তেরোশো ছয়ের এগারো জ্যৈষ্ঠ
নেমে এলো ধরাধামে
দেব-শিশু এক বর্ধমানের
চুরুলিয়া ছোট গ্রামে। – বিমল মৈত্র
পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। চরম দরিদ্রতার সঙ্গে লড়াই করে তাঁর বেড়ে ওঠা। বাল্যকাল থেকেই নানাবিধ কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে তিনি জীবন ধারণ করেছেন। ১৯১৭ সাল- কাজী নজরুল ইসলাম তখন রানীগঞ্জের শিয়ারসোল রাজ হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র। সামনেই ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা। এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। কেবলমাত্র তাঁর স্কুল জীবনের পরম বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এ-সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে ৪৯ নম্বর বেঙ্গলী রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হলে, করাচি থেকে কলকাতায় এসে প্রথমে তাঁর বাল্যবন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মেসে এবং পরে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’-র অফিসে ওঠেন। সেখানে দু-দিন থেকে তিনি চুরুলিয়ায় যান এবং সপ্তাহখানেক ছুটি কাটিয়ে পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসেন। উল্লেখ্য যে, সুস্থাবস্থায় নজরুল আর কখনও চুরুলিয়ায় যাননি। মুজফ্ফর আহ্মদ ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিকথা’-য় লিখেছেন- “চুরুলিয়া হতে নজরুল যখন কলকাতা ফিরে আসছিল, তখন সে বর্ধমানে থেমে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে সাব-রেজিস্ট্রারের চাকরির জন্য একখানা দরখাস্ত দিয়ে আসে। তাতে সে ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের ঠিকানা দিয়েছিল। সেই সময়ে পল্টন হতে যাঁরা ফিরেছিলেন তাঁদের মধ্যে লেখা-পড়া জানা লোকেদের সরকারি চাকরি হয়ে যাচ্ছিল। ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের ঠিকানাতেই নজরুল ইসলামের নামে মুলাকাত (ইন্টারভিউ) করার জন্য পত্রও এসেছিল। আফ্জালুল হক সাহেবসহ আমরা অনেকেই তাঁকে সেই মুলাকাতে যেতে দিইনি। আমরা তাঁকে বুঝিয়েছিলেম যে সাব-রেজিস্ট্রারের চাকর হলে তাঁকে কোথাও দূরে গ্রামের মতো জায়গায় পড়ে থাকতে হবে। সে জায়গায় সে কলকাতার সাহিত্যিক পরিবেশ পাবে না। আর এই পরিবেশ হারালে তাঁর শক্তির বিকাশে বাধা ঘটবে।”
শুরু হলো কলকাতায় নজরুলের সাহিত্যিক জীবন। জীবনের বেশিরভাগ সময় তিনি অতিবাহিত করেছেন বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান এই কলকাতায়। নানা কারণে বার-বার ঠিকানা বদল করেছেন। নজরুলের জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী এই বাড়িগুলি। ক্রিস্টোফার রোডের বাড়ি থেকেই কবি নজরুলকে ১৯৭২ সালের ২৪শে মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে ঢাকার উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বাড়িটি ছিল কলকাতায় কবির শেষ ঠিকানা। কাজী নজরুল ইসলামের কালজয়ী সৃষ্টি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষে আরও একবার ফিরে দেখা – সাদা-কালো আলোকচিত্রে ‘কলকাতায় নজরুল’। ৩/৪সি, তালতলা লেনের সেই বাড়ির সামনে দাঁড়ালে এখনও মনের গহীনে ধ্বনিত হয় —
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
লেখনীঃ সোমঋতা মল্লিক
নজরুল সঙ্গীতশিল্পী এবং সভাপতি,ছায়ানট (কলকাতা)
১. ১১নং ওয়েলেসলি স্ট্রীট। ১৯২৮ এর প্রথম দিকে নজরুল এই বাড়িতে থাকতে আসেন। এখানে ছিল সওগাত পত্রিকার অফিস। নজরুলের লেখা ‘সওগাত’ পত্রিকায় নিয়মিত ছাপা হতো।
২. ৩/৪ সি, তালতলা লেন, নজরুল ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি এই বাড়িতে লিখেছিলেন।
৩. ৩২-এ, কলেজ স্ট্রিট বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিস। ১৯২০-সালের মার্চ মাসে হাবিলদার কাজী নজরুল ইসলাম এসে মোজাফ্ফর আহমদ এর সঙ্গে বসবাস শুরু করেন।
৪. ১৯২৪ এর ২৫শে এপ্রিল ৬নং হাজী লেনের এই বাড়িতে নজরুল ও প্রমীলার বিয়ে হয়।
৫. ৫০/২, মসজিদ বাড়ি স্ট্রীট। ১৯৩০ সালে নজরুল এখানে বসবাস করতে আসেন। এখানে কবির প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র বুলবুল মারা যায় দুরারোগ্য বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে।
৬. ১৫৬ সি, মন্মথ দত্ত রোড (বর্তমানে ৪৬এ, তালা পার্ক এভিনিউ) এই বাড়িতে ১৯৬২ সালের ৩০শে জুন কবিপত্নী প্রমীলার দেহবসান হয়। ১৯৭৪ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি কবির কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধর অকাল প্রয়াণ ঘটে। এখান থেকেই কবি নজরুলকে তার পুত্র কাজী সব্যসাচীর ক্রিস্টোফার রোডের বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
৭. ক্রিস্টোফার রোডের এই বাড়ি থেকেই কবি নজরুল ১৯৭২ সালের ২৪শে মে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর আমন্ত্রণে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। এটাই কবির কলকাতা বাসের শেষ ঠিকানা।