asd
Friday, November 22, 2024

শিল্পী নজরুল…

– নাজিম আহমেদ।

কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যে বেসামাল আলোড়ন নিবেদিত করেছেন মৃত্যঞ্জয়ী চির যৌবনের জয় ধ্বনি অগ্নিবীণার সুর ঝঙ্কারে। শৈশবের দুঃখু মিয়া, তারা খ্যাপা ও নজর আলী ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, হাবিলদার কবি, সৈনিক কবি, সাতিল আরবের কবি, বাঁধনহারা কবি ও আমাদের জাতীয় কবি। না এখানেই শেষ নয়; গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, চলচ্চিত্র পরিচালক, অভিনেতা, সঙ্গীতের ওস্তাদ ও জননন্দিত সুগায়কও ছিলেন বটে। কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দের ২৪ মে, (১১ জৈষ্ঠ, ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) চুরুলিয়া গ্রামে রাজা নরোত্তম সিংহের গড়ের পীরপুকুরের উত্তর পাশে একটি মাটির ঘরে জন্ম নেন। নজরুলের পিতা ফকির আহমেদের দ্বিতীয় স্ত্রী জাহেদা খাতুনের গর্ভে কাজী সাহেবজানের জন্মের পর আরও চার-জন পুত্রের জন্ম ও মৃত্যু হয়। এরপরে জন্ম নেয় নজরুল। পৃথিবীতে যাওয়া আসার মধ্যেখানি সময় ছিল ৭৭ বছর তিন মাস ৫ দিন। আর এতে সৃষ্টি সাধন বা সাহিত্যের জীবনকাল ২৩ বছর। কলমতো সব রকম লেখার সেলাই দিতে প্রস্তুত। নজরুলের চমকপ্রদ কলম ছিল বেশুমার সরস। তার সৃষ্টি জীবন নানাভাবে ছেঁকে ছেঁকে দেয়া যায় ২৩-বছরের ১ম দশ বছর প্রধানত কবিতা সৃষ্টির বিশ্ময়কর প্রভাব প্রবৃত্তি অবগাহন ও শেষের তেরোবছর গান রচনায় প্রকৃষ্ট পক্ষকাল ছিলেন। যদিও প্রথম দশে উকৃষ্টমানের গান শেষ ১৩তে ব্যাপক সাড়া জাগানো কবিতা ও রচনা করেছিলেন।
এদিক থেকে বলা যায় নজরুল জীবনের প্রথম পর্ব সাহিত্যিক জীবন ও ২য় পর্ব মূলত শিল্পী জীবনের রূপে আখ্যায়িত করা যায়। সাহিত্যিক জীবনে পেশা ছিল সাংবাদিকতা ও রাজনীতি। শিল্পী জীবনে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানী, বেতার, সিনেমা এবং থিয়েটার জগতের সাথে যুক্ত থাকলেও শেষের দিনে অল্প-বিস্তর সাংবাদিকতা ও রাজনীতি করতেন তবে প্রথম জীবনের মতো গভীর নয়।
যাইহোক, আজ আমরা আলোচনা করবো নজরুলের শিল্পী জীবন। অধুনাকালে নিজেকে বা নিজেদের স্বীয় সৃষ্টি শক্তির ঢোল, তবলা যতটা সহজ সমীকরণে বাজানো যায় বা নিজেদের সৃষ্টিকর্ম ও সৃজনশীলতা প্রচার প্রকাশ করা যায় নজরুল যুগে তেমটা ছিল না। বিশ শতকের বিশ ও ত্রিশ দশকে টেলিভিশন, ক্যাসেট টেইপ বা টেইপ রেকর্ডার খুব একটা ছিল না। সে সময়ে পরিলক্ষিত হতো গ্রামোফোন রেকর্ড, বেতার, চলচ্চিত্র মাধ্যম। এ ছাড়া পত্র-পত্রিকা, গ্রন্থ ও সভা সমিতির কর্মসুচী। আধুনিক গানের বিশ্ব শুরুর দিকে প্রধানের দিকে নজরুল ইসলাম ছিলেন অন্যতম। যাকে বলা যায় পূর্ব ধারার নয়া ও শেষ কর্নধার। তাই ওই সময়ে ওই প্রকাশ মাধ্যমেগুলোর সাথে নজরুলের সম্পর্ক ছিল খুবই ঘনিষ্ঠ। নজরুলের শিল্পী জীবনের শিক্ষানবিশ কাল শুরু হয়েছিল ‘লেটো’ নাচ গান আর যাত্রার দলে। নজরুলের লেটো দলে যোগদানের কারণ হয়তো ছিল অর্থোপার্জনের প্রয়াস বা হাতিয়ার কিন্তু লেটো দলের গান, অভিনয় দর্শকদের আকৃষ্ট করেনি তা নয়। তাই বলা হয় লেটো দলেই নজরুলের শিল্পী জীবনের উদ্বোধন হয়েছিল। লেটো দলে নজরুলের প্রবেশ ঘটে কাজী বজলে করিমের প্রভাবে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নজরুলের পিতা মৃত্যুর পরের বছর নজরুল প্রাইমারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় গ্রামের মক্তব থেকে। মধ্যেখানে দুই বছর গন্তব্যহীন মাঝির মতো চলার পর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বর্ধমান জেলার লাঙ্গকোট থানার অজয় নদের তীরস্থ মাথরুন গ্রামের নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। খুব সম্ভব আর্থিক অনটনের কারণে পড়াশোনা দৌড় থেকে যায়। শুরু হয় চির চেনা ভবঘুরে জীবন। শুরু হয় গান পালা রচনা ঢোল বাজিয়ে আসরে আসরে গান গাওয়া। এবার কবি বাসুদেবের দলে নজরুল অন্যতম।

কবি বাসুদেবের দলের এক মহড়ায় নজরুলের গান শুনে মুগ্ধতার মুগুর মাতে মশগুল হয়ে বর্ধমানের আন্ডাল ব্রা রেলওয়ের এক খ্রিস্টান গার্ড নজরুলকে একটা চাকরি দেন। চাকরি মূলত গান শোনানোর জন্য হলেও নজরুলের কাজ ছিল রেলস্টেশন থেকে দেড় মাইল কাঁচা রাস্তার পর প্রসাদপুর বাংলোয় গার্ডকে পৌঁছে দেওয়া, প্রসাদপুর থেকে টিফিন ক্যারিয়ার করে খাবার আনা। আবার কখনও কখনও আসানসোল থেকে ট্রেনে করে গার্ডের জন্য বিদেশি পাণীয় আনা। নজরুলের গানে বেশি অনুরক্ত ভক্ত ছিলেন গাডের্র স্ত্রী হিরণপ্রভা ঘোষ। তাই গানের চেয়ে তার স্ত্রী হিরণপ্রভা ঘোষ নজরুলের গান শুনতো বেশি। হিরণপ্রভা ঘোষের প্রথম পক্ষের একটি খোঁড়া মেয়ে ছিল। তার সাথে নজরুলের বদনাম রটিয়ে দিলে নজরুল চাকরি ওই জীবনের ইতি টানেন। নজরুল আর কোনো দিনও প্রসাদপুরের বাংলোয় ফিরে যান নি। ওই বছরে নজরুল আবার কাজ নেন আসানসোলে চা-রুটির দোকানে। মাসিক বেতন এক টাকা ও আহারের সুরাহা হলেও থাকার কোনো ব্যবস্থা করেনি চা রুটির দোকান কর্তৃপক্ষ। তাই নজরুল রাত্রি যাপন করতে দোকান সংলগ্ন তিন তলা একটি বাড়ির সিঁড়ির নীচে। মাত্র মাস তিনেক ওই চাকরি করেছিলেন নজরুল।
ওই বাড়িতে থাকতেন সাব ইন্সপেক্টর কাজী রফিকউল্লাহ। তার বাড়ি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার কাজীর সিমলা গ্রামে। সিঁড়ির নীচে ঘুমন্ত নজরুলকে দেখে উৎসুক কাজী রফিকউল্লাহ শোনেন নজরুলের জীবন কাহিনি। নি:সন্তান কাজী রফিকউল্লাহ দম্পতির আন্তরিকতা দেখে নজরুল অনুরোধ করে তার পড়াশোনার ব্যবস্থা করে দিতে। তাই কাজী রফিকউল্লাহ নজরুলকে পত্র লিখে পাঠায় কাজী রফিকউল্লাহ ছোট ভাই কাজী সাখাওয়াতউল্লাহর কাছে। ইতিমধ্যে মাথরুন স্কুল ছাড়ার দুই বছর পার করে ফেলেছেন নজরুল। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে কাজী রফিকউল্লাহ গ্রাম কাজীর শিমলার নিকটবর্তী দরিরামপুর স্কুলে নজরুলকে ৭ম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন তিনি। কাজী বাড়ি ও আরও দুই জায়গায় জায়গীর ছিলেন নজরুল। নানা কারণে মাত্র এক বছর যেতে না যেতে নজরুল ফিরে গিয়ে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল রাজ স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে আবার ভর্তি হয়ে নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। প্রিটেস্ট পরীক্ষা দিয়েই চলে গেলেন সেনাবাহিনীতে। সেনানিবাসে ব্যারাকের সামনে নজরুল নিয়মিত গানের আসর বসাতো। নজরুলের বন্ধু সহ সৈনিক জমাদার শম্ভু রায় এক পত্রে লিখেছেন- ‘ওই দিন সন্ধার পর তার ঘরে আমি ও নজরুলের অন্যতম বন্ধু তার অরগ্যান মাস্টার হাবিলদার নিত্যানন্দ দে প্রবশ করলাম তখন দেখলাম অন্যান্য দিনের চেয়ে নজরুলের চোখে মুখে একটা অন্যরকম জ্যোতি খেলে বেড়াচ্ছিল। নজরুল সেই দিন যে সব গান গাইল ও প্রবন্ধ পড়ল তা থেকে আমরা জানতে পারলাম রাশিয়ার জনগণ জারের কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে।’ একটা সময় কলকাতার শিল্পী সাহিত্যিকদের দু’টি বিখ্যাত আড্ডার জায়গা ছিল প্রাণান্তকর। একটি “ভারতী” পত্রিকার কার্যালয় অন্যটি খ্যাত ছিল “গজেনদার আড্ডা” নামে। দুই জায়গাতে নজরুলের যাতায়াত ছিল ঢের। ওই সব আড্ডায় নজরুলের ভুমিকা দেখে হেমেন্দ্রকুমার রায় লিখেছেন- নজরুল আসতে লাগল প্রত্যহ। ঝড়ের মতো ঘরে ঢুকেই সবাইকে চমক দিয়ে চেঁচিয়ে “দে গুরুর গা ধুয়ে দে।” কোন দিক পাত না করে প্রবাল পরাক্রমে আক্রমণ করেন টেবিল রমোনিয়ামটাকে। তারপর মাথার ঝাকড়া চুল দুলিয়ে গাইতে থাকে গানের পর গান। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নজরুলের গান আর থামে না। কর্নওয়ালিস স্টিটের উপরে ঘর, রাস্তায় জমে যেত জনতা। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে ৪৯ রেজিমেন্ট থেকে ভেঙে দেওয়া হলে নজরুল করাচী থেকে কলকাতায় তার বাল্য বন্ধু শৈলজানন্দের রমাকান্ত বোস স্টিট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের বোডিং এ ওঠেন নজরুল। নজরুল মুসলমান হওয়ায় মেসের চাকর নজরুলের এঁটো বাসন ধুতে অস্বীকার করেন। পরে সে এঁটো বাসন শৈলজানন্দকে পরিস্কার করতে হতো। নজরুল এসব মানতে না পেয়ে ৩২ কলেজ স্টিটে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’র অফিসে ওঠেন।

সেখানে থাকতেন মুজ্ফফর আহমদের সাথে। ওখানে প্রথম গেয়েছিলেন “প্রিয়া বিনা মোর জিয়া না মানে বদরী ছায়ী রে।” নজরুল হিন্দু, মুসলমান কেরানি ছাত্রদের বিভিন্ন মেসে- হোস্টেলে আমন্ত্রিত হয়ে গান করতেন। এছাড়াও তিনি অনেক হিন্দু পরিবারে নিয়মিত গান গাইতেন। নজরুল নিজে গীতিকার, সুরকার, সংগীত পরিচালক ও সংগীত ওস্তাদ হলেও অসংখ্য রবীন্দ্র সংগীত কণ্ঠস্থ ছিল। তাই মুজফফর আহমদ নজরুলকে রবীন্দ্র সংগীতের হাফিজ বলতেন। ক্রমে ক্রমে নজরুল সাহিত্যিক খ্যাতি অর্জনের পাশাপাশি একজন সুগায়ক হিসেবেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে অসহযোগ খেলাফত আন্দোলনে উদ্বেল কুমিল্লা। নজরুল কুমিল্লার রাস্তায় মিছিলে যোগ দিয়ে গাইলেন সদ্য রচিত গান “এ কোন পাগল পথিক ছুটে এল বন্দিনী মা’র আঙ্গিনায়। কুমিল্লার টাউন হলে কংগ্রেসের সভা। বিখ্যাত কংগ্রেস নেতা আশরাফউদ্দিন চৌধুরী, বাবু অতীন্দ্রমোহন রায় সহ প্রমুখ বক্তা ওই সভায় নজরুলকে তাগিদ দিয়ে আনেন। নজরুল সে সভাতে গাইলেন-
“এসো এসো ও মরণ এই মরণে ভীতু মানুষ…
মেঘের ভয় কর গো হরণ।”
নজরুল ১৭ দিন কুমিল্লায় থাকার পর আবার কলকাতায় চলে যান। ওই বছরের নভেম্বরে আবার আসেন কুমিল্লায়। ২১ নভেম্বর দেশ ব্যাপী ছিল হরতাল। নজরুল প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দিয়ে জাগরণী গান-
“ভিক্ষা দাও! ভিক্ষাদাও!
ফিরে চাও গো পুরবাসী।
গেয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করেন। স্বদেশি ও দেশপ্রেমী গান, সুর ও নজরুলের কণ্ঠের যাদুমন্ত্রে জেগে ওঠেছিল পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম চেতনা।
নজরুল এবার প্রায় মাসখানেক ছিলেন কুমিল্লায়। পরে কলকাতায় গিয়ে ৩/৪ সি তালতলা লেনের বাড়ির নীচ তলার দক্ষিণপূর্ব কোণের ঘরটিতে থাকতেন। ওই ঘরে শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠে লিখেছেন “বিদ্রোহী” কবিতা। প্রথমে পেন্সিলে লিখে ছিলেন। আর প্রথম শ্রোতা মুজ্ফফর আহমদ। বিদ্রোহী কবিতাটি প্রথমে “মোসলেম ভারত” পত্রিকায় ছাপার কথা থাকলেও প্রথম ছাপা হয় “বিজলী” পত্রিকায়, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি। বিদ্রোহী কবিতাটি ছাপা হওয়ার সপ্তাহখানে পর ১৫ জানুয়ারি সকালে চারটি ‘বিজলী’ পত্রিকা নিয়ে জোড়াসাঁকো রবীন্দ্রনাথের বাড়ি যান। সেখানে গিয়ে গুরুজি গুরুজি বলে চেচাঁতে থাকলে রবীন্দ্রাথ উপর থেকে বলেন, কী কাজী এমন সাঁড়ের মত চেচাঁচ্ছ কেন ? কী হয়েছে উত্তরে নজরুল বলেন, আমি আপনাকে হত্যা করবো, গুরুজি আপনাকে হত্যা করবো। রবীন্দ্রনাথ হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন নজরুলের হাবভাব তাই বলেন, হত্যা করবো, হত্যা করবো কী ?
ওপরে এসে বসো। নজরুল উপরে যাওয়ার পর আবার বললেন হ্যাঁ, সত্যিই বলছি আপনাকে হত্যা করবো, বসুন শুনুন। নজরুল রবীন্দ্রনাথের সামনে দাঁড়িয়ে অঙ্গভঙ্গী সহকারে ‘বিজলী’ পত্রিকা হতে নিয়ে উচ্চস্বরে ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি আবৃতি করে শোনালেন। রবীনদ্রনাথ স্তব্ধ ও বিস্ময় হয়ে নজরুলের মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে উঠে নজরুলকে জড়িয়ে ধরে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন আর বললেন হ্যা কাজী তুমি আমায় সত্যি হত্যা করবে।

১৯২২ খ্রিস্টাব্দে ২৫ জুন, কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত মাত্র একচল্লিশ বছর বয়সে মারা যান। ওই দিন সন্ধ্যায় কলেজ স্কোয়ারের স্টুটেন্ড হলে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে শোক সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই শোক সভায় নজরুল “চল চল বাণীর দুলাল এসেছিল পথ ভুলে” গানটি রচনা করে ওই সভায় গেয়েছিলেন। ২২শে সেপ্টেম্বর, ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় ১২শতম সংখ্যায় ছাপা হয় নজরুলের “আনন্দময়ীর আগমনে” কবিতাটি। ওই সময়ে পত্রিকাটি কেবল মাত্র পত্রিকাই ছিল না, ছিল, বারুদ বিপ্লবীদের বিস্তর প্রভাবের প্রকান্ড হাতিয়ার। তাতে যখন “আনন্দময়ীর আগমনে” ছাপা হলে ব্রিটিশ শাসনের অন্যায়, অত্যাচার ও বজ্জাতির বিরুদ্ধে লেখা জালাময়ী এ কবিতাও বিপ্লবীদের উৎসাহ উদ্দীপনা আরো বেগতিক প্রাণিত করলো দারুণ ভাবে। তখনকার সরকার দলীয় পুলিশ বাহিনী চটে গেলো, ক্ষেপে উঠলেন নজরুলের বিরুদ্ধে। ০৮ নভেম্বর, হানা দিলেন ধুমকেতু পত্রিকার অফিসে। লক্ষ্য ছিল নজরুলকে গ্রেফতার কারার। নজরুল কলকাতার বাইরে সমস্তিপুরে ছিলেন। ২৩ নভেম্বর, কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেফতার করা হয়। শুধু মাত্র নজরুলের কবিতার জন্য মামলা হলো। প্রেসিডেন্সি জেলে বিচারাধীন বন্দি হিসাবে এক মাস ২৩ দিন থাকার পর ১৬ জানুয়ারী ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে এক বছর সশ্রম কারদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। আলিপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে হুগলি জেলে। হুগলি জেল সুপার মিঃ আসটার্ন ছিল অসম্ভব অত্যাচারি। তাই বন্দিরা জেল জুলুমের প্রতিবাদে জেলের আইন ভাঙতে বাধ্য হয়। নজরুল এই জেল সুপারকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘তোমারী গেহে পালিছ স্নেহে, তুমি ধন্য ধন্য হে’ গানটির সুরে গিয়েছিলেন প্যারডি গান ‘তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে ধন্য ধন্য হে’। পরে ১৮ জুন বহরমপুর জেলে আনা হয় নজরুলকে। ওই সময় বহরমপুর জেল সুপার ছিলেন বসন্ত ভৌমিক তিনি নজরুলকে একটি হারমনিয়াম ব্যবস্থা করে দিলেন। শুরু হলো গান আর গান। জেলবন্দিরা শুনত, শুনত বাহিরের লোকেও। ১৫ ডিসেম্বর, জেল থেকে মুক্তির দিন কৃষ্ণনাথ কলেজের ছাত্ররা মিছিল করে নজরুলকে নিয়ে যায় সাইন্স ম্যাসে। সেখানেও চলে গান। পরে নজরুল ওঠে নলিনাক্ষ স্যান্যালের বাড়িতে। বহরমপুর নজরুল যে কয়দিন ছিলেন যুব সম্প্রদায় তার গানে মশগুল ছিলেন। কারা মুক্তির ০৪ দিন পর ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ এর অধিবেশনে যোগ দেন ১৯২৪ খ্রিস্টিাব্দের ২৫শে ফেব্রুয়ারি। অধিবেশনে ১ম ও ২য় দিন নজরুল স্বরচিত কবিতা ও গান পরিবেশন করেন। ৩য় দিন বিকেলে মেদিনিপুর কলেজের মহিলারা নজরুলকে সংবর্ধনা প্রদানের জন্য এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। ওই সভায়ও নজরুল আবৃত্তি ও সংঙ্গীত পরিবেশন করেন। ৪র্থ দিন বিকেলে ঈদগাহ মাঠের জনসভায় নজরুলকে মুসলমানদের তরফ থেকে আলেমরা অভিনন্দন জ্ঞাপন ও দোয়া কামনা করেন। মেদিনীপুরের অধিবেশনের ৩য় দিন ঘটে অবিস্মরণীয় ঘটনা। নজরুলের গান ও আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হয়ে এক হিন্দু মহিলা নিজের গলার হার খুলে নজরুলকে উপহার দেন। তখনকার হিন্দু যুব সমাজ এটাকে ভালো চোখে দেখে নাই। মুসলমান তরুণ তার প্রতি হিন্দু মহিলার এমন টান দেখে ওই হিন্দু মহিলার আত্মীয় স্বজন পিতা মাতা ধিক্কার দিতে থাকে। সমাজের বিরূপ আচরণে তিক্ত হয়ে নাইট্রিক এসিড পান করে আত্মহত্যা করে মহিলা।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে মার্চের দিকে কুড়িগ্রাম সফরে আসেন নজরুল। সেখানে হাই স্কুলের বার্ষিক মিলাদ মাহফিলে ভাষণ দেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফিরে যান বহরমপুরে। ১৮ এপ্রিল নজরুলের সঙ্গিতের বন্ধু উমাপদ ভট্টাচার্যের কাকার বাড়ীতে ডাঃ সান্যালের বিয়ের অনুষ্ঠান। ব্রাহ্মণ বৈদ্ধ্য কায়স্থদের আলাদা আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা থাকলেও মুসলমানদের একদম ছিল না। গোঁড়া পরিবেশের বিয়ে বাড়িতে নজরুলকে নিয়ে পবিত্র গঙ্গাপাধ্যায় উপস্থিত হয়। তারা নিমন্ত্রিতদের সাথে বসতে গেলে (বিশেষত নজরুল মুসলমান) গোঁড়ার দল ওঠে যায়। এ ঘটনায় নজরুল অনেকটা আহত হয়ে আশর ছেড়ে উমাপদের বাড়িতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসেন। তখন তার হাতে ছিল বহরমপুর জেলে থাকা অবস্থায় রচিত ‘জাতির নামে বজ্জাতি’ বা জাত জালিয়াতি কবিতাটি। এটি সুর করে নজরুল বিয়ের আসরে গেয়ে জাতি ভেদ প্রথা ও ধর্মের নামে ভন্ডামির প্রতিবাদ করেন।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে ১৬ জুন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের মৃত্যু হয়। এতে নজরুল মর্মাহত হয়ে ‘অকাল সন্ধা’ নামে একটি গান রচনা ও এক শোক মিছিলে যোগ দিয়ে ওই গানটি পরিবেশন করেন। ০২ জুলাই অন্য এক শোক সভায় সদ্য রচিত রাজভিখারী গানটি গেয়েছিলেন। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নজরুল বাঁকুড়া যাব ও চাত্র সমাজ এবং গঙ্গাজল জাতীয় বিদ্যালয়ের আমন্ত্রণে বাঁকুড়া সফর করেন। সম্মেলন শেষে তিনি বিষ্ণুপুর রাজবাড়িতে গিয়ে বকতৃতা, আবৃত্তি ও গান পরিবেশন করেন। ওই বছরের শেষ দিকে নজরুল প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। সাথে সাথে ‘লাঙ্গল’ পত্রিকায় প্রধান পরিচালক নির্বাচিত হরেন। লাঙ্গল পত্রিকার অফিসে নজরুলের সাথে সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচয় পর্ব উল্লেখ্য করে লিখে দেন- সে কবিতা পড়ল, গান গেয়ে শোনাল। গলার সুরটি ছিল খুব বারী কিন্তু সেই মোটা গলায় সুরে ছিল যাদু। ঢেউয়ের আঘাতের মতো, ঝড়ের ঝাপটার মতো তার গান আঁছড়ে পড়তো শ্রোতার বুকে। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ২২ মে, কৃষ্ণনগর প্রাদেশিক সম্মেলনে ‘কান্ডারী হুঁশিয়ার’ গানটি পরিবেশন করেন। ওই সম্মেলনের অংশ হিসেবে একই সময়ে কৃষ্ণনগরে ছাত্র ও যুব সম্মেলন ২য় সমাবেশ হয়। দুই সভাতে বেশ গোলমাল হচ্ছিল, নজরুলের গান উভয় ক্ষেত্রের পরিস্থিতি শান্ত করেছিল। এছাড়াও কৃষ্ণনগর টাউন হলে ও জনসভা টাউন হলের মাঠেও নজরুল গান পরিবেশন করেন। কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যস্ততা কমে গেলে জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে হেমন্তকুমার সরকারকে নিয়ে নজরুল ঢাকায় আসেন। (বর্তমান ঢাকা মেডিকেল এলাকায়) ২৮ জুন সকালে মুসলিম অনুষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজ এর অধিবেশনে নজরুল ‘ছাত্রদলের গান’ কৃষানের গান প্রভৃতি পরিবেশন ও বক্তব্য দেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজ এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন এর নজরুল ঢাকায় এসে গান গেয়ে সারা শহর মাতিয়ে তুললেন। সুধীজনের মধ্যে নজরুলকে নিয়ে কাড়াকাড়ি। জনসাধারণ তাঁর গান শুনে আত্মহারা। এর ফাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতি ছাত্রী কাজী ফজিলতুন্নেসার সাথে নজরুলের পরিচয় হয় কাজী মোতাহার হোসেনের মাধ্যমে। নজরুলের অনেক লেখায় ফজিলতুন্নেসার গন্ধ পাওয়া যায়। নজরুল ২৪ ফেব্রুয়ারি আবার কৃষ্ণনগর ফিরেও কলকাতায়। তবে নজরুলের সাথে ফজিলতুন্নেসাকে লেখা আটটি চিঠি যোগাযোগ পাওয়া যায়। ফজিলতুন্নেসার সাথে নজরুলের দেখা হয় সওগাত অফিসে। কিন্তু তাদের আবেগে পূর্ব পরিচয়ের কোন আভাস মেলেনি। সেপ্টেম্বর মাসে ফজিলতুন্নেসা স্টেস্ট স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ যাত্রায় বিদায় সংবর্ধনায় নজরুল গেছিলেন। ‘জাগিলে পারুল কিগো সাতভাই চম্পা’। জুন মাসে নজরুল আবার ঢাকায় আসেন। এবার প্রতিভা সোম ওরফে রানু সোম ও উমা মৈত্র ওরফে নোটনের সাথে নজরুলের বিশেষ পরিচয় হয়। প্রথম দেখাতেই নজরুল রানু সোম ও রানু সোমের পরিবার নজরুলকে আপন করে নেয়। সে সন্ধাতেই রানু সোমদের বনগ্রামের বাড়িতে দোতলায় গানের আসর বসে। বাক্স থেকে হারমোনিয়াম বাটা ভরা পান বের করেন নজরুল, ঘন ঘন চায়ের সাথে শুরু হয় গান। নজরুল গায় রানু কেও গাওয়ায়। নজরুল মুসলমান হওয়াতে বনগ্রামের যুব সমাজ মেনে নিতে পারছিল না। একদিন রাত দশটা কি এগারটার দিকে নজরুল রানুকে গান শিখিয়ে বেরিয়ে আসার সময অন্ধকারে চার সাতজন যুবক লাঠি সোটা নিয়ে নজরুলকে আক্রমণ করে। নজরুল কেবল কবি শিল্পী ছিলেন না ছিলেন সৈনিক জোয়ান মর্দ। তাই তাদের লাঠি কেড়ে নিয়ে দাদের উত্তম মাধ্যম দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে আসেন বর্ধমান।

নজরুল চার সেপ্টেম্বরে সিলেটে প্রাদেশিক স্টুডেন্ট এ সোসিয়েশ এর সম্মেলনে যোগ দেন। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ও ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এসময় নজরুল গান করতে উদ্যত হলে এক মৌলভী প্রশ্ন তোলেন গান গাওয়া জায়েজ কি না। শেরে বাংলা তার উত্তরদেন ‘গান গাওয়া গায়কের নিয়তের ওপর নির্ভর করে…। সভায় নজরুল ওই প্রশ্নের উত্তরে বলেন ‘বসন্তে কোকিল গাছের ডালে বসে আপনার মনে গান গায়’ সে কারো তোয়াক্কা করে না। কাক এসে তাকে তাড়া করলে সে উড়ে যায়। আমিও আমার মনের আনন্দেই গান করবো যদি আপনারা কাকের মত আমার তাড়া করেন, তাহলে চলে যাবো। আরেক মৌলভী প্রশ্ন করে বলেন ‘কবি নামাজ পড়ে কী না’ নজরুল উত্তর দিলেন এটি ব্যক্তিগত ব্যাপার, এতে আপনাদের জিজ্ঞাসা করবার মতো কিছুই নেই উপস্থিত জনতা মৌলভীদের চটিয়ে দিলে নজরুল গান/গজল ধরেন, ‘বাজলো কিরে ভোরের সানাই’ দুর্গম গিরি কান্তার মরু প্রভৃতি। এবার নজরুল প্রায় মাসখানেক ছিলেন সিলেটে।
১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে ৬ নভেম্বর, হরগাছা তরুণ সংঘ এর বার্ষিক সভায় যোগ দেন। হরগাছা (বর্তমান রংপুর জেলার একটি পৌরসভা) সে ১৯ দিন নজরুল হরগাছায় ছিলেন নজরুলের গান ও আবৃতিতে মুখর ছিল হরগাছা। ১৬ ডিসেম্বর নজরুল রাজশাহী মুসলিম ক্লাবের বার্ষিক উৎসবে যোগ দেন। ১৭ ডিসেম্বর রাজশাহীর মুসলিম ছাত্ররা নজরুলকে সংবর্ধনার বিরাট আয়োজন করেন। সেখানে নজরুল হৃদয়গ্রাহী বক্তব্য ও মনমাতানো সঙ্গীত পরিবেশন করেন।
১৮ ডিসেম্বর বিকেলে রাজশাহী টাউন হলে নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য এক বিশাল সভার আয়োজন করা হয়। নজরুলকে দেখতে জনতার ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। শুধু তাই নয় মহিলাদেরও উপস্থিতি ছিল নজর কারা। নজরুল তার গান গেয়ে ও বক্তৃতা দিয়ে মনোমুগ্ধ করেছিলেন রাজশাহীবাসিকে। রাজশাহী সফর শেষে নজরুল কলকাতায়। ২১ ও ২২ ডিসেম্বর নিখিল ভারত কৃষক ও শ্রমিকদলের সম্মেলন এলবার্ট হলে, সম্মেলনের উভয় দিনে নজরুল গান পরিবেশন করেন। ২৮ ডিসেম্বর জওহরলাল নেহেরুর সভাপতিত্বে রামমোহন লাইব্রেরি হলে নিখিল ভারত সোসিয়ালিস্ট যুবক কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ও নজরুল সংগীত পরিবেশন করেন।

১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম সদর মহকুমার নিকটবর্তী কট্টলা গ্রামের ইউনিয়ন ক্লাবের উদ্যোগে নজরুলকে সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। সেখানে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে যোগদেন। স্থানীয় বালিকারা বরণ সঙ্গীত গেয়ে নজরুলের গলায় ফুলের মালা দিয়ে বরণ করেন। নজরুল প্রায় দুই ঘণ্টব্যাপ্তী বক্তাব্য দেন ও গান গায়। জানুয়ারির শেষে নজরুল কলকাতায় গেলেও ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তিনি কেবল কবি, রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে নি একজন সঙ্গীতজ্ঞ হিসেবেও সুপ্রতিষ্টিত হন। উদ্দীপনামূলক গান ও গজল সমূহ। মার্চে যান কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ায় যতীন্দ্রমোহন হলে স্থানীয় মিউনিসিপালিটির পক্ষ থেকে নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই মাসেই বগুড়ার আক্কেলপুর ইয়ংমেনস মুসলিম এসোসিয়েশনের প্রথম বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দেন নজরুল। সেখানে গানের সাথে নজরুল গজল গেয়ে ও বক্তব্য দিয়ে ভূয়সী প্রশংসা পান। তাই সন্ধার পর আবার গজল জলসার আসর
বসে। এতে নজরুল প্রায় দু’ঘণ্টা ব্যাপ্তী গজল পরিবেশন করেন। নজরুলের জাতীয় সংবর্ধনা দেওয়া হয় ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে ০৯ মে, মি. এ ওয়েলেসলি স্কোয়ারে মুসলিম ইনিস্টিটিউট হলে। ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে জাতির পক্ষ থেকে নজরুকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানে সভাপতি ও উপস্থিত জনতার অনুরোধে নজরুল ‘টল টলমল পদভরে’ ও ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গান দুটি গেয়ে শোনান।

২৫ আগষ্ট ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার যতীন্দ্রমোহন বাগচীর সংবর্ধনায় নজরুল ‘তুমি কোন পথে এসে হে মায়াবী কবি’ ও গানটি পরিবেশন করেন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে নজরুল চট্টগ্রামের রাউজানে এক সাহিত্য সম্মেলন যোগ দেন। ওই সম্মেলনের মূল আকর্ষন ছিল নজরুলের গান ও আবৃত্তি। ৫ ও ৬ নভেম্বর সিরাজগঞ্জ কাদীয় মূসলিম তরুণ সম্মেলনের আয়জন করা হয়। নজরুলকে সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য। ২৫ ও ২৬ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে বন্ধী মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনের অধিবেশন হয়, নজরুল সেখানে ‘এসো এসো রসলোক বিহারী মধীবার দল’ উদ্ধোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তারপর বসে গানের জলসা। ২৬ ডিসেম্বর ২য় দিন ‘তোমাদের দান, তোমাদের বাণী’ গান দিয়ে নজরুল বিদায় গীতি পরিবেশন করেন। মোট কথায় বলা যায়, লেটো কবিয়াল নজরুল, দেশত্ববোধ গান, গণ সঙ্গীত, বাংলা গজল, বাংলা ইসলামী গানে নতুনত্ব নির্মাতা, একক অধিপতি শ্যামা সঙ্গীত, লুপ্ত, অপ্রচলিত, নয়া রাগবাচিনীর উদগাতা ও শ্রষ্টা। তিনি মূলত ১৯২৮ থেকে ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই ১৪ বছর সঙ্গীতের সব শাখায় বেশি ঘোর সাধনায় দীপ্ত ছিলেন।

চলচ্চিত্রের সাথে নজরুলের সম্মক গ্রামোফোন বা বেতারের মত গভীর ও ব্যাপক না হলে এ তল্লাটে তাকে বাদ দেওয়ার কোন উপায় নাই। তিনি বিভিন্ন চলচ্চিত্র কাহিনী, চিত্রনাট্য, সংলাপ সঙ্গীত পরিচালনা, সঙ্গীত রচনা, সুর সংযোজন, প্লেব্যাক সিঙ্গার, অভিনেতা এমন কি চিত্র পরিচালকও ছিলেন। মোট ১৩টি চলচ্চিত্রে নজরুল যুক্ত ছিলেন বলে পাওয়া যায়। এর মধ্যে গিরীশচন্দ্র ঘোষের কাহিনি ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা, সঙ্গীত পরিচালনা ও নারদের ভূমিকায় অভিনয় করেন। ‘ধ্রুব’ চলচ্চিত্রের ১৮টি গানের মধ্যে ১৭টি গান রচনা ও সুর এবং চারটি গানের প্লেব্যাক করেন নজরুল। তিনি সুস্থাবস্থায় শৈলকানন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘অভিনয়’ ছায়াছবিতে নজরুল একটি দ্বৈত গান করেন।
১৯৪১ খ্রিস্টাব্দের ৭ আগষ্ট রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মৃত্যু হলে নজরুল ‘রবি হারা’ কবিতাটি স্বকন্ঠে আবৃত্তি করে কলকতা বেতার থেকে প্রচার করে। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের বছর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে নজরুল অসুস্থ হন এবং আগস্টে হন নির্বাক। ৯ জুলাই কলকাতা বেতার কেন্দ্রে বাস ‘সুন্দরম’ প্রবন্ধটি পাঠ করা অবস্থায় নজরুল অসুস্থ হয়। প্রবন্ধটি শেষ পর্যন্ত পাঠ করতে পারেন নি। চারে নজরুলের বন্ধু আসর পরিচালনা নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় ট্যাক্সি করে নজরুলকে বাড়ি পৌঁছে দেন।
১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রমীলা অসুস্থ হয়ে আমৃত্যু ছিল। পরে ২৩ বছর প্রমীলার শরীরের নিচের অংশ অবশ হলেও উপরের ভাগ সুস্থ ছিল। প্রমীলাকে সুস্থ করতে নজরুল নিজের মোটর, বালিগঞ্জের জমি বিক্রি। বইয়ের স্বত্ব ও রেকর্ডের রয়ালটি বন্ধক রেখে প্রচুর অর্থ ব্যায়ের অর্থস্বান্ত হয়ে ছিলেন। এলোপ্যাথী হোমিওপ্যাথি, আয়ুর্বেদিক, আধিভৌতিক, কবিরাজী ও আধ্যাত্মিক সব রকম চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। সপ্তাহখানেক চিকিৎসা হলেও কোন উন্নতি হল না।
হাতের কম্পন ও জিহ্বার আড়ষ্টাতা বৃদ্ধি হয়। নজরুলের অসুস্থতার সংসারের আয়ে পথ বন্ধ হয়। দুই সন্তান বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর বয়স তখন ১২ বছর ছোট ছেলে কাজী অনিরুদ্বের বয়স ১০ বছর। নজরুলের কোন সঞ্চয় ছিল না উলটো ঋণগ্রস্থ ছিলেন। নজরুলের সুস্থতার জন্য ১৯ জুলাই রাতে সপরিবারে যান মধুপুরে দুই মাস চিকিৎসার পরেও কোন উন্নতি হলো না ২১ সেপ্টেম্বর ফিরলেন কলকাতায়। এবার রবীন্দ্রনাথের চিকিৎসক কবিরাজ বিমলানন্দ তর্ক তীর্যের চিকিৎসায় একটু সুফল পাওয়া গেলেও নজরুলের মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দিল। অক্টেবরে নেওয়া হয় লুম্বিনী পার্ক মানসিক হাসপাতালে সেখানে চার মাস থাকলেও কোন উন্নতি নাই। ১৯১৩ জানুয়ারিতে বাড়িতে আনা হয়। অর্থ অভাবে অচল সংসার চিকিৎসা চলে কী করে। পরে নজরুল সাহায্য কমিটি নজরুল এইড ফান্ড পূর্ব পাকিস্থান সাহিত্য সংসদ ও নজরুল নিরাময় সমিতি থেকে প্রাপ্ত সরকারি বে সরকারি অর্থ ব্যায়ের বিনিময়ও নজরুল স্থান হয়নি ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ১০ ডিসেম্বর, প্রায় দশটি বছর নজরুল বিস্মৃত জীবন যাপন করে। এতে প্রতিবছর ১১ইং জ্যৈষ্ঠ ভারতে সরকার নজরুল জয়ন্তী পালন করে আসছিল। ১৯৬০ ‘পদ্মভূষণ’ ভাগতি ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ১২ ডিসেম্বর নজরুল শেষ বারের মতো সুস্থবস্থায় ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম বার্ষিকী অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। ১৯৭২ সালে ২মে ভারত সরকারের অনুমোতিক্রমে বাংলাদেশ বিমান যোগে নজরুলের সপরিবারে ঢাকায় আনা হয়। ওই দিনেই ‘চল চল চল’ গানটি রণসঙ্গীত ও আমার সোনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নজরুলকে মাসিক এক হাজার টাকা ভাতা প্রদান ও ধনমন্ডি ২৮ নং সড়কে বরাদ্দকৃত দুতলা বাড়ি কবি ভবনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাখা হয়েছিল। ১৯৭২ খ্রিস্টাব্দে ২৫মে বাংলাদেশে প্রথম নজরুলে ৭৩তম জন্ম জয়ন্তী উদযাপিত হয়। ১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে ৯ই ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে নজরুলকে সম্মাান সূচক ডি-লিট ডিগ্রি প্রদান করা হয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান ২১ ফেব্রুয়ারি একুশে পদক দেওয়া হয়। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ২২শে জুলাই নজরুলকে পি জি হাসপাতালে স্থানান্তরিত ১১৭ নং কেবিনে নেওয়া হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় এক বছর এক মাস আট দিন পর ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট, রবিবার সকাল ১০ টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্যাস ত্যাগ করেন।
নজরুলের কবরের স্থান নির্ধারণের জন্য সরকারি বৈঠক বসে। প্রথমে শেরেবাংলার মাজারের বা বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গনের কথা ভাবা হলেও শেষে বুদ্ধিজীবি শিল্পী সাহিত্যদের পক্ষে উপাচার্য ডঃ ফজলুল হালিম চৌধুরীর প্রস্তাবে সিদ্ধান্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ প্রাঙ্গনে নজরুলকে কবর দেওয়া হয়।

সঙ্গীতাঙ্গন পরিবারের পক্ষ থেকে তার মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শোক এবং বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি।

Related Articles

Leave a reply

Please enter your comment!
Please enter your name here

Stay Connected

18,780FansLike
700SubscribersSubscribe
- Advertisement -

Latest Articles