– সুব্রত মণ্ডল সৃজন।
গান তো আমরা কম বেশি শুনি। গানের মিউজিক ভিডিও দেখি। আনন্দ ও তৃপ্তি উভয়ই পাই, তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সেই আনন্দ ও তৃপ্তি স্থায়ী হয় না। হয় ক্ষণকালের জন্য। কিন্তু বাংলার সঙ্গীত আকাশে এমনও নক্ষত্র আছে যে, না থেকেও তারা নিত্যই মানুষকে আনন্দ ও তৃপ্তি দিয়ে যাচ্ছে। আর এমনই একজন গুণী শিল্পীর জন্মদিন আজ যার গান আজও মানুষের মুখে মুখে ধ্বনিত হয়। হৃদয়ে শিহরণ জাগায়! তিনিই আব্দুল আলিম। যাকে চেনানোর জন্য অন্য পরিচয়ের প্রয়োজন হয় না। তবুও আজ ২৭ জুলাই তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে তাকে নিয়ে কিছু জানা-অজানা বিষয়ে আলোকপাতের মধ্য দিয়ে তাকে স্মরণ ও শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করে তাঁর ভক্তদের হৃদয়পটে আনন্দ জাগানোর জন্যই এই আয়োজন।
প্রথমেই তাঁর কিছু কালজয়ী গানের শিরোনাম জেনে নেই, তা হলো-
‘পরের জায়গা পরের জমি, নাইয়া রে নায়ের বাদাম তুইলা, সর্বনাশা পদ্মা নদী, হলুদিয়া পাখি, মেঘনার কূলে ঘর বাঁধিলাম, এই যে দুনিয়া, দোল দোল দুলনি, দুয়ারে আইসাছে পালকি, কেন বা তারে সঁপে দিলাম দেহ মন প্রাণ, মনে বড় আশা ছিল যাবো মদীনায়, বন্ধুর বাড়ি মধুপুর, উজান গাঙের নাইয়া’ প্রভৃতি গান মানুষের আত্মার খোরাক হিসেবে আজও জোগান দেয়।
এমনই কালজয়ী গানের কিংবদন্তী শিল্পী আব্দুল আলীম বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) মুর্শিদাবাদের তালিবপুর গ্রামে ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাল্যকাল থেকেই তিনি সঙ্গীতের প্রতি প্রবল অনুরাগী ছিলেন। ছোটবেলায় তাঁর সঙ্গীত গুরু ছিলেন সৈয়দ গোলাম আলী। ঐ অল্প বয়স হতেই বাংলার লোক সঙ্গীতের এই অমর শিল্পী গান গেয়ে নাম করেছিলেন। হয়তো জানা থাকবে, মাত্র তেরো বছর বয়সে ১৯৪৩ সালে তার গানের প্রথম রেকর্ড হয়। রেকর্ডকৃত গান দুটি হলো ‘তোর মোস্তফাকে দে না মাগো’ এবং ‘আফতাব আলী বসলো পথে’। এত অল্প বয়সে গান রেকর্ড হওয়া সত্যিই বিস্ময়কর! বিশেষ করে তখনকার সময়ে। পরে তা আর বিস্ময় হয়ে থাকে নি, তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার লোক সঙ্গীতের এক কিংবদন্তি পুরুষ। তার সাত সন্তানের মধ্যে তিন সন্তানই সঙ্গীত শিল্পী। তারা হলেন – জহির আলীম, আজগর আলীম ও নূরজাহান আলীম।
সঙ্গীত শিক্ষায় পরবর্তীকালে তিনি কলকাতায় যান এবং সেখানে আব্বাসউদ্দিন ও কাজী নজরুল ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট হয়ে গান করেন। তিনি লোক ও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের উপর দীক্ষা নিয়েছেন বেদারউদ্দিন আহমদ, ওস্তাদ মোহাম্মদ খসরু, মমতাজ আলী খান, আব্দুল লতিফ, কানাইলাল শীল, আব্দুল হালিম চৌধুরী প্রমুখের কাছে। কাজ করেছেন লেটো দলে, যাত্রা দলেও।
বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ সহ বিভিন্ন বাংলা চলচ্চিত্রে আব্দুল আলীম গান করেছেন। সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০টির মতো গান রেকর্ড হয়েছিল তার। আব্দুল আলীম তার আধ্যাত্মিক ও মরমী মুর্শিদী গানের জন্য অমর হয়ে থাকবেন। পেশাগত জীবনে আবদুল আলীম ছিলেন ঢাকা সঙ্গীত কলেজের ‘লোকগীতি’ বিভাগের অধ্যাপক।
‘এদেশ তোমার আমার, জোয়ার এলো, সুতরাং, পরশমণি, বেদের মেয়ে, রূপবান, সাত ভাই চম্পা, পদ্মা নদীর মাঝি’ সহ প্রায় অর্ধশত বাংলা চলচ্চিত্রে নেপথ্যে কন্ঠশিল্পী ছিলেন।
মরণোত্তর ‘একুশে পদক’ সহ বিভিন্ন সম্মাননায় সম্মানিত হয়েছেন তিনি। আর এই লোক সঙ্গীত শিল্পী, পল্লীগীতি সম্রাট, কিংবদন্তি আব্দুল আলীম চির স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে সকল ভক্ত হৃদয়ে। তিনি নশ্বর দেহ ত্যাগ করে অবিনশ্বর জগতে প্রবেশ করেন ১৯৭৪ সালে ৫ সেপ্টেম্বর।
সঙ্গীতাঙ্গন এর পক্ষ থেকে জন্মদিনে শিল্পীর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করছি। শিল্পের সাথে শিল্পী বেঁচে থাকুক চিরদিন। জয় হোক বাংলা গানের।