– সংগ্রহ – মোহাম্মদ আমীন আলিফ।
সাধনা মানেই শত ধৈর্য্য, শত স্বপ্ন, আর শত বিশ্বাসে লেগে থাকা। বাংলাদেশের বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী শ্রদ্ধেয় মাহমুদুন্নবী শুধু একজন গায়কই ছিলেন না তিনি ছিলেন একজন ধৈর্য্যশীল প্রতিভাবান শিল্পী। তিনি গানের মাধ্যমে এখনো বেঁচে আছেন গান প্রিয় মানুষের হৃদয়ে। সুরের ভুবন আলোকিত করে তিনি রেখে গেছেন কত শ্রুতির গান।
রেখে গেছেন সুরের উত্তরসূরী।
মাহমুদুন্নবীর সু’কন্য দেশের স্বনামধন্য সঙ্গীতশিল্পী ফাহমিদা নবী’র লেখা বাবাকে নিয়ে এই ঐতিহাসিক গল্পঃ
“আমার আব্বা যখন গান গাইবার জন্য বাড়ী থেকে পালিয়ে যায়, তখন ওস্তাদ গফুঁর খাঁ গান শুনে মুগ্ধ হন। সেই সুবাদে গুরুর বাড়ীতে থাকতে জায়গা পেয়েছিলেন। আব্বা ভেবেছিলো গান শিখবে! কিন্তু ওস্তাদজী রেওয়াজ করতেন ঠিকই কিন্তু শেখাতেন না কিছু। আব্বা শুধু শুনতেন আর গুনগুন করতেন। এভাবে প্রায় ৬ মাস চলে গ্যালো। আব্বা বাজার করতেন, ফিরে এসে দেখতেন ওস্তাদজী সারগাম করছেন অনেক শিষ্যরা তার সাথে গলা মিলিয়ে একই তান দীর্ঘ ৬ মাস ধরে করেই যাচ্ছে! কিন্তু কারো মুখে চোখে এতটুকু বিরক্তি নাই, নাই কোন সমালোচনা আলোচনার ক্লেশ! কারো এত বড় সাহস নাই যে কেউ কাওকে প্রশ্ন করবে বা কোনকিছু ওস্তাদ সম্পর্কে বলবে, অথবা অনেক বড় শিল্পী হয়ে যাবার লক্ষ্যে কতটুকু পৌঁছাতে পারলো সেটা নিয়ে ভাব্বে! এত বড় উধ্বর্ত করবার চিন্তা মাথায়ও নাই! আর আব্বাকেও তিনি একবারও বলছেন না ‘বেটা তুমি শেখো’ এভাবে আরো ৬ মাস চলে গ্যালো…!! আব্বাও চুপচাপ যা বলেন ওস্তাদজী, তাই করেন!
তারপর একদিন হঠাৎ তিনি আব্বাকে ডেকে বল্লেন ‘গাও বেটা যা এতদিন ধরে শুনলে…’
আব্বা তো আকাশ থেকে পড়লো!
কি গাইবে কিছু তালিম তো নিতেই পারেনি ?!
আবার বল্লেন তান ধরো…!
আব্বা গেয়ে উঠলো…
যা ১২ মাস ধরে শুধু প্রতিদিন শুনতো!
আব্বা গাইতে গিয়ে নিজেই চমকে গিয়েছিলো!
কি ব্যাপার আমি তো গাইছি!!!!!
কি করে পারছি ?????
তারপর ওস্তাদজীকে আব্বা বল্লেন আমি কি গাইতে পারছি ?
ওস্তাদজী বল্লেন… ‘তুমি গাইছো কিন্তু এখন সঠিক গাইবার জন্য, আজ থেকে শেখা শুরু করো। আর বাজার করতে যেতে হবেনা!’
আব্বা শুরু করলেন সাধনা করা…
কোন প্রশ্ন মনে আসেনি, আক্ষেপ করেনি!
কেন এতোদিন তাকে না শিখিয়ে শুধু বাজার করাতো, চা বানাতে বল তো!
ওস্তাদরা কখনো কিছু করে দেয়না…বা দিতে পারে না! তার কাছ থেকে শুধু তালিম নিতে জানতে হয়, বুঝতে হয়!
বাকি পথটা নিজের চেষ্টায়, সাধনায় নিজেকে সম্মৃদ্ধ করতে হয়।
আব্বা যখন এই সত্য গল্পটা বলেছিলো…
তখন দেখেছিলাম আব্বার মুগ্ধতা তার গুরুর প্রতি। কেউ যখন কাউকে গুরু মানে তখন শিষ্যকে শুধু তার প্রতি মন্ত্র মুগ্ধতায় থাকতে হয়।
আব্বাকে দেখে শিখেছি কতটা ভালোবেসে গুনমুগ্ধতায় নিজেকে তৈরী করতে হয়।
একবার যদি মনে প্রশ্ন আসে কি শিখলাম, কি হলো আমার লাভ ? তাহলে তোমার স্বপ্নের ইতি ওখানেই টানা হয়ে গ্যালো, টের পাবে না।
গুরুর সমালোচনা করে নিজেকেই ছোট করা ছাড়া আর কিছুই হয়না!
এটাই শিক্ষা। যারা অভিজ্ঞ, জীবনের দর্শনে।
তাদের জন্য কিছু করার মানসিকতায় সেরকম মন তৈরী করতে হয়। তাতে করে সেই বড় হয় যে সম্মান নিজের ভেতর বহন করতে পারে!
কিছু পাবার আশায় নয়, কিছু শেখার আশায় পথ চলো…দেখবে তুমি সাধনায় হবে অনন্য!
অন্যথায়…কোনদিনই তা পাবে না যা পাবার জন্য হন্যে হয়ে আলোচনা সমালোচনা করছো!
মহাসমুদ্র তো মহাই…
রাশি রাশি জল এসে মিশে…
তার কি সময় আছে ভাবার
কোন জলটা মিশে জল ঘোলা করলো ?!
জ্ঞান শেখানো যায় না, তা নিজেস্বতা, চর্চা করতে হয়।
এক ধাপে, এক লাফে হয়তো নিচের দিকে নামা যায়। মানে নিচের দিকে নামতে পারবে। কিন্তু নিজেকে অনন্য করতে গেলে থেমে থেমে সিঁড়ির ধাপগুলো পার করে করে উপরে উঠতে হয়। তাই সহজ নয়, সহজে স্বপ্ন ধরা!
এক লাফে সব সিঁড়ি তো ওঠা যায় না, তাই না ?? – ফাহমিদানবী