্যের জোরে পায়। আমি বেসরকারিভাবে সর্বোচ্চ পুরস্কারগুলো পেয়েছি। চ্যানেল আই এ্যাওয়ার্ড, সিটি ব্যাংক এ্যাওয়ার্ড এগুলো পেয়েছি। সব কিছুই এক শুধু রাষ্ট্রীয় নামটা নাই। রাষ্ট্র তো রাষ্ট্রই, রাষ্ট্রের পুরস্কার আমার ভাগ্যে জোটে নাই।
আপনি কি নতুন কোন কাজ করছেন ?-
ওইভাবে না। আমি গত বছর সব কাজ করে রেখেছি। আমি গান বাজনা ছেড়ে দিয়েছি। এখন আমি গত বছরের গুলিই একটু একটু করে করছি। আর আমি এখন গ্রামের বাড়িতে থাকি, ঢাকায় থাকি না।
আপনি তো মাঝখানে সিনেমা পরিচালনা করলেন এবং জনপ্রিয় নায়িকা ববিতা’র বিপরীতে নায়কও হলেন। সেই সাথে প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে আপনার জনপ্রিয়তাও ছিল কিন্তু হঠাৎ করে কোন অভিমান থেকে কেন সিদ্ধান্ত নিলেন যে, আপনি আর গান করবেন না!-
না, না, অভিমান না। সবই তো করলাম, দেখলাম, আর আমার যা প্রাপ্তি আল্লাহ্তা’লা আমাকে দিয়েছেন। এখন আমরা মনে হচ্ছে যে, আমাদের গান জেনারেললি মানুষ অতটা ধারণ করতে পারে নাই। কিন্তু আমি যেটা বুঝি যে, একটা সময়ের পরে দর্শক শ্রোতারা শিল্পীদেরকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় তো! তাই আমি ঐ ছুঁড়ে ফেলে দেয়ার আগেই, নিজেই সরে গেলাম।
এটা কিন্তু একটা অভিমান ভাইয়া-
নাহ! অভিমান না। এটা একটা তিলক। এটা হয়তো আরও বিশ-পঁচিশ বছর লাগবে, আমাদের দেশের শিল্পীদের প্রতি সবসময় যে সম্মান তা প্রতিষ্ঠিত হতে। এটা আরও সময় লাগবে। নতুন দেশ, মাত্র ৫০বছর হয়েছে। এখন দেশ ডেভেলপ হচ্ছে। আসতে আসতে দেশ সমৃদ্ধির পথে যাচ্ছে। মানুষের মনও আসতে আসতে সমৃদ্ধির দিকে চলে যাবে। তখন গায়কদের গায়কীর ক্ষমতা না থাকলেও সম্মানটা থাকবে। কিন্তু এখন আমাদের দেশে দেখা যায় যে, গায়কী ক্ষমতাও শেষ! সম্মানও শেষ!
আপনি নতুন প্রজন্মের উদ্দেশ্যে কি বলতে চান ?-
আমি শুধু একটা কথাই বলবো। যারা নতুন প্রজন্ম আসছে তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, অল্পতেই খুশি হওয়ার কিছু নাই! আমি মনে করি যে, আমি ফেরদৌস ওয়াহিদ এখনো সঙ্গীতের বিশাল জগতের কাছে শিশু। তাহলে ওদের কিন্তু ভাবতে হবে, ওরা যদি মনে করে ওদের গানের কোটি কোটি ভিউ হয়ে গেছে তাতেই ওদের সব প্রাপ্তি হয়ে গেছে এবং সব শেষ ! তাহলে সবচেয়ে ভুল করবে ওরা। কারণ হঠাৎ করে দেখবে, আরেকজন ওর জায়গায় চলে আসছে। তখন সে বুঝতে পারবে ভুলটা কোথায় ? এই ভুল যাতে না হয় সেজন্য তাকে সব সময় চর্চার মধ্যে থাকতে হবে এবং ভাবতে হবে যে, না আমার এখনো পূর্ণতা আসে নাই। তখনই সে পূর্ণতার দিকে দৌড়াবে। তাছাড়া প্রত্যেকটি আর্টিস্টের একটা নিজস্ব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে। আমি মনে করি, চারিত্রিক গুনাবলির মধ্যে যা যা আছে যেমন নম্রতা, ভদ্রতা, সৌজন্যমূলকভাব, এগুলো থাকতে হবে। তারপরে সিনিয়রদের প্রতি তার সম্মানবোধ থাকতে হবে। নিজের পরিবারের সদস্য বা প্রিয়জনদের যেভাবে ভালোবাসা দেয় সেভাবে সঙ্গীতকে ভালবাসতে হবে। তাহলেই পবিত্রতা আসবে, ভাল সুর হবে এবং ভাল গান হবে। সঙ্গীতের প্রতি ভালবাসা না থাকলে কোনদিনই ওখানে সুন্দর কিছু সৃষ্টি হতে পারে না, চমক হতে পারে। আমি যদি মানুষকে নাচানোর জন্য অস্থির হয়ে যাই আর নিজেই আমি ব্যাকুলভাবে নাচলাম নাহ! এবং নাচবো যে, আমার মনের ভেতরে হৃৎপিণ্ডের যে ছন্দ, সেটাই যদি আমি না পাই তাহলে নাচব কি করে! শুধু মানুষের কথা চিন্তা করি, সেটা হবে না। আগে নিজের হৃৎপিণ্ডকে তুষ্ট করতে হবে, তখন ওই সুরটা অটোমেটিক মানুষের কাছে ভালো লাগবে।
চমৎকার কথা বলেছেন, ভাইয়া। এরকম কথা ওইভাবে কেউ কখনো বলে নি! ভালো থাকবেন, সুস্থ থাবেন এবং সাবধানে থাকবেন। সঙ্গীতাঙ্গন-এর পক্ষ থেকে আপনার জন্য রইল অনেক অনেক শুভকামনা ও শ্রদ্ধা।
অনেক ধন্যবাদ এবং আপনিও ভালো থাকবেন । সঙ্গীতাঙ্গন-এর জন্য অনেক শুভকামনা।